মহিবুর রহিমের কবিতা প্রসঙ্গে
কারার মাহমুদুল হাসান
কবি মহিবুর রহিম । সে সঙ্গে একজন স্বনামধন্য ছড়াকারও বটে। বয়স এখন ৪৩ ছুঁই ছুঁই। সে বিবেচনায় এখনও যুবক। জন্ম ভাটি অঞ্চলের ছাতিরচর গ্রামে, যা আমাদের নিকলী উপজেলার একটি ইউনিয়নও বটে। এ গ্রাম বা ইউনিয়নের অনবদ্য বৈশিষ্ট্য হলো-বর্ষাকালে প্রায় ৪/৫ মাসব্যাপী এটি একটি দ্বীপসদৃশ রূপ ধারণ করে,যার চারদিকে শুধু পানি। ভরাবর্ষায় পানি থৈ থৈ, গ্রামটির পূর্ব উত্তর অংশ জুড়ে একটা ছোট-খাট সমুদ্র। জোয়ানশাহী হাওর নামে পরিচিত। হাওর শব্দটির উদ্ভবও হয়েছে সায়র বা সমুদ্র শব্দ থেকে। সায়র-হায়র-হাওর। হাওরের প্রকৃতির বৈচিত্র্য একটু ভিন্ন ধরনের। মানুষের জীবন-যাত্রা, ঘর-বাড়ি, আচার-অভ্যাস অন্য অঞ্চলের মানুষের মতো নয়। শুকনা মৌসুমে এখানে মাইলের পর মাইল জমিতে বোরো চাষ হয়। বর্ষাকালে বা শীতকালে নদীতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। ছাতিরচর ইউনিয়নের-পশ্চিম পাশে ঘোড়াউত্রা নদীর পশ্চিম পাড়ে গুরই, নিকলী উপজেলা-সংলগ্ন একটি ইউনিয়ন। প্রায় এক দশক আগেও ছাতিরচর গুরই ইউনিয়নের অংশ ছিল।
ছাতিরচরের তিনদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, কৃষক সেথায় বোরোধান,আলু,বাদাম, ক্ষিরা, বেগুন ও সে সঙ্গে বিভিন্ন শাক সবজি ইত্যাদি ফলায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব এবং পাশাপাশি অর্থ-সামাজিক বিভিন্ন জটিল সীমাবদ্ধতা, সে সঙ্গে যথাযথ উদ্যোগ আয়োজনের ঘাটতির কারণে শিক্ষার-প্রসার কাক্সিক্ষত গতিতে সামনে এগুতে পারেনি।
এমন এক আর্থ সামাজিক ও ভৌগোলিক বাতাবরণে কবি ও ছড়া কবিতার অনবদ্য কারিগর স্নেহভাজন মহিবুর রহিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজে বাংলা ভাষার শিক্ষক এবং বিভাগীয় প্রধান এর গুরু দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বলা যায়, প্রায় বিরামহীন ভাবে কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ লিখে চলেছেন। তবে-উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো কবিতা-ছড়া লেখার প্রস্তুতি লগ্নে কবি মহিবুর রহিম বাংলা একাডেমিতে তরুণ লেখক প্রকল্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ গ্রহণ সহ-বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিশেষত প্রবাদ প্রবচন বিষয়ে গবেষণার কাজে ও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। পাশাপাশি তিনি ঘোড়উত্রা, প্রতিভাস, শিলালিপি, বাতায়ন ইত্যাদি ছোট ছোট পত্রিকা-ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপনা জীবনের শুরুর দিকে। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক চলার পথে, দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিদিন, সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ধুমকেতুর উপদেষ্টা সম্পাদক ও সে সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত লিখে চলেছেন-বিভিন্ন কবিতা, ছড়া এবং প্রবন্ধ।
মহিবুর রহিম এর এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই এর সংখ্যা ৮টি এবং আরও ডজন খানেক কবিতার বই-প্রকাশনার পথে রয়েছে। আমি তাঁর তিনটি কবিতার বই পড়েছি, সেগুলি হলো ‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’, ‘হৃদয়ে আমার কোন মন্দা নেই’ ও ‘সবুজ শ্যামল মন’। তাঁর লেখা ছড়া কবিতা-ভাটির দেশে বাড়ি, ঋণ, মেঘের দেশ, বাবার স্মৃতি, ভেজা চোখ ছুঁয়ে আছে নদী এবং পিতৃভূমি, এ কবিতাগুলি বারংবার পড়ি, আনন্দ পাই। কৈশোর জীবনে আমার জম্মভূমি-নিকলীর গ্রাম, গ্রামের মানুষজন, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ভাটিয়ালী ও সে সঙ্গে জারি ও সারিগান, কীর্তন, ষাড়ের লড়াই, কবিগান-যাত্রাপালা ইত্যাদিতে সম্পৃক্ত হয়ে থাকার সে-বাল্য কৈশোর জীবনের স্মৃতি সমৃদ্ধ আমেজ অনুভব করি তাঁর কবিতা পড়ে। কবি মুহিব ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো আধুনিক শিল্প-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ শহরে বাস করলেও স্মৃতি তাকে সবসময় তাড়া করে নিয়ে যায় সে-সনাতন গ্রামে- যে গ্রামের আলো বাতাসে মহিবুর শৈশব, বাল্য ও কৈশোরকাল অতিবাহিত করেছেন। আর এ তিনকাল-লদ্ধ গৌরবের ভান্ডার তিনি উজার করে দিতে উম্মুখ-তার বিভিন্ন কবিতায়-তথা ছড়া