হাওর এলাকার কৃষকরা