শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।
হাওরের সংস্কৃতি মানে নাট্য সাহিত্যের এক নিলক্ষা সম্পদ। “মৈমনসিংহ গীতিকা”ও আমাদের হাওর সংস্কৃতি থেকে সংগৃহীত। তার স্বাদ ও ভাষা সম্পর্কে সবাই অবগত।
মৈমনসিংহ গীতিকায় মহুয়া, মালুয়া, চন্দ্রাবতী এমন নারী চরিত্রই প্রধান। সম্ভাব্য তখন নারী জীবন থেকেই এমন চরিত্রের সৃষ্ট। তাহলে তখনকার সমাজ ব্যবস্থা এমন ছিল? এ বিষয়ে আমার মন্তব্য অপেক্ষমান পর্বে।
নারীর স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছি হাওর সংস্কৃতির মধ্যে। মেয়েলী গীত সম্পর্কে তো শুনেছেন? শুনেছেন চাঁদের রাতে মেয়েদের কিছু খেলার কথা?
আমাদের বাংলা নাটকের বয়স যে হাজার বছরের তার একটি উপমা খুঁজে পাব এ ধরনের খেলা থেকে।
চাঁদের রাতে পাঁচ থেকে ছয়জন মেয়ে একত্রে বসে গুটি লুকানোর খেলা এখন শুধু ইতিহাস হয়ে আছে। এমন খেলার কথা নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত “আবের পাঙ্খা লইয়া” বইয়ের “জুজুবুড়ি” নাটকেও উল্লেখ আছে। যেমনঃ
উক্কুনি মায়া বুক্কুনি
সারকপাইল্লা বাগুনি
সারে আয়ে নুরে যা
কছেন রে কাউয়া
ডাক্কে ডুক্কে
কাট্টে কডি ফাওয়া যা।।
এ ধরনের মেয়েলীপনা খেলামাত্র চাঁদের আলো বিদ্যমান এমন রাতেই লক্ষ করা যায়। মাঝে মাঝে সমবয়সী ছেলেরাও এসে যোগ দিত মেয়েদের খেলায়।
প্রবীণ যারা আছেন, তারা হয়তো দেখে থাকবেন- চার/পাঁচজন মেয়ে একত্রে বসে তাদের দু’ হাতের দশ আংগুলী মেলে মাটিতে রাখত এবং একজন প্রধান হয়ে ছড়া কাটত।
যেমনঃ
চুট্টু চুট্টু বাতারি
বইশ মারে তেতারি
বইশের তেলে
সারা বাতি জ্বলে
জলৌক বাতি
পরোক তেল
কাঙ্কে কলসী পাক্কা বেল।
এ বেল শব্দটি যার আংগুলীর মধ্যে পরত সে পেত এক পয়েন্ট। আর এটা আজকের কথা নয়। শতাব্দী থেকে শতাব্দীর পর চলে এসেছে এ খেলা। এ খেলায় যে চোর-সাধুর খেলা হতো, এখানে আমরা নাটকিয়তা খুঁজে পাই।
“চৈতালি ভাংগন খেলা”
এ খেলা চৈত্র মাসের প্রথম দিনে হাওরপাড়ের মেয়েরা রাতের প্রথম প্রহরে শুরু করে এ খেলা, যখন চাঁদের আলো থাকে। এ চৈতালী ভাঙ্গন খেলা চলে চৈত্র মাসের ১৩ দিন পর্যন্ত। অর্থাৎ একটানা তের দিন।
হাওরপাড়ের মেয়েরা নদী থেকে এঁটেল মাটি সংগ্রহ করে এবং বিশেষ এ এঁটেল মাটির সাথে বিভিন্ন ফুলের পাঁপর মিশ্রণ করে আইলের মতো করে ঘর তৈরি করতো। এ ঘর তৈরি করা শেষ হতো চৈত্র মাসের তেরোতম দিনে- যে দিন জ্যোৎস্না রাত থাকত। খেলার শেষ দিন ছোট-বড় সবাই উপস্থিত হত।
কোন ঘরটা কার তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা হত। আর ওই ঘর খেলার ছলে বিয়ের বয়সি ছেলেরা ভেংগে ফেলত। মজার ব্যাপার হলো, যে ছেলে যে মেয়ের ঘর ভাংত- তার সাথে ওই মেয়ের বিয়ে হবে বলে ধরে নিত। আর এখান থেকে শুরু হতো প্রেম, তারপর বিয়ে।
কোনো কোনো অভিভাবক এমন বিয়ে মেনে নিত না। এমনই একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হাওর গবেষক (অপ্রকাশিত) খাইরুল আলম বাদল রচিত গানে।
চৈতের চাঁদনি রাতে চৈতালী সাজ সাজেগে গাঁয়ে…..
গিমাই শাক তুলতে গিয়ে দলে দলে….
এ খুশি রয় যে চির মনরে,
এ খুশি থাকবে চিরদিন ও মনরে..
তবে যাই করতো এটা কিন্তু খেলা। আর এ খেলা করতো শুধুমাত্র বৃষ্টির জন্য।