আশরাফুলকে এখনো বন্ধু জানেন মাশরাফি

mashraf home

আপন তারিক ।।

মাশরাফি বিন মর্তুজা শুধু একজন ক্রিকেটারের নামই নয়, লাখো মানুষের প্রেরণার বাতিঘরও। মাঠ এবং মাঠের বাইরের কোনো বিতর্কই তার ১৫ বছর ছাড়িয়ে যাওয়া ক্যারিয়ারে সামান্য কলঙ্কটুকুও লাগতে দেয়নি। টাইগারদের রঙিন পোশাকের অধিনায়ক সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক চরিত্র। মাশরাফি নামটাই যেন একটা মিথ। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যক্তিত্ব অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবর্তন ডটকমের
আমাদের নিকলী ডটকম-এর পাঠকদের জন্য তার হুবহু তুলে ধরা হলো।

মিরপুরে নিজের নতুন ফ্ল্যাটে প্রাণ খুলে বলেছেন নানা কথা। যেখানে আশরাফুল, মুস্তাফিজ থেকে শুরু করে ফেসবুক প্রজন্মের কথাও ওঠে এসেছে। তিন পর্বের দীর্ঘ সেই সাক্ষাতকারের প্রথম কিস্তি পড়ুন আজ।

mashraf home

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম দিনটার কথা মনে আছে? ২০০১ সালের ৮ নভেম্বরের সেই সকাল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। প্রথমবার টাইগারদের জার্সি গায়ে উঠল আপনার।
-সত্যি বলতে কী, সেটা নিয়ে তেমন কোন ফিলিংস কাজ করে না। তবে দিনটার কথা মনে আছে। তখন এতো কিছু বোঝার মতো বয়সও ছিল না। ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা। আর সেই খেলাটা বড় একটা মাঠে অনেক দর্শকের সামনে খেলতে পারবো, এটাই শুধু ভেবেছি। ওই ম্যাচে এক ইনিংসে ৪টা উইকেট পেয়েছিলাম, সেটা নিয়েও তেমন একটা কিছু ‘ফিল’ করিনি।

এরপর যখন সেই প্রিয় নড়াইল ছেড়ে একেবারে ঢাকায় চলে আসতে হলো, তখন মনের কী অবস্থা ছিল আপনার? বন্ধু, পরিবারের মানুষদের জন্য নিশ্চয়ই মনটা খারাপ হয়ে উঠেছিল?
-জাতীয় দলে খেলার অনুভূতি থেকে সেটা আসলে পুরো বিপরীত ছিল। ভেতরে ভেতরে আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। মানতেই পারছিলাম না, সেই এলোমেলো শৈশব, দুষ্টুমি, নড়াইলের স্বাধীন জীবন ছেড়ে ঢাকা চলে আসতে হবে। আমার শৈশবটা আনন্দ আর দুরন্তপনায় ঠাসা ছিল। চোখ বন্ধ করলে সেই দিনগুলো এখনো মনে পড়ে। তখন মন যা চাইতো ঠিক তাই করতাম। সত্যি বলতে কী আমার পুরো জীবনে মস্তিষ্কের চেয়ে মনকেই গুরুত্ব দিয়েছি। যেমনটা বলছিলাম, জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার পর ঢাকায় আসতে মন চাইছিল না। কিন্তু কতো কিছুই তো আমরা চাই না। তারপরও করতে হয়।

তারপর নড়াইলের কৈশোর পেরোনো কৌশিক ঢাকায় আসলেন। নতুন পরিবেশে। নতুন নতুন বন্ধু। নিজে হয়ে গেলেন মাশরাফি। সেই সময়ের কথা বলুন।
-সেটা কঠিন একটা সময় ছিল আমার জন্য। ঠিকমতো বলে বোঝাতে পারবো না। নড়াইল আর সেইসব বন্ধুদের জন্য মন কাঁদতো। তখন নতুন সেই পরিবেশে বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গেই পরিচয় হল। তবে তালহা জুবায়ের, নাফীস ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুলের কথা বলতে হবে। ওদের সঙ্গে টুকটাক কথা হতো।

