কিশোরগঞ্জ-৫ : শেষ মুহূর্তে নৌকার আলোচ্যরা

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। ২০দলীয় জোটের বিএনপি মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে এ সংক্রান্ত আন্দোলন কর্মসূচিও রেখেছে অব্যাহত। কিশোরগঞ্জ-৫ নিকলী-বাজিতপুর আসনটিতে জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশিরাও তুলনামূলক নিরব। নৌকা প্রতীক পেতে ইতিমধ্যেই প্রায় ডজনখানেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। প্রচারণায়ও সরব। উজান-ভাটির হাওর সমতলের উপজেলা দু’টির হাটে-মাঠে-ঘাটে তাই অধিক আলোচনা “নৌকা” প্রতীক আকাঙ্খিদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নিয়ে। কার ভাগ্যে জুটছে স্বপ্নের “নৌকা” প্রতীক?

নিকলী-বাজিতপুর উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভার ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭০৬ ভোটার। ৫ বার বিএনপির দখলে থাকার পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ফিরে পায় কিশোরগঞ্জ-৫ আসনটি। নায়ক তৎকালীন আওয়ামীলীগের সম্পূর্ণ নতুন মুখ শিল্পপতি আলহাজ্ব আফজাল হোসেন। টানা দুইবারের সাংসদ হিসাবে এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেতে শক্তিশালী দাবিদার। গণসংযোগে সভা-সমাবেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের অপরাপর মনোনয়ন প্রত্যাশিদের চেয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে ভাষণ দিচ্ছেন।

দলটির একাধিক পক্ষের অভিযোগ, সে সময়ে সারা দেশে দলীয় জোয়ারে আলহাজ্ব আফজাল হোসেন এমপি হয়েছেন। ব্যবসায়ী থেকে এমপি হলেও রাজনৈতিক গুণাবলীহীন। তার রাজনীতি একটি বিশেষ মহলের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ মহলটির স্বার্থরক্ষায় দলের ভিতরেই দলাদলির সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলের চেয়ে দুই উপজেলার আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে তুলনামূলক মামলার সংখ্যা অধিক। প্রবীণ ও ত্যাগীরা স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে জোট বেঁধেছেন এই সাংসদের মনোনয়নের বিরুদ্ধে। এমনকি আফজাল হোসেন মনোনয়ন পেলে তা ঠেকাতে কঠিন কর্মসূচিরও ঘোষণা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে।

তবে আফজাল সমর্থকদের দাবি, তিনি নির্লোভ ব্যক্তিত্ব। তার দুইবারের শাসনামলে নিকলী-বাজিতপুরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে সবার মন রক্ষা করা যায় না। তিনিও পারেননি হয়তো। কিন্তু মনোনয়ন পেলে মান-অভিমান থাকবে না। শেখ হাসিনাকে আসনটি উপহার দেয়ার যোগ্যতা তারই রয়েছে।

আলহাজ্ব আফজাল হোসেন, অজর কর খোকন এবং শেখ নূরুন্নবী বাদল

একটি পক্ষ মনে করছেন- সাবেক আমলা, বাজিতপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আলহাজ্ব আলাউল হক প্রবীণ রাজনীতিক। পরিচিতি ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তিত্ব। তবে এ আসনে ১৯৯৬ সালে মনোনয়ন দিয়ে “নৌকা” কুলিয়ে উঠতে পারেনি। তাই তার ওপর নেতা-কর্মী এমনকি আওয়ামীলীগও পূর্ণ ভরসা করতে পারবে না।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় করের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সুবক্তা হিসাবে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিচিতি রয়েছে। নিজ উপজেলা নিকলীতে তুলনামূলক কম উপস্থিতিতেও বিশাল সমর্থকগোষ্ঠি প্রচার-প্রচারণায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে রেখেছে তাকে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা। ২০১৪ সালে তিনি দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি আওয়ামীলীগের মতো অভিজ্ঞ দল কিভাবে নেয় সেই শঙ্কাও রয়েছে।

