হাওরপাড়ের সংস্কৃতির মধ্যে লোকছড়া একটি অনন্য হাওরসাহিত্য। অজ্ঞাত ব্যক্তি রচয়িতাদের মৌখিক সৃষ্টি তাই লোকছড়া। প্রাচীন যুগে “ছড়া” সাহিত্যের মর্যাদা না পেলেও বর্তমানে এর প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও এখনও অনেকেই ছড়াসাহিত্যকে শিশুসাহিত্যেরই একটি শাখা মনে করেন। কিংবা সাহিত্যের মূলধারায় ছড়াকে স্বীকৃতি দিতে চান না। কেউ কেউ ছড়াকে কবিতা বলার পাশাপাশি আধুনিক গদ্যকবিতার যুগে এসব মিলযুক্ত কবিতা (অন্ত্যমিল) বা পদ্যের অবস্থানকে হালকা করে দেখেন। তবে পদ্য (কবিতা) এবং ছড়ার মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে- পদ্যের বক্তব্য সহজবোধ্য ও স্পষ্ট হলেও কিন্তু ছড়ায় রহস্যময়তা থাকে।[১]
ছড়ার রয়েছে প্রায় দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উৎকর্ষ আমাদের বারবার চোখে পড়ছে। আদিতে সাহিত্য রচিত হতো মুখে মুখে এবং ছড়াই ছিল সাহিত্যের প্রথম শাখা বা সৃষ্টি। সাহিত্য লেখ্যরূপে পাওয়ার পূর্বে ছড়ায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতো। লোকসমাজে ছড়াই ছিল ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম। গদ্যসাহিত্যের আগে তাই কেউ কেউ ছড়াকে লৌকিক সাহিত্য বলে বিবেচিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন— ‘ছড়া শিশুদের খেলামেলার কাব্য’। আধুনিক সাহিত্যিকগণ এসব অভিধান মানতে নারাজ। তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— ছড়া সাহিত্যের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও নাটকের মতো একটি প্রয়োজনীয় শাখা। এই শাখাটি অন্যান্য শাখার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতা সহজেই ধরা পড়ে।[১]
বাংলাসাহিত্যের আদিসৃষ্টি বা নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়ার মূলছন্দ স্বরবৃত্তে লেখা এবং এটি ছন্দ-মিলে রচিত। এই পদটি বাংলাসাহিত্যের আদিছড়া বললেও ভুল হবে না। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন এবং গ্রন্থটির নাম দেন ‘খুকুমণির ছড়া’। এই গ্রন্থটির ভূমিকায় সর্বপ্রথম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়া সংকলিত করে ছড়ার গ্রহণযোগ্যতাকে মজবুত করেন। ছড়া প্রসঙ্গে কবিগুরু বলেছেন, “সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আওড়েছেন এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।” একসময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশুসাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলাসাহিত্যে ছড়া তার নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।[১]
আজ এমন কিছু লোক ছড়া নিয়ে আলোচনা করব। নিচে আমার সংগৃহীত কিছু লোক ছাড়া তুলে ধরা হলো।
বাবুদের লোকছড়া
১. ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি যাইও
চাল কলাই ভাজা দেব যত পার খাইও।
দাঁত না থাকলে গড়িয়ে দেবো কষ্ট নাহি পাও
সকল খাবার এনে দেব যতো তুমি চাও
বাটা ভরা পান দেবো গাল ভরে খাইও
যত ছেলের চোখের ঘুম খকীর চখে দিও।
২. হাবুত হুবুত গোসল করে আমার জাদু মণি
হাত নাড়াইয়া পাও নাড়াইয়া কতই টানাটুনি।
গোসল করে হাইস্যা
পানির উপরে ভাইস্যা
ব্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গমি কাইনদা মরে
খোকনের গোসল দেইখ্যা
৩. ছড়া
খোকন আমার নয়নমণি ঝলমল করে
পাঁচ কিসের পানি দিয়া খোকন গোসল করে
আমার খোকন গোসল করে পানকৌড়ির ছা
আয়রে আয় সূর্য মামা একটু দেইখ্যা যা।
হেলার লোকছড়া
৪. যেই না জাগায় মাছের ঘর,
হেইখানে বরশি পড়।
ধর ধর ধামাইল্যা
টাইন্যা তুলবাম সামাইল্যা,
সিঙে ধর মাগুরে ধর,
কই লইয়্যা উড়া কর।
আমার বরশি হবরি কলা
টক্কত দিয়া গিল্লা ফালা।
৫. আমার বরশি বাইন্যা
মাছ ধর টাইন্যা।
৬. আমার হাতে কি?
