“সেলে আমার সামনেই কবর খোঁড়া হয়েছিল”

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে কেমন ছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান? এমনিতে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে ১৪ বছর কারাগারেই কাটিয়েছিলেন শেখ মুজিব। কিন্ত ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পাশাপাশি তাঁর গ্রেপ্তার হওয়া ছিল চূড়ান্ত শঙ্কার।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর সেলের পাশে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কবর খোঁড়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাপ্নিক সংগ্রামে হিমালয়ের মত অটল। আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে লন্ডন এবং ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ঢাকায় ফিরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের জমায়েতে তিনি তাঁর গ্রেপ্তার, বন্দীদশা এবং মুক্তির কিছুটা বর্ণনা দেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার ঘটনার খানিকটা বর্ণনা তাঁর ভাষণে আছে। শেখ মুজিব ইচ্ছে করলে আওয়ামী লীগের অন্য অনেক নেতার মত আত্মগোপনে যেতে পারতেন। যাননি; কারণ তিনি জানতেন, তাঁকে না পেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রেপ্তার বিষয়ে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার আগে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। তাজউদ্দিন এবং আমার অন্যান্য সহকর্মীরা তখন কাঁদতে শুরু করেন।

পাকিস্তানে আটকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নামে একটি মামলা করা হয়। সে মামলার রায়ে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর সামনেই তাঁর সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল!

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু একবারের জন্যও ভয় পাননি। ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেছেন, আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।

তিনি ভাষণে আরও বলেন, ইয়াহিয়া খাঁর কারাগারে আমি প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হল, তা কল্পনারও অতীত। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীদশায় থেকে আমি জানতাম, তারা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তাদের কাছে আমার অনুরোধ ছিল, আমার মরদেহ যেন তারা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, বাংলার পবিত্র মাটি যেন আমি পাই। আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিলাম, তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে বাংলার মানুষদের মাথা নিচু করব না।

আন্তর্জাতিক চাপে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করতে। বঙ্গবন্ধু যেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকেও বাংলার মানুষের মনোভাব বুঝতে পারতেন। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, দেশে না ফেরা পর্যন্ত তিনি কিছু বলবেন না।

এ বিষয়ে তিনি ভাষণে বলেছিলেন, পাকিস্তানি কারাগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই, তখন ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, সম্ভব হলে আমি যেন দুই দেশের মধ্যে একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। এখন আমি বলতে চাই, ভুট্টো সাহেব আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে।

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি নিজ দেশে এসে পৌঁছান। তবে এর আগের ভ্রমণও কম উত্তেজনাকর ছিল না। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লন্ডনের উদ্দেশে একটি চার্টার্ড বিমানে উঠিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানকে বিদায় জানিয়ে ভুট্টো এক অদ্ভুত মন্তব্য করেছিলেন যে- পাখি উড়ে গেছে।

১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে আরও জানান, ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, তারা যেন তাঁকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি তার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব।

সূত্র : ঢাকা টাইমস, ১০ জানুয়ারি ২০১৯

Similar Posts

error: Content is protected !!