ভোটের মাঠে সরব রয়েছেন জেলা কৃষকলীগ সহ-সভাপতি ফারুখ আহাম্মদ। বেসরকারি একটি ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার প্রধান কর্মকর্তা তিনি। অল্প সময় রাজনীতিতে ব্যয় করতে পারলেও বিচক্ষণ বলে খ্যাতি রয়েছে তার। ছুটি কাটাতেই তিনি এলাকায় অবস্থান করেন এবং সেই সময়েই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন বলে কম পরিচিতির দুষ্টে দুষ্ট তিনি। তাকে নিয়ে দুই উপজেলার দলীয় রাজনীতিতে চলমান কোন্দল কাটিয়ে উঠতে পারার সম্ভাবনা কম দেখছেন আওয়ামী বোদ্ধারা।

সাবেক ছাত্রনেতা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য শাহ্ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ভদ্র ও সদালাপি। অল্প সময়ে প্রচার-প্রচারণায় পরিচিতি পেয়েছে তার নাম। এসব কাজে ও জনসংযোগে বিএনপি দলীয় চিহ্নিত পদ-পদবীধারি কয়েক ব্যক্তি তার সঙ্গি। দলীয় নেতা-কর্মির চেয়ে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মিদের সাথে শাহনূরের সখ্যতার বিষয়টি দলীয়দের আহত করছে বলে আওয়ামীলীগের বেশ কয়েক নেতার অভিযোগ।

নিকলী উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হাজী নূরুল আমীন গণসংযোগকালীন হৃদযন্ত্রের সমস্যায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় রয়েছেন।

কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিল্টন তৃণমূলে তুলনামূলক উপস্থিতি কম হলেও দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যানার-পোস্টারে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। আলোচনায়ও রয়েছেন। তার পিতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ ১৯৭৯ ও ১৯৯১-এর নির্বাচনে “নৌকা” প্রতীক নিয়ে পরাজিত হন। দলীয় ক্রান্তিলগ্নে নবীন এই নেতার ওপর আস্থাও কঠিন হয়ে দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন বোদ্ধারা। শিল্পপতি আবুল মনসুর আহম্মদ। পোস্টার-ব্যানারে দুয়েকবার দেখা পেলেও জনমনে ঠাঁয় করতে পারেননি এই প্রার্থী।

অন্যদিকে নিজের চেয়ে আওয়ামীলীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার উন্নয়নের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এক রাজনীতিক অ্যাডভোকেট শেখ নূরুন্নবী বাদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রনেতার ব্যানার-পোস্টারে যেমন প্রচার করছেন শুধুই হাসিনা সরকারের উন্নয়ন বার্তা, তেমনি দলীয় প্রধানদের ছবিকে দিচ্ছেন নিজের চেয়ে বেশি প্রাধান্য। ২০০০ সালে উপজেলা আওয়ামীলীগের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনকালে ৬ মাসের মধ্যে সকল ইউনিয়ন কমিটি করে সফল হন। ২০০৯-এ বাজিতপুরের সাবেক এই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান দায়িত্বকালে নেতাসুলভ স্বভাবের কারণেই ঘুরে বেড়াতেন ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিক দ্বারে।

দলের ভিতরে এবং দলের বাইরে দল-মত নির্বিশেষে সকলের সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠে। নানাবিধ ত্বরিৎ সমস্যায় দাপ্তরিক দীর্ঘসূত্রতার অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যোগে সমাধানে নজির সৃষ্টি করেছেন। নিকলী-বাজিতপুরের আওয়ামী নেতৃবৃন্দের কাছে তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত। মনোনয়ন প্রত্যাশায় বিভক্ত নিকলী-বাজিতপুর আওয়ামীলীগের সকল দূর্গেই তিনি সমান সমাদৃত। ব্যক্তিক প্রচারবিমুখ কিন্তু স্বচ্ছ, অভিজ্ঞ প্রার্থী হিসাবে বিচক্ষণ শেখ হাসিনার “নৌকা” শেখ নুরন্নবী বাদল পেতে পারেন বলে তার বিশাল সমর্থকগোষ্ঠির দাবি। শেষ মুহূর্তে কোন হিসাবে, কার ভাগ্যে জুটছে “নৌকা” সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে দুই উপজেলার মানুষ।

Similar Posts

error: Content is protected !!