কবিতায়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দেশের বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য সাময়িকীতেও লেখালেখির কাজ নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছেন। সে সঙ্গে তার জম্মভূমি অবহেলিত ভাটি অঞ্চল, কুমিল্লা অঞ্চল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চল সহ-বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসাহিত্য বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণাকাজে নিজেকে-গভীরভাবে সম্পৃক্ত করে অভিনিবেশ সহকারে কাজ করে চলেছেন তিনি। তাঁর কবি প্রতিভার উপর মূল্যায়ন তথা মন্তব্য করার সাহস বা সে পাণ্ডিত্য আমার নেই। তবে-মহিবুর রহিম এর ‘শিমুল রোদে রঙিন দিন’ ছড়া কবিতার পান্ডুলিপির উপর বর্তমান বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ নিম্নে বর্ণিত যে মতামত ব্যক্ত করেছেন তার উপর অন্য কিছু যোগ করা ধৃষ্টতার-সামিল হবে মর্মে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস ও অনুভব তরি। তাই মহিবুর রহিমের কবি প্রতিভা ও কবিত্বশক্তির বিষয়ে তাঁর (আল মাহমুদ) কথা-ই শেষ কথা মর্মে আমি মনে করি। কবি আল মাহমুদ উপরিউল্লিখিত ছড়া কবিতা গ্রন্থ (পান্ডুলিপি) বিষয়ে যথার্থই বলেছেন, “কবি মহিবুর রহিমের ছড়া কবিতার এই পাণ্ডুলিপি আমি শুনলাম এবং স্পর্শ করে দেখলাম। এই কবির কবিত্বশক্তি দ্রুত সঞ্চারমান। আমার ধারনা, কবি মহিবুর রহিম এ-কালের ছড়া কবিতায় বিশেষ অবদান রাখবেন। বই প্রকাশিত হলে একজন কবিকে ভালো করে সনাক্ত করা যায়। আমি মহিবুর রহিমকে আগে থেকেই চিনি এবং জানি বলেই সাহস করে বলতে পারি তিনি আমাদের ভবিষ্যতের কবি প্রতিভা। তার রচনা তারুণ্যে উজ্জ্বল, আনন্দে স্বতস্ফূর্ততায় গতিময়। আমি এই কবির সাফল্যের জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকব। আমার ধারণা মহান আল্লাহ্ তার সাহিত্যের গতিময়তাকে নদীর মতো বহমান রাখবেন।”
কবি আল মাহমুদের মতো আমিও কবি মহিবুর রহিম এর কিছু লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, যা না বললেই নয়। যেমন-‘সূর্যের সাত রঙে পাখিদের মন/ মেঘের বাস্পে ভেঁজা পাখিদের চোখ/ পাখিদের ডানাতে যে অনাদির গান/ মন চায় পাখিদের মতো হয়ে যায়।’ দারুণ প্রাঞ্জল লেখা। ‘ভাটির দেশে বাড়ি’ কবিতায় মহিবুর রহিম লিখেছেন-‘ভাটির দেশে বাড়ি আমার/ভাটির দেশে বাড়ি/ যেতে লাগে নৌকা ও লঞ্চ/ লাগে না রেলগাড়ি’ এ সকল কবিতায় অনেক বাস্তবচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। ‘হৃদয়ে আমার কোনো মন্দা নেই’ বইটিতে সমসাময়িক ধারার কবিতায় তার পারঙ্গমতা আমাকেও পরিতৃপ্তি দিয়েছে। একটি ছোট্ট উদ্বৃতি দিলেই হয়তো বুঝা যাবে-‘প্রথমত নদীই আমাকে শিখিয়েছিল গান/ বুকের পাজর খুলে/ একটি বিশাল ছাতিমগাছের ভাষায়/ আমার একাকিত্বের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিল তার ঢেউ’। আমি কবিতা অত বুঝিনা, যারা কবিতার পাঠক তারা ভাল বলতে পারবেন। তবু তার কবিতাগুলোতে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি আমার অবহেলিত ভাটির সন্তান হিসেবে মহিবুর রহিমের সুস্বাস্থ্য সমৃদ্ধ দীর্ঘ কর্মময় জীবন কামনা করি। মহিবুর রহিমের নিরলস প্রয়াস এবং কবি প্রতিভা নিকট ও অদূর ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর পরিসরে বিস্তৃত হবে সে বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে।
গুণমুগ্ধ
কারার মাহমুদুল হাসান
সাবেক সচিব,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
তাং-১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫
কবিতায় সিদ্ধান্ত উচ্চারণের সাহস
প্রফেসর ড. কামরুল আহসান
স্বীকার করে নিচ্ছি,মহিবুর রহিম নব্বই দশকের একজন অন্যতম কবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে দেশের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য সংকলনে লেখালেখি শুরু করেন এবং প্রথম পর্যায়েই কবিতায় শিল্প সাফল্যকে খুঁজে পান। এরপর কবিকে তেমন আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে প্রকাশিত হয় তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ- ‘অতিরিক্ত চোখ’ (২০০২); ‘হে অন্ধ তামস’ (২০০৩); ‘অনাবাদি কবিতা’ (২০০৪); ‘পলিমাটির অন্তর’ (২০০৭)। চন্দ্রাবতী একাডেমি, ঢাকা থেকে এই কবির আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘ দুঃখগুলো অনাদিও বীজপত্র’ বের হয়- ২০১০ এর ফেব্রুয়ারিতে। এই নিয়েই মহিবুর রহিমের দর্পিত উত্থান।