জলই।
এক ডুবে তলই,
তরে যদি পাই
এক গেরাসে খাই।
৭. বিলাই মেও
টাইন্যা নেও,
এলহা ঘরে থাকতাম না
বৌ আইন্যা দেও।
৮. উতিনা দুতিনা
তিন দিন ধইরা মুতি না
তিন দিনের জ্বরে
মাথা বিষ করে।
৯. ছিছা ছোঁয়া রানী সই
পুলা পাইলে কই।
ধরমে দিছে পুলা,
ফালবাম কই।
১০. হেছকি হেছকি লাডুমা
বৈঠা মারি চাডুমা
বৈঠার তেলে
উডুম বাতি জ্বলে ।
১১. কাউয়া লো কা
তর নাতির ঘরের পুতি অইছে
দেইখ্যা আইতে গা
পাতি কাউয়া নাতি ভাই,
আম ফালা বাড়িত যাই।
নাতির ঠোঁট বাঁক্কা,
আম ফালা পাক্কা।
নাতি কালা কিচ কিচ,
তাড়াতাড়ি আম দিস।
আম না দিলে খাইয়াম কি?
মার আত (হাত) দিবাম কি?
১২. নাও দৌড়ানি
বুক দৌড়ানি
মিনার লাগি
বিস্কুট আনি
১৩. মা লনা কোলে
বাপে লনা কোলে
উষ্ঠা দে ফালাই দে
নাপিত কোলে
১৪. ল্যাংটা ভুতুরি কলাই চুতিরী
জামবুরার নাও আয়ছে
আংগা বইবে নি।
১৫. (ছড়া)
গিরস্থ ভাই গিরস্থ ভাই,
দিতা আগুন বানাইতো দা
কাটতো ঘাস খাইতো গাভী
দিতো দুধু খাইতো কুতু (কুকুর)
অইতো মোটা মারতো মইষ ।
ভাংতো সিংগা, তুলতো মাডি,
বানাইতো ঘডি, তুলতাম হানি (পানি)
ধুইতাম ঠোঁট, তবে খাইতাম চড়ুইর বুক।
১৬. মাস্টর মাস্টর এগার
ফালদে পড়ে পাগার
পাগার গেছে শুকাইয়া
মাস্টর গেছে ছিগাইয়া
১৭. আমার একটা কথা আছে
কি কথা?
বেঙের মাথা
কি বেঙ?
সরু বেঙ
কি সরু? বামুন গরু
কি বামুন ?
বট বামুন
কি বট?
ছাও বট
কি ছাও?
