প্রিসাইডিং অফিসারের সহযোগিতায় নৌকায় প্রকাশ্যে সিল

মো: আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ) ।।
সকাল নয়টায় জেলা প্রেসক্লাব থেকে রওনা হওয়ার সময়ই এমনটা শোনা যাচ্ছিলো। বেশ কয়েকটি কেন্দ্র থেকে বিএনপি ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর এজেন্টরা ফোন করে জানান, আওয়ামীলীগের লোকজন কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। সাধারণ ভোটারদের বাধ্য করা হচ্ছে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারতে। সকাল সাড়ে দশটায় প্রথমে যশোদল ইউনিয়নের সিরাজুল ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে স্বচক্ষে এ দৃশ্য চোখে পড়ল।
বিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় দেখা গেলো শত শত লোক ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ানো। মাঠের লাইন ছেড়ে সবাই এখানে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। ভবনের মহিলা বুথের প্রবেশ পথে চোখে পড়লো চার যুবক দাঁড়িয়ে আছে নৌকার ব্যাচ পরে। আরবানু (৫০) নামের এক ভোটার জানালো, প্রায় এক ঘন্টা ধরে তিনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন ভোট দিতে পারছেন না। ভেতরে প্রবেশ দেখা যায়, নৌকা ব্যাচ পরা ৭/৮ জন তরুণ। তারা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সামনেই ভোট তদারকি করছে। যারা ভোট দিতে আসছে তাদের চেয়ারম্যান পদে ওই তরুণদের সামনেই ভোট দিতে হচ্ছে।
রুবেল নামের ব্যাচ পরা এক তরুণকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, “এটা সৈয়দ নজরুল ইসলামের কেন্দ্র। এখানে এরকম কিছু হবেই। আপনারা অতকিছু দেইখেন না।” এ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, ‘কি করবো ভাই আপনিও তো দেখছেন। তা ছাড়া মানুষ একসাথে চলে আসায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে।’ প্রিসাইডিং অফিসারের নাম জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান।

কিশোরগঞ্জের কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের শালজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহিলা বুথে প্রবেশ করে ভোট তদারকি করছেন নৌকার ব্যাচ পরা যুবকেরা!
কিশোরগঞ্জের কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের শালজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহিলা বুথে প্রবেশ করে ভোট তদারকি করছেন নৌকার ব্যাচ পরা যুবকেরা!

এরপর কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের শালজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। তখন বেলা পৌনে বারোটা। এই কেন্দ্রের মহিলা বুথে গিয়ে দেখা যায়, এখানে পুরুষ ভোটারেরাও ভোট দিচ্ছেন। চেয়ারম্যান পদের ব্যালটে সিল মারা হচ্ছে প্রকাশ্যে। মেম্বারদের ভোট নির্দিষ্ট গোপন স্থানে গিয়েই দিতে হচ্ছে। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এখানে তিনটি বুথ। মহিলা ও পুরুষ ভোটারের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। পুরুষ মহিলার ভোট সমান তালে নেয়ার জন্যই পুরুষ মহিলার ভোট একলাইনে নেয়া হচ্ছে। প্রকাশ্যে সিল মারার বিষয়টি তাকে অবহিত করলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে এ কেন্দ্রে
দায়িত্বে থাকা দুজন পুলিশ সদস্য (নাম না প্রকাশ করার শর্তে) এ প্রতিনিধিকে ডেকে নিয়ে জানান, এখানে আওয়ামীলীগের লোকজনের কাছে তারা অসহায়। তাদেরকে অনুরোধ করেও সরানো যাচ্ছে না। লাইন ভেঙে ভেতরে ঢোকায় এক মহিলাকে আটকানোয় ওই মহিলা ও কয়েক ছাত্রলীগ নেতা তাদের চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দেন।
দুপুর দুইটায় যশোদল ইউনিয়নের সৈয়দ নজরুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (পুরাতন ভবন) কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, বুথের ভেতরে পাঁচ সাত জন মিলে একসাথে সিল মারছেন। কক্ষের ভেতরে গাদাগাদি করা লোক। এদের প্রায় সবার বুকেই নৌকার ব্যাচ সাঁটানো। এ প্রতিনিধিসহ কয়েকজন সংবাদকর্মী যুবকদের ছবি তুলতে গেলে প্রিসাইডিং অফিসার এসে সাংবাদিকদের কক্ষ থেকে বের করে দেন।
প্রিসাইডিং অফিসার মো: তানজিমুল ইসলাম জানান, ভোটার সংখ্যা বেশি, তাড়াতাড়ি ভোট নেয়ার জন্য এমনটা করা হচ্ছে। আর আপনাদেরতো ভেতরে ঢুকার অনুমতি নেই।
বিকেল তিনটায় যশোদল ইউনিয়নের কাটাখালি হাফিজিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর এজেন্টদের ছাড়া বাকি কোনো প্রার্থীর এজেন্টদের পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রের ভেতরে এ প্রতিনিধিসহ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদকর্মী গিয়ে দেখেন, প্রিসাইডিং অফিসার মো: জহুরুল হক ভোটারদের হাত থেকে ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মেরে ভাঁজ করে বাক্সে রাখছেন। এ কক্ষে ২০/২৫ মিনিট অবস্থান করে দেখা গেছে তিনি অন্তত ৪০টি ভোট এভাবে দিয়েছেন। আপনি কেনো সিল মারছেন? এ প্রশ্নের জবাবে প্রিজাইডিং অফিসার বলেন, ‘বাইরে দেখছেন না কত ভীড়? আমি ভোটারদের সাহায্য করছি।’ সবগুলো সিল তো নৌকায় মারলেন! এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এরা সবাই নৌকার লোক।’
এ দিকে চৌদ্দশত ইউনিয়নের সুলতানপুর নুরুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল মারার সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়ার নজরে পড়ে যান ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ও মঞ্জুসাহা আচার্য। এ ঘটনায় প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে সাথে সাথে তাকে বহিস্কার করা হয়।

Similar Posts

error: Content is protected !!