সত্যি বলতে কী, মহিবুর রহিমকে চিনতাম না আমি- না ব্যক্তি, না কবিকে। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূত্রে ওর সঙ্গে যোগাযোগ, আবিষ্কৃত ঐ সঙ্গে মহিবুর রহিমও। নব্বই দশকের কবিতাকর্মে মহিবুর রহিমের বিচরণ, এবং বলছি আমিও ‘সাম্প্রতিক কালের কাব্য কাঠামোয় দক্ষ এই কবি, কবিতায় চর্চা করেন অগ্রগামী ধারণার স্বপ্ন’।
ফেব্রুয়ারি- ২০১০ এ প্রকাশিত মহিবুর রহিমের কাব্যগ্রন্থ ‘দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র’। এ গ্রন্থে ওই স্বপ্ন লালনের বিষয়টি আমরা দেখেছি যথেষ্ট স্পষ্ট রূপেই। ‘সম্ভাবনার উত্তাধিকারী চাষি’ স্বভাবতই আশার ফসল পেতে বিশ্বাসের বীজ যেভাবে বপন করেন ঐখানেই তো কবিকে নতুন স্বপ্নের দ্রষ্টা হিসাবে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। কিংবা কবি যেভাবে বলেন-
“যখন একটা মন একটা প্রশ্রবন নদী হয়ে যায়
ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে হাজার কল্পনা পাখা মেলে
হঠাৎ কখন করতলে জ্বলে ওঠে সম্ভাবনার সূর্য
সময়ের ভাঁজ খুলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে জীবনের তৃষা
প্রাচীন প্রত্নের স্তুপে নেচে ওঠে মায়াময় দ্বীপের ঘুঙ্গুর।”
তখন কবি মহিবুর রহিম প্রত্যাশিত আশার স্বপ্ন দ্রষ্টা তো বটেই, সেই সঙ্গে আধুনিক ভঙ্গিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তর জীবনেকে বিশ্লেষণ করার রূপকার ও বটে। এতদসঙ্গে বলি একথা, ওই কবির জীবন তৃষ্ণা ও চমৎকারিত্বের ভেতর দৃঢ় প্রত্যয় সংলগ্ন। তার স্বকীয় উচ্চারণ লক্ষণীয়-
“ফুল পাখি বৃ নই, অনন্তের স্যা এই মনে
পেতে চাই অনন্তের আলিঙ্গন, তাই বার বার
অনিবার্য ফুল পাখি বৃ প্রেম রক্তে মিশে যায়
একটি জীবনে কোটি জীবনের সংরাগ বয়ে বয়ে যায়।”
আবারও মোড় পরিবর্তন, কবির এক অন্যরকম উপলব্ধি। জীবন তৃষ্ণারই ভিন্ন স্বভাবের রূপাভাস। বরং বলা শ্রেয়, হৃদয় থেকে উত্তরণ জৈবনিক মূল্যবোধে। কবির প্রতি সমাজ কৃত আচরণের ফলকথা স্বরূপ শিল্প ভাবনারই সিদ্ধান্ত বোধ করি-
“ওরা পাথর ছুঁড়ে মারছে একজন কবির প্রতি
নির্দয় আঘাত থেকে ঝরছে জীবনের রোদন
ক্ষত-বিক্ষত কবি সে আঘাত রেখে যাচ্ছেন শিল্পের ক্যানভাসে।”
( ওরা/ দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র )
অথবা, “যে দিন আমার মন প্রথম চেয়েছিল জীবন তৃষিত সত্য
আমার দু’হাত ভরে উঠে এলো মুঠো মুঠো জ্বলন্ত অঙ্গার
আমাকে দাঁড়াতে হতো আগুনের ক্রোধান্দ বাগানে
বুকের গভীরে বিদ্ধ হলো শত সহস্র বিষাদের তীর
রক্তরন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো তীব্র নীল জীবনের জ্বালা।”
( শিল্পচেতনা/ দুঃখগুলো অনাদির বীজপত্র )
শিল্পের ওই ক্যানভাস তো রঞ্জিত থাকে নানা রঙে- অনুভবের, চিত্ত ভাবনার, মস্তিষ্কের রক্তরণেরও। ‘কালের এলিজি’ কবিতায় যেমন-
“সব বিদ্যার দৌড় শেষ বিধ্বংসী যন্ত্রের মতায়
সব নীতি প্রোপাগান্ডা প্রপঞ্চ প্রচার নিয়ামক
এমনকি প্রগতির ইস্পাত ও ঢুকে পড়েছে যন্ত্রের পেটে
ধ্বসে পড়ছে সব মনুমেন্ট, আশার প্রতীক
কোটি কোটি বন্দুকের নল এখন একটা হৃদয়ের দিকে।”
এই দুঃখবোধ, গ্লানি, হতাশা, বিবমিষা তার ‘গুয়ানতানামো’, ‘বাগদাদের প্রতি’ এবং ‘নাভিশ্বাস’ কবিতাতেও উঠে এসেছে। এখানে মানুষ, মানবতা ও মানবিকতার পক্ষে সোচ্ছার দেখি কবিকে। শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন হয়ে ‘আরাফাতের জন্য এলিজি’ তে তারই বিকাশ পরিপূর্ণতর, এবং দ্বিধা নেই আমার মোটেও; স্পষ্ট সিদ্ধান্ত-
“পচাত্তর বছর ধরে রক্তে ভেজা কাফনের ভেতর
তাঁর অপরাজিত জীবন
দুর্মর জীবন তৃষ্ণায় ভরা তাঁর রঞ্জিত পাগড়ি
বাতাসের প্রতিটি অণুতে তাঁর চুম্বনের স্পর্শ
কাঁদো ফিলিস্তিন…..
কাঁদো মানুষের সংগ্রামী সন্ততি………”
বৃহত্তর ও মহত্তর জীবনবোধের এরূপ সিদ্ধান্তের ভেতরই কবির সার্থকতা। মহিবুর রহিমের কাব্যচেতনার মর্মমূলে এই বোধের প্রখরতা শিকড় অবধি বিস্তৃত। কাব্য চেতনার স্পর্ধিত স্ফুলিঙ্গ ঝরে তার অনেক কাব্য বচনে। যেমন-
১. কাল সারারাত দুঃখগুলো কেঁদেছিলো শার্শিতে ও গ্রিলে
কাঁচের গলিত রঙে লেপ্টে ছিলো অজস্র আকাঙ্ক্ষা
যেন রক্ত ঝরেছিলো অদম্য বৃষ্টির সাথে……..