গু খাও।
১৮. তারে নারে বন্ধু রে
কেলা খাইলো ইন্দুরে
কেলার ভিতর আলি নাই
বন্ধুর কথা মনে নাই ।
১৯. আয়রে পুলা পুরি ফুল টুকানিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়া মামার বাড়ি যাই।
যেমনি গেলাম ফুল টুকানিত অমনি হইলো বিয়া,
পরের পুতে নিত আইছে ঢোল বাড়ি দিয়া।
ঢোল বাজে টেনর টেনর শানাই বাজে রইয়া,
চাচী কান্দে মাসি কান্দে অক্কই কাডে বইয়া।
২০. বুল বুইল্যারে ভাই তর পুটকি কেরে লাল,
আল্লাহ তায়ালা কইয়া দিছে হিন্দু মুসলিম ভাই
২১. বাবরী ওয়ালা পুংগির ভাই
টিক্কা জ্বালা তামুক খাই।
আইজ ঘরে তামুক নাই,
খাজনা ফালা বাড়িত যাই।
কান ধইরা ঘুরাইয়া,
খাজনা লইয়াম মুড়াইয়া
২২. আইন্দার পুইন্দার বাত্তি ছাড়া
ওষ্টা খাইবার দশা।
২৩. (জাল্লাদের ডাক কেচকি মাছ মারার সময় )
উত্তর থেকে আইলো মশা
নল্লা ডুগা খাইয়া
মশা কামুড় মারে
চুক্কা বুনি পাইয়া।
ইস —-ইস।
২৪. (কাজে শক্তি পাবার ডাক)
আল্লাহ বল নবী
মার ঠেলা হেঁইও,
আর ও জোরে হেঁইও।
ছবিয়ানা হেঁইও।
তোমার জোরে
আমর জোরে মার ঠেলা হেঁই ও।
সাতাইল পর্বত
লড়েচড়ে মার ঠেলা হেঁই ও।
আরও জোরে হেঁইও।
এইতো লড়ে হেঁইও।
২৫. আবুনীর মা কান্দে গো
আবুনীরে লইয়া
এত সাধে আবুনীরে
কেমনে দিয়াম বিয়া।
আগে যদি জানতাম
যাইবে শেল দিয়া।
তবেত না পালতাম আমি
বুকের দুধ দিয়া।
২৬. ওপেনটি বায়স্কোপ
টাই টুই টায় স্কোপ।
চুল টানা বিবিয়ানা
লাট বাবুর বৈঠকখানা।
লাট বলছে যাইতে
পানসুপারী খাইতে।
পানের আগায় মরিচবাটা
ইস্পীরিংয়ের চাবি আটা।
আমার নাম রেনুবালা
গলায় দিছি মুক্তার মালা।
২৭. আম গাছ তলে ধাপ্পুর দুপ্পুর
কলা গাছ তলে বিয়া
সেজন কুটুম নিতো আইছে
পানের ঢালা লইয়া।
২৮. দোল দোল দোলনি
রাঙা মাথার চিরুনি।
বর আসবে যখনি
নিয়ে যাবে তখনি
২৯. আয় চাঁদ আয় টিপ দিয়ে যা
আয় চাঁদ লইরা
কলা গা ছে ছইড়া
কলা দিমু ছুইল্যা
দুধ দিমু ঢাইল্যা
খোকনের কপালে টিপ দিয়ে যা ।
৩০. ইনটুক বিনটুক কিনটুক ধারা
এবল থাকতে বেবল ভারা
এন খাইবা লাম্বা গেট
৩১.আমরা দুই ভাই বোন
কলের গান গাই
চিটকী গাছে পুটকি তইয়া
হারমনি বাজাই ।
৩২. আবু কেরে কান্দে গো
শশুর বাড়ি যাইতো গো
সাথে একটা কুত্তা দিমু
আগে খবর কইতো।
আম কাঁঠাল ভাইঙ্গা দিবো
পথে বইয়া খাইতো ।
৩৩. সতিনের বাপের বাড়িতে
সাত বান্দী কাডে,
এই গৌরবে বেডি
চিততইয়া আডে ।
৩৪. এইডা কিতা আইতাছে