মাঠের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই যে মাঠে নামলেই ভিন্ন চেহারা আপনার। আশরাফুল সেদিন বলছিলেন, ক্রিকেট মাঠের সীমানা দড়ির মধ্যে পা রাখলে আপনি একশো ভাগেরও বেশি দেয়ার চেষ্টা করেন। এই আবেগ, এমন দুর্মর সাহস কোথায় থেকে পান?
-এটা আসলে ভাষায় বর্ণনা করার মতো কিছু নয়। আমি এই ব্যাপারটা কখনো ভেবেও দেখিনি। সত্যি বলতে কী, আমার কী আছে আমি জানি না। এই যে আবেগ-আগ্রাসন যার কথা বললেন, তা ঠিকঠাক বলে বোঝাতে পারবো না। যা আছে সেটা আমার মতোই। হয়তো এটাই আমি। আসল কথা হলো কিছু জায়গায় জীবনে ছাড় দিতে শিখিনি।

mashrafe ashraful sakib

আশরাফুল বাংলাদেশের আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা। আপনারা একসঙ্গে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। তিনি একসময় ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে নিষিদ্ধ হলেন। তখন শোনা গিয়েছিল আপনি আশরাফুলকে ‘দেশদ্রোহী’ বলেছিলেন। যদিও অ্যাশ আপনার এমন প্রতিক্রিয়া বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন।
-আশরাফুল কি বলেছিল?

পরিবর্তনের সঙ্গে আশরাফুল বলেছিলেন, ‘ও আমাকে দেশদ্রোহী বলে ভুল করেনি। ওটা তার নিজস্ব মতামত। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভাবনা থাকতেই পারে। মাশরাফি কি বললো সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।’
-আমি সারা জীবনই ওর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলাম। আশরাফুল এখনো আমার বন্ধু। ও কী করছে সেটা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। বন্ধুত্বের জায়গায় ও এখনো আমার খুবই কাছের একজন। সেটা আজীবন থাকবে। আর আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই- বাংলাদেশের যদি সর্বকালের সেরা প্লেয়ার বলা হয়, তবে অবশ্যই তার নাম বলতে হবে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবো না। কিন্তু ওকে আমি রেসপেক্ট করি, অ্যাজ এ প্লেয়ার, এটা সত্যি।

আশরাফুল তো নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আবার ফেরার লড়াই শুরু করেছেন। ঘরোয়া লিগে খেলছেন। আপনার সাবেক এই সতীর্থের ফেরার সম্ভাবনা কতোটুকু দেখেন?
-অবশ্যই তার জায়গা থেকে ঠিকই আছে। ফেরার চেষ্টা ও করবেই। আমার শুভকামনা সবসময়ই ওর জন্য থাকবে। ও কোনো ভুল করেছে কি-না সেটা নিয়ে কোনো কথাই বলতে চাই না।

পরিবার বলতে সবারই চোখে ভেসে ওঠে বাবা-মার মুখ। স্ত্রী-সন্তানরাও জড়িয়ে আছেন। আপনি বারবারই ক্যারিয়ারে তাদের অবদানের গল্প শুনিয়েছেন..
-আলহামদুল্লিল্লাহ, আমার বাবা-মা দুজনই বেঁচে আছেন। তারা দু’জনই নড়াইলে থাকেন। আমার মা এখন অবশ্য ঢাকায় আছেন। ওনাদের দোয়াতেই আজকের আমি। আসলে প্রতিটি বাবা-মার কাছেই সন্তানরা এমন। আর আমার স্ত্রী’র কথা সেভাবে কখনো বলিনি। একজন ক্রিকেটারই নয়, প্রতিটি মানুষের সফলতার পেছনে পরিবারে সমর্থন জরুরি। সেখানে আমি শতভাগ ভাগ্যবান। ম্যাচ থাকলে যতো বড় সমস্যাই থাকুক আমার স্ত্রী সেটা আড়াল করেন। ও সবসময়ই আমাকে নির্ভার থেকে খেলতে দিয়েছে।

mashrafe local players

পরিবারের পরই বন্ধুদের জন্য সবচেয়ে বেশি সময় দিয়ে থাকেন আপনি। তাদের কথা শুনতে চাই।
-নড়াইল এবং ঢাকা, দু’জায়গাতেই আমার বন্ধুরা আছেন। আমার ক্যারিয়ারে তাদের ভূমিকা অনেক। যদি ক্রিকেটের ১৫ বছরের কথা বলেন তবে অনেক বড় ভূমিকা ছিল আমার বন্ধুদের।