২. শুধু এই স্বপ্নগুলো আমাকে বানায় মহীরূহ
নীরব সত্যের নিচে ত নিয়ে দুঃখ নিয়ে বুকে
আরও কিছু অসম্ভব বাসনার কণ্টকিত সুখে
আমিও আকাশ হই, আকাশের সহ্যশীল ব্যুহ
৩. যারা আমাকে নিঃসঙ্গ ভাবে তারা জানে না কী সেই উত্তরাধিকার
তারা জানে না রক্তকে সঞ্চালিত করে কোটি কোটি প্রতিশ্রুতির ভার
৪. বিশ্বাস হচ্ছে একটি অফুরন্ত প্রেমের কবিতা
মারণাস্ত্র কখনোই সম্ভাবনা প্রসব করে না
সভ্যতাকে আজ মনে হয় এক ক্ষুধার্ত ড্রাকুলা
দু’হাতে সে ধরিয়ে দেয় নিরর্থক শূণ্যতা।
সম্ভবত সে কারণেই কবি সমুদ্রগুপ্ত লিখেছেন ‘ মহিবুর রহিমের কবিতার সিদ্ধান্ত অনেকটা এ রকোম। কবিতায় সিদ্ধান্ত উচ্চারণের সাহস তার রয়েছে ’ এবং আল মাহমুদ লিখেছেন ‘কবিতা লেখার জন্য কবিদের যে স্বতন্ত্র অন্তর্দৃষ্টি প্রয়োজন হয় মহিবুর রহিমের তা রয়েছে। এ তার কবিতা পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করে যাওয়ার যোগ্যতা রাখে। বিশেষ করে তার শব্দ ব্যবহারের প্রতি নিষ্ঠা, কল্পনা ও নিজস্ব পদবিন্যাস আমাকে আনন্দিত করেছে।’ প্রথম পাঠেই মহিবুর রহিমকে আমি এমনই নিজস্বতা ও শক্তিমত্তায় সনাক্ত করেছি।
পরিশেষে আরও একটা কথা। এ কবির কাব্য-ভাষা লীলায়িত ভঙ্গিমায় উছলে পড়ে, দীপ্তি ছড়ায় এক প্রকারের নিজস্ব লাবণ্যময়তায়। এটাই পাঠক হিসাবে আমাদের বাড়তি পাওনা। মহিবুর রহিম অকুন্ঠ চিত্তে লিখে যাক, এটাই আমাদের কামনা।
প্রফেসর ড. কামরুল আহসান
প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
হে অন্ধ তামস এর কবি মহিবুর রহিম
মিলি চৌধুরী
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নব্বইয়ের প্রতিভাবান কবি মহিবুর রহিমের কাব্যগ্রন্থ- ‘হে অন্ধ তামস।’ তমসাচ্ছন্ন সময়ের মুখোমুখি কবি স্বপ্ন দেখেন অন্ধ তামসকে অতিক্রম কর সম্ভাবনাময় আলোক বিন্দুকে ছুঁতে। রহস্য, সৌন্দর্য, নান্দনিক দৃষ্টিলোকের মাঝে খুঁজে ফেরে কবি না দেখা, না বলা অজানা আলাপন। আর তাই, কবিতার শরীরের শব্দ চয়নের তীক্ষ্মতায় কবি ফুঠিয়ে তুলতে চান জীবনের অপার রহস্যকে। ছোট বড় আটত্রিশটি কবিতার সমাহার এই কাব্যগ্রন্থে। চিন্তা চেতনার মাঝে নতুনত্ব আর স্বতন্ত্র নাম নির্বাচনে এর প্রতিটি কবিতাই হয়ে উঠেছে মনোগ্রাহী। প্রথম কবিতা স্বস্তির উচ্চারণ এ মহান স্রষ্টার রহস্যলোকে কবি বিচরণ করার প্রয়াস করেছেন বারবার। খুঁজে পেতে চেয়েছেন সৃষ্টির অজানা রহস্যকে। পবিত্র কোরআনের আয়াতের সুনিপুণ ব্যবহার কবিতাটিকে করেছে সুষমামণ্ডিতঃ
গ্রহান্তরে ঘুরে মস্তি ক্লান্তির ফেনা জমে
কুন ফায়াকুন থেকে কিয়ামত অবধি
চিরস্ব মুক্তির সবুজাভ হৃদয়ের ফুলে
স্বস্তির নিজস্ব উচ্চারণ এক ফোটা অশ্রুর নীর
ইন্নালাহা আলা কুলি শাঈইন কাদীর
প্রচ্ছদের নামের নাম কবিতা ‘হে অন্ধ তামস’। কবিতার চিন্তা-চেতনা ও মননের দৃষ্টিভঙ্গি মনে হয় কিছুটা আলাদা। মাটির কাছাকাছি না থেকেও মাটিকে গভীরভাবে অনুভবে রাখেন। হে অন্ধ তামস কবিতার মাঝে বলতে চেয়েছেন অন্ধ তামসায় ঢাকা একটি সময়কে অতিক্রম করার কথা। প্রদীপের নীচে যে অন্ধকার সে অন্ধকার যেন অজানা অনেক কথা শোনায়। এ কাব্যের প্রায় সব কবিতাই বর্ণ বিন্যাস ও ভাষার সাবলীলতায় প্রশংসার দাবী রাখে। একেকটি কবিতা যেন একেকটি দীর্ঘকালের ইতিহাসলিপি। কবির একটি কবিতা না বলা কথা। কবি বিশ্বাস করেন মজা নদীর বুকে চর পড়ে গেলেও একদিন না একদিন সে পলি সজীব হবেই কোন অমৃত ধারা জলে। এ প্রত্যয় তাকে নিয়ে যায় অনেক গভীরে।
যে নদী মরে গেছে তার কাছে আমার রয়েছে দেনা।
আমি করজোড় প্রার্থনার ভঙ্গিতে
দাঁড়িয়ে থাকি অনন্তকাল
……………………..
সময় সীমাবদ্ধতা ভুলুণ্ঠিত করে এক দীর্ঘ অপেক্ষায়
বীজ আমি বপন করেছি
এই মজা নদীর তীরে
কবে উঠবে জেগে এই মৃত চৈতন্যের নদী?