মডর গাড়ি আইতাছে
মডর গাড়ি খুইল্লা দেহি
বাজান বইয়া লইছে
বাজান গো বাজান
মায়া কিতা করে
তর মার কান্দনে
গাছের পাতা ঝড়ে।
৩৫. গুষ্টি জুইরা কেঁথা নাই,
কুত্তার গতরে লাজাই।
(লাজাই-লেপ)
৩৬. মায়াগো তরে বেচ্ছালাইয়াম
এমন দাম চাইয়াম তরে নিত।
৩৭. আগে গেলে বাঘে খা
পিছে গেলে টেহা পা।
৩৮. আগের আল যে আালে
পিছের আল এই আলে।
আল-হাল
৩৯. চৌকিদারের নীচে চাকরি নাই
জুতার উপরে মাইর নাই
৪০. বিচার নাই দেশে,
পলানি সার।
৪১. বায়ে হতে ডাইনে ভালো
যদি ফিরে চায়
৪২. আমার আবু টুকটুক
দুধ খায় চুকচুক
সব দুধ খাইল
পেট তার ভরল।
৪৩. আইজ্যা ঝাড়া বাইদ্যা ঝাড়া
বিলাই আগে ছেরাভেরা
কুত্তা আগে দই,
এমন ঝাইড়া দিলাম
বাবুর অওরী পুটকি অতি সই।
৪৪. আলু পাতা ঠালুর ঠালু
বিন্না পাতা সই
অগল জামাই খাইতে বইছে,
আমার লেংরা জামাই কই।
৪৫. খুদ কিনতে পয়সা পায় না
বৌ কিনতে চাই
অকর্মার ঢেহি
৪৬. আবুর মা ভালা না
হাইস্যা কথা কয়না
আমরা যদি হতাম হাইস্যা কথা কইতাম
৪৭. বড়ো বাড়ির বড়ো ছেরি
লাম্বা মাথার চুল
আচ্ছা কইরা বানছে খোপা
কানে দিছে ফুল।
৪৮. ঊরি গুডা ঝনঝন
জামাই আয়ে তিনজন,
আদে জামাই খায় না
বিদায় দিলে যায় না।
৪৯. আমার আবু টুকটুক
দুধ খায় চুকচুক
সব দুধ খাইল
পেট তার ভরলো
৫০. গাঙের পাড়ের বাড়ি
অল্প বয়সের দাঁড়ি লাল চামার
নি দাউড়া মুসলমান
তিনো শালা এক সমান।
৫১. বাজিতপুইরা ভাই
পথে পাইলে টানাটানি
বাড়িতে গেলে নাই।
৫২. উতিনা দুতিনা তিনদিন ধইড়া মুতিনা
তিনদিনে জ্বরে মাথা বিষ করে।
৫৩. বাবরি ওলা পুংগির ভাই
টিক্কা জ্বালা তামুক খাই।
৫৪. মায়ের দরদ বুকে
গায়ের দুধ মুখে।
৫৫. বাড়ির শোভা বাগ বাগিচা
ঘরের শোভা উশারা।
দাঁতের শোভা মিশরী মান্জন
চক্ষের শোভা ইশারা।
৫৬. গোয়ালের ঝাড়া
হায় হাত দিলাম তর মুখে
ঘাস খাবি তুই সুখে
সুন্দর বনে ঘাস খাবে
নাইচ্যা নাইচ্যা বাড়িতে আইবে
গেরস্তের ভালোই করবে
লাখ টাকার মালিক হবে।
৫৭. ডুক্কু ডুক্কু এনটেল সোনালী সেন্টেল
জোড়াজুড়ি করলে জুতাদে দেম
৫৮. চি চি এনচি
বউ নিতাম আইছি
বউ নেম কাইড়া
সব দান মাইরা
৫৯. চি চি এলচি
নাইনচস কী
বইছা মাছের তরকারী
৬০. চি কুত কুত তাড়ালি
লাইলা আমার মামানি
মজনু আমার ভাই
টাকা পয়সা নাই
মজনু ভাইয়ের দাড়ি ধইরা
মক্কা শরীফ যায়
সকল পর্ব :
হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২৩