সেটা কিভাবে?
-ওরা আমাকে সব সময়ই ‘মোটিভেট’ করেছে। আমার বাজে সময়গুলোতে পাশে থেকেছে, সবসময়। অনেক ব্যাপার আছে, যেটা বাসার মানুষদের সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। সেটা বন্ধুদের সাথে অকপটে করা যায়। সেই সমর্থনটা সব সময় পেয়েছি। আবার ক্রিকেটিং ক্যারিয়ারের পুরোটাতেই জড়িয়ে আছে ওরা।

ক্রিকেট ছাড়া একটা দিন বেঁচে থাকতে হবে এমনটা চিন্তা করতে পারেন?
-ক্রিকেট আসলে কিছুই না। বিশাল এই জীবনে, বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যে খেলাধুলা বড় কিছু নয়। ক্রিকেট কখনোই জীবনের অংশ না। এটা শুধুই একটা গেম। জীবনটা অনেক বড়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছুর সঙ্গে ক্রিকেটের তুলনা চলে না। দেখুন, আমাদের প্রতিটা দিনে সমস্যার শেষ নেই। সংগ্রাম করে যাচ্ছি সবাই। দু’বেলা খাবার জোটাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে লড়াই। এমন একটা জীবনে ক্রিকেট শুধুই বিনোদনের পসরা মাত্র। সবকিছুর উপরে আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর বেঁচে থাকার লড়াই।

অনেকেই আছেন যারা ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী, ধরেই নিয়েছে এই জীবনে বুঝি আর কিছুই হবে না। ব্যর্থ মানুষ! অন্ধকারে লুকোতে চান তারা। আশার কোনো বাতিঘর নেই তাদের। আপনি তো লাখো মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস, তাদের কী বলবেন?
-ব্যর্থ বলে জীবনে আসলে কিছু নেই। সত্যি বলতে কী, সফলতা-ব্যর্থতা এগুলো মানুষের হাতে থাকে না। এগুলো সবই আল্লাহ তায়ালার নিয়ন্ত্রণ। এ কারণেই এটা নিয়ে এতো কিছু ভাবার নেই। ব্যর্থ কোথায়? যার চার হাত-পা আছে সে ব্যর্থ নয়। এমনকি যার হাত-পা নেই তারাও লড়ে যাচ্ছে। সুতরাং আশা হারালে চলবে না। চেষ্টা করতে হবে। দেখুন, চেষ্টা করলেই হয়তো আপনি ভালো ক্রিকেটার, মোটা বেতনের চাকুরিজীবী কিংবা সফল ব্যবসায়ী হতে পারবেন। কিন্তু ভালো মানুষ, সহজ মানুষ হতে গেলে অনেক সময় ব্যর্থ হতে হয়। তখন আশা হারালে চলবে না। আমি আমার জীবন থেকেই দেখেছি- একটা সময় ঠিকই অন্ধকার পেরিয়ে আলোর দেখা মেলে। রাত শেষে দিন আসে, এটা বিশ্বাস করলেই চলবে।

দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন : ভালো কিছু করতে চাইলে ক্রিকেটের বাইরেও সুযোগ আছে

তৃতীয় কিস্তি পড়ুন : হুট করেই একদিন খেলা ছেড়ে দেবো : মাশরাফি

 

সূত্র : আশরাফুল এখনো আমার বন্ধু: মাশরাফি (পরিবর্তন ডটকম)

Similar Posts

error: Content is protected !!