মহিবুর রহিমের কবিতার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা অন্তর্তাগিত থেকে উদ্ভুত। এ কারণেই তার কবিতা অন্তরকে স্পর্শ করে। রবীন্দ্রনাথের মনোভাব কবিতার গভীরে নীরব এক দুঃখবোধ প্রবাহিত হয়।
হে আমার আগুনে পোড়ানো স্বপ্ন
কি উপশম চাও তুমি গোলাপের সুন্দরের কাছে?
কি আশ্বাস পেতে চাও ক্লোরোফিল সবুজের কাছে?
কী সাবলীল কথার বিন্যাস? স্বপ্ন মানুষকে পথ দেখায় জানি, কিন্তু আগুনে পোড়ানো স্বপ্ন মানুষকে কী দেখায়? রহস্য তো এখানেই। কিন্তু প্রেম কবিতায় ভিন্ন অনুষঙ্গ আমাদের মনকে নাড়া দেয়। আদি ও অনন্ত প্রেমের খেলায় কবি যেন লুকোচুরি খেলেছেন নিজের সাথেই। নশ্বরতার মধ্যে অস্তিত্ববান যে প্রেম তার স্বাদ গ্রহণে কবির নিয়ত আকাঙ্ক্ষা। কবিতায় সে কথাটাই উঠে এসেছে।
মৃত্যু ও অমরতার মধ্যে নির্ভরশীল সাকো হচ্ছে প্রেম।
সংকুল উপত্যকায় একমাত্র বরাভয় হচ্ছে প্রেম যদিও প্রেমে সংশয় আছে
অসম্ভব রক্তরণের মতো দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে।
সময়ের দুই পাঠ নামক কবিতায় সময় যেন সময়ের কাছে বাঁধা। সময়ই নিয়ামক, সময় মহাসত্য, চিরসত্য, এবং বহমান। এ সত্যই এ কবিতার মূল সুর।
সময় আসে না কিবা যায় না
দূরুহ আতর্বে ঘুরে। কাল থেকে কালে
গড়ায় জন্মের বিধি শিল্পের অনুরাগে
অনশ্বর পাটাতনে ঝড়ের ঝাপটা এসে লাগে
এতো নয় সময়ের গতি
মানুষ সত্যের নামতা কবিতাটি নামেই এর শব্দ চয়নের মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে। মানুষের অনেক রূপের মাঝে মনুষ্যত্বই আদি ও আসল, সেটাই শ্বাষত সত্য। তাই আদি বাঙালি কবি চন্ডীদাসের মতো মানব সত্যেই মহিবুর রহিম আস্থা স্থাপন করেছেন।
প্রারশ্ব থেকে অন্ত অবধি।
মানুষ সত্যই নিজেকে সমর্পণ করি।
……………………………..
মানুছ ছাড়া কবিতা বুঝি না
প্রতিমা বুঝিনা, তন্ত্র মন্ত্র কিছু না
মানুষকে করেছি সর্বার্থে প্রার্থনার ভাষা
মানুষ শব্দে গড়ে তোলেছি আদিগন্ত আশা
(মানুষ সত্যের নামতা)
এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ আপমদমস্তক এক অন্য রকম রহস্যের জালে ঘেরা। শিল্পের এক নান্দনিক জগত গড়ে তোলেছেন মহিবুর রহিম। এ শিল্পচেতনা জীবনে রহস্যের সম্বন্ধ সূত্রগুলো নিয়ে দারুণভাবে উপস্থিত হয়েছে।
অনেক অর্থের পিপাসায় ফিরে যায় আলোর ফোয়ারা
অকে বিষের ফুলে জেগে থাকে বাসনার চারা
এইসব উপলব্ধির গভীরে
থোকা থোকা চিত্রকল্প নিয়ে
চোখে জেগে থাকে অবিমুষ্য গোয়ার প্রহরে
(রৌদ্রের ফেনা)
অনতিক্রম্য এক উদ্বেগ জমেছে চারপাশে বই খাতা টেবিল সেফল বারান্দা জানালা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের সর্বত্র
বিষধর সর্পের মতো ছোবলের নীল নিষ মুখে নিয়ে
বেষ্ঠন করে আছে বির্বণ উৎকণ্ঠা
(অলঙ্গনীয় উদ্বেগ)
একফোটা অমল যন্ত্রণা কবিতায় অজানা, অদেখা এমন এক যন্ত্রণা যা অমল বৃষ্টির জলে স্নাত হয় না, মুছে যায় না, শুধুই নীরবে পুড়িয়ে, কুচ্যুত মন মধ্যরাতে ক্ষ্যাপা পাখর খোঁজার মতো যন্ত্রণার কারণগুলো খুঁজতে থাকে, আর সুখ দুঃখবোধ অনন্ত আকাশ কেবলই রক্তাক্ত হয় অমল অমোঘ যন্ত্রণায়।
মুক্তিব্রহী সৈনিকের জন্য কবিতায় দেশের সূর্য সন্তানদের আহুতিতে অভিবাদন জানাচ্ছে এদেশের চিরচেনা ঘাস, মাটি, ফুল। সন্তানহারা মায়ের বুকের হাহাকার ঢেকে যায় সন্তানেরা আহুতির গৌরবে। বাংলার পথে প্রান্তরে সৈনিকের ত্যাগের জয়গান ধ্বণিত হচ্ছে এ কবিতায় নিপুণ শব্দ গাঁথা কবিতাটিকে করেছে মর্মস্পর্শী ও অসাধারণ। এ গ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতা বিভিন্ন জনকে উৎসর্গীকৃত। যেমন: সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ কে নিবেদিত কবিতা, রাত গভীর হয়, মৃত্তিকার গান, বন্দরের প্রতীক্ষা। এ গ্রন্থের সবগুলো কবিতা এক মনে পড়া যায় কারণ এর সহজবোধ্যতা ও ভাষায় সহজ দাবলীলতা এবং বলে যাবার ভঙ্গি নরম আকর্ষণীয় ও নিটোল। ঘোড়াউত্রা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘হে অন্ধ তামস’ কাব্যগ্রন্থটি সকলের সংগ্রহে রাখার মতো। এর প্রচ্ছদ একেছেন মুর্শিদ-উল-আলম। আমরা কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি এবং সুন্দর গ্রন্থটি উপহার দেয়ার জন্যে কবিকে ধন্যবাদ।
সে-ই কবি: ‘অতিরিক্ত চোখ’ যার
মানবর্দ্ধন পাল
শিল্পী মাত্রই স্রষ্টা। আর যিনি স্রষ্টা তিনি স্বয়ম্ভু ঈশ্বরেরই প্রতিভূ। কবিতা এক অনন্য সৃষ্টি বলে এর স্রষ্টা কবিও দ্বিতীয় ঈশ্বর। শিল্প স্রষ্টার যে মনোভূমি কবির যে অন্তর্লোক কাব্যবীজ রোপণের আধার কিংবা যে অন্তর্গত উৎসভূমি কবিতা কুসুমের স্ফুটন কেন্দ্র তা দুর্জ্ঞেয় এবং রহস্যময় যেমন পাঠকের কাছে তেমনি বোধকরি স্বয়ং কবির কাছেও। কবিতার ডিম্বানু যে দুর্জ্ঞেয় জনন কোষেই নিষিক্ত হোক, এর জন্মরহস্য যতই হোক অনাবিষ্কৃত রহস্যের আধার একথা সত্য যে, প্রকৃত কবির থাকে তৃতীয় নয়ন। এই অতীন্দ্রিয় তৃতীয় নয়ন দিয়েই একজন কবি আনুবীণিক পর্যবেণ করেন জীবন ও জগত। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এই পর্যবেক্ষণশীলতায় একজন প্রকৃত সৃষ্টিশীল কবির অনুভব প্রতিভাসিত হয় শব্দশিল্পে। আর কবিতা নামক শব্দশিল্প কেবল অনুভবের কেলাসিত রূপ নয়, তার সঙ্গে মণিকাঞ্চনের মত যুক্ত থাকে ছন্দ ও বাণীর আলকেমি।
যার তৃতীয় নয়ন নেই তিনি আর যা-ই হোন অন্তত কবি নন। এই তৃতীয় নয়নধারী একজন, যার নাম মহিবুর রহিম, কবি এবং আমুণ্ডুনখাগ্র কবিই তিনি। কবিতাই তার ধ্যান-জ্ঞান, আজন্ম কবিতাঅন্তপ্রাণ এবং ফলবান সবুজ মানুষ। কবির স্বকৃত স্বীকৃতি :
‘একদা কবিতাকে ভালবেসে নিয়েছি দুর্নাম
অঢেল, নিঃসঙ্কোচে। কবিতা কবিতা বলে সবুজের আলপথে
রক্ত দিয়ে লিখেছি ঠিকানা। শস্যের শয্যায় শুয়ে
কবিতার আলিঙ্গনে পেয়েছি স্বর্গের ঠিকানা।’
(ভয়ের বীভৎস মুখ)
আর ‘সবুজ’ অভিধাটি প্রযোজ্য হয়েছে কেবল ক্রমাগত প্রাণশীলভাবে বেড়ে ওঠার কারণে নয়; ক্লোরোফিলগুলো কবি তার হাতের তালুতে তুলে রেখেছেন বলে (প্রতীক্ষা)।
একজন কবির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের অনিবার্যতা, তৃতীয় নয়নের আবশ্যকতা মহিবুর রহিম কবিতা রচনার শৈশবকালে অবিসংবাদিতভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘অতিরিক্ত চোখ’। কাব্যগন্থের এই শিরোনামই প্রতিপন্ন করে কবি মহিবুর রহিম তৃতীয় নয়নের অনুসন্ধানী কেবল নন; তা তিনি খুঁজেও পেয়েছেন। কবির ভাষায়:
‘অর্থবহ কিছুু নয়, আছে দুটি অতিরিক্ত চোখ
তার নীল অপটিকে ছলকায় কবির দ্যুলোক।’
(অতিরিক্ত চোখ)
কবি মহিবুর রহিমের ‘অতিরিক্ত চোখ’ এর দুই মলাটে বন্দী করা হয়েছে একচলিশটি কবিতা। এর কালিক প্রোপট নব্বই দশক কিন্তু স্থানিক পরিমণ্ডল কেবল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নয়-সীমিত অর্থে আন্তর্জাতিকও। কারণ বইটিতে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যনিষ্ঠ কবিতা যেমন আছে তেমনি আছে ‘শেক্সপীয়রের ব্রিজ’ এবং ‘বসনিয়া’র মত কবিতা, যা উৎসর্গ করা হয়েছে মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী ওবেইদ জায়গীরদারকে। তাঁর ‘স্বাধীনতা’ কবিতায় ল করা যায় স্বদেশে ঘণায়মান দুর্যোগের অশনিসংকেত। অত্যন্ত রাজনীতি-সচেতন কবির মত তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন স্বাধীনতাকে ‘হে স্বাধীনতা তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?’ আবার ‘তিরিশ বছর পর’ কবিতায় কবি নিজের ভয়শূন্য চিত্তকে তুলনা করেছেন পৃথিবীর প্রথম গ্রিক দাস-বিদ্রোহী নমস্য স্পার্টাকাসের সঙ্গে।
‘অতিরিক্ত চোখ’ এ অধিকাংশই মুক্তক ছন্দের গদ্যকবিতা। তবে বেশ কয়েকটি সনেট এবং দু’একটি স্বরবৃত্ত ও অসমপর্বিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতাও আছে। গ্রন্থবদ্ধ কবিতাগুলো বিষয়ের দিক থেকে কোন নির্দিষ্ট ছাঁচে-ঢালা নয়। গ্রন্থিত কবিতাগুলোর সূত্রধরে কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্যের কংক্রিট-বোধ আত্মস্থ করতে চাওয়া বোধকরি সুদূর পরাহত। কারণ কবি কোন মতবাদের দাস নন; মতাদর্শের অনুসারীও নন। বয়ঃসন্ধি থেকে উত্তর তিরিশ পর্যন্ত যাপিত জীবনের দুঃখবোধ, বিপর্যস্ত কালের জটিলতা এবং আধির জঙ্গমতাকেই তিনি কাব্যরূপ দিতে চেয়েছেন। অপরদিকে জীবনের দীনতা, অপ্রাপ্তির বেদনা-সঞ্জাত হতাশা এবং মৃত্যুচিন্তা মহিবুর রহিমের কবিতায় বিধৃত হলেও তা যেন শেষ কথা নয়। তার ‘সূর্যকরোজ্জল’ কবিতাটি এই হতাশা বিদীর্ণ জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সাক্ষ্যবাহী। মহিবুর রহিমের কোন কোন কবিতায় আছে শৈশব-বিলাসী নষ্টালজিয়া (রীতির পাথর ভেঙ্গে, ভয়ের বীভৎস্য মুখ, তিরিশ বছর পর প্রভৃতি)। কোথাও আছে অবয়ী জীবনের শব্দস্কেচ (স্মৃতিচিহ্ন)। তবে বেশ কিছু কবিতায় বিচূর্ণীভবন ও বিলয় যজ্ঞের পরেও আছে জীবন-সমাজ-সভ্যতার জয়গান এবং মানব ইতিহাস পুনরুজ্জীবনের আশাবাদ। অবশেষে আত্মকেন্দ্রিক অতীতচারিতায়ও মহিবুর রহিম নিমগ্ন থাকেননি; স্বদেশসহ বিশ্বব্যাপী মুনষ্যত্বের অপমান, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সম্পর্কেও তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং উদ্বেগাকুল। বিস্ফোরণোম্মুখ বর্তমান, বারুদ-ঝাঁঝালো বিশ্বপরিস্থিতি, জলে-স্থলে যুদ্ধ বিলাসী সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ইত্যাকার সভ্যতাবিরোধী অপকর্ম সম্পর্কেও কবি নিরাসক্ত নন। কবিতার কোমল পেলব অনুভবে হলেও ‘খৃষ্টপ্রেমী শৃগাল ও শুকুন’কে তিনি ঠিকই শনাক্ত করেছেন। দেখেছেন তিনি ‘অত্যাধুনিক আনবিক কভারে মোড়ানো শান্তি’ এবং ‘এই শান্তির বিষাক্ত ক্যাপসুল খেয়ে আত্মাহত্যা করে মানবতা।’
দৈশিক ও বৈশ্বিক নৈরাজ্য, হতাশা, যুদ্ধোন্মত্ততা এবং আত্মাঘাতী জীবনই তাঁর কবিতার মূল বিষয় আশয় নয়; যদিও এসব অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় খুবই সহজলভ্য। তবে কবিতার অন্তর্লোকে আশাবাদের ফল্গুধারা এবং জীবনের সদর্থক ব্যঞ্জণাও তিনি রূপায়ণ করেছেন সচেতনতার সঙ্গেই। তাই লক্ষ্য করি:
‘অনন্তের আলো থেকে লক্ষ কোটি ফুলের স্বপ্ন ঝরবেই
মাটির মমতা থেকে গুল্মের জীবন চোখ মেলবেই
বাতাসের পাখনায় চেতনার বিপ্লবীরা আসবেই
আমাকে অন্ধকারে শৃঙ্খলিত করে রাখা যাবে
কিন্তু অনন্ত আমার রক্তে বিপ্লব পল্লবিত হবেই।’
(অনন্ত আমার রক্তে)
বাংলা সাহিত্যে তিরিশোত্তর কালের কবিরা কিংবা ষাট দশকের বাংলাদেশের কবিরা যে বেদনাদীর্ণ দুঃখবোধে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়েছিলেন এবং কাব্যবীজ সংগ্রহের জন্য পরজীবীর মত পাশ্চাত্য দর্শনে নিমগ্ন হয়েছিলেন তার অনেকাংশেই ছিল ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের বিমুখ প্রান্তরের দীর্ণতাদগ্ধ দুঃখবাদে আক্রান্ত। আমার বিশ্বাস, মহিবুর রহিমের কবিতায় অনেকটা তারই অনুকৃতি লক্ষ্য করা যায়।
সৃষ্টিশীলতার সূচনাপর্বে নিজস্ব কণ্ঠস্বর অন্বেষণ করতে গিয়ে অগ্রজের অনুকৃতি সর্বাংশে নিন্দনীয় অবশ্যই নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের মত মহত্তম কবিও কবিজীবনের সূচনালগ্নে ছিলেন বিহারীলালের অনুসরণে নিমগ্ন; আর শামসুর রাহমান তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ তে তো জীবনানন্দেরই পদাঙ্ক অনুসারী। তাই বলা যায়, আগত- অনুকৃতি সত্ত্বেও মহিবুর রহিম ক্রমান্বয়ে তাঁর কাব্যভাষার নিজস্ব কন্ঠস্বরটি অচিরকালের মধ্যেই খুঁজে পাবেন এবং তা অত্যন্ত জরুরী। কারণ সৃষ্টি রহস্যে অতীন্দ্রিয় তৃতীয় নয়ন বা অতিরিক্ত চোখ থাকাটাই শেষ কথা নয়; একজন প্রকৃত কবির থাকতে হবে স্বোপার্জিত বাকভঙ্গী এবং অনাস্বাদিত পূর্ব প্রকাশভঙ্গীর স্বাতন্ত্র্য। এজন্যেই বোধকরি মহিবুর রহিমের আত্মবিশ্বাস :
‘খুলে দেখলেই দেখতে পাবে ভেতরে আমার
সমগ্রটাই অপরাজেয়
আকাশের মিনারের মত উঁচু আমার সীমানা
দেখতে পাবে, আমাকে পরাজিত করা
অতটা সহজ না।
(সূর্যকরোজ্জ্বল)
তবে তিনি যে নিজস্ব কণ্ঠস্বর এষণায় নিষ্ঠাবান এবং আত্মকবিকৃতি অন্বেষণে নিবেদিত চিত্ত তা বোঝা যায় তাঁর কবিতায় হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠা অনিন্দ্য উপমা ও চমৎকার চিত্রকল্পের বিদ্যুতবিভায়। ‘অতিরিক্ত চোখ’ এ তাৎক্ষণিক বিক্ষিপ্ত বীক্ষণেই লক্ষ্য করা যায় কিছু উদ্ধৃতিযোগ্য উপমা ও চিত্রকল্প:
* শ্রাবণের ঝড়ো বাতাসে আক্রান্ত হয়ে
লাঞ্চিত কাকের মত এসেছি তোমার কাছে (ফিরে আসা)
* অবরড়ই পাতার মত কল্পমান আমার চৈতন্য (ঐ)
* অঘুমে পেন্ডুলাম হয়ে অন্তরাত্মা দোলে (অসুখ-দুই)
* হৃদয়ের করিডোর দু’বাহু বাড়িয়ে দেয় কত গাছপালা (মাতৃময় জঠরের মত)
* বর্ণের রক্তের ফোটা যেন পদচিহ্ন হয়ে রাস্তা হেঁটে যায় (মাতৃভাষা)
* তোমার সারামুখ আমার উত্থান-পতনের পাণ্ডুলিপি। (চট্টগ্রাম)
* তৃষিত চৈতন্য কাঁপে তাপদগ্ধ মৃত্তিকার মত (তৃষিত চৈতন্য)
* পুঁজির প্রতাপে দগ্ধ বোধের কঙ্কালে গড়ে ওঠা নতুন ইজম (পলাতক সময়ের পিছে)
* চিত্রকল্প ছুঁয়ে আছে তাপদগ্ধ খরার রোদন (ভয়ের বীভৎস মুখ)
এরকম অনেক উদ্ধৃতিযোগ্য উপমা এবং চিত্রকল্প তাঁর কাব্যদেহে নিক্কন তুলে নেচে ওঠে, আবার গীতল করে তোলে। ’অতিরিক্ত চোখ’ কাব্যগ্রন্থে দৃষ্টিকটু মুদ্রণ প্রমাদের কথা উহ্য রাখলেও অনেক বানান কেবল মুদ্রণপ্রমাদ বলে মনে হয় না। বানানের কারণে অর্থান্তর ঘটিয়েছে যে শব্দগুলো তা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করা প্রয়োজন। একালের গদ্য-কবিতায় মাইকেলি ক্রিয়ার ব্যবহার শুধু অসঙ্গত নয়, রীতিবিরুদ্ধ এবং অশোভনও। শুধু কবিতায় কেন গীতিকাব্যেও এখন আর কেউ প্রকাশিতে বা উচ্ছ্বাসী ধরণের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেন না। এ প্রবণতা মহিবুর রহিমের কবিতায় পরিত্যাজ্য বলে মনে করি। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের সাধারণ সমীক্ষণেই লক্ষযোগ্য যে, সনেটের ঐতিহ্যবাহী ছন্দ মাধুর্য অনেক ক্ষেত্রে রতি হয়নি বলে মনে হয়; কোথাও অন্ত্যমিল দুর্বল, কোথাও বিঘ্নিত, আবার কোথাও যেন লাগসই নয়। অবশ্য পুনর্নিরীক্ষণে এগুলো সংশোধন অযোগ্য নয়।
মহিবুর রহিমের কবিতায় নিঃসন্দেহে অনেক সুকৃতি এবং সদর্থকতা আছে। কিন্তু একটি আপদমস্তক আধুনিক কবিতার বই পড়তে গিয়ে আদি অন্তে মনে পরে ‘অতিরিক্ত চোখ’ যেন প্রথাসিদ্ধ ধর্মেরই টীকা-ভাষ্য। যে কাব্য গ্রন্থের শুরু ‘প্রশংসা তোমার’ নামীয় ঈশ্বর বন্দনায় আনত কবিতা দিয়ে, তার শেষ ‘আজ যদি থাকতেন রসুল (সঃ)’ শিরোনামের কবিতায়। অর্থাৎ আলাহর গুণকীর্তন দিয়ে গ্রন্থের শুরু আর রসুল বন্দনা দিয়ে সমাপ্তি, আদিতে হামদ অন্তে নাত। মধ্যযুগীয় পুঁথি সাহিত্যের ধারাতেই আমরা বিষয়টি ব্যাপকভাবে লক্ষ করি।
প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রতি সব কবিরই দুর্বলতা থাকে প্রথম সন্তানের মত। প্রথম জনক হওয়ার আনন্দে অনেকের কাছে ভুলগুলোও ফুলের মত নিষ্কলুষ সুন্দর। এ-যেন তেমনি। সবকিছু মিলিয়ে মহিবুর রহিমের ‘অতিরিক্ত চোখ’ বহমান সময়েরই সন্তান এবং এই শর্তে কবিতা প্রেমী পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করার যোগ্য। ‘অতিরিক্ত চোখ’ এর শিরোনাম কবিতাটিই সমগ্র গ্রন্থের মৌলচেতনা এবং কবির অন্তর্লোকের দ্যোতক বলে মনে করি। মহিবুর রহিমের ‘অতিরিক্ত চোখ’ আরও বেশি পর্যবেক্ষণশীল দুর্নিরী হোক, সংখ্যায় হোক অবসংখ্য-পূণ্যারি মত। আর পাঠক কবির মতই অনুধাবন করুক :’কবিতা তের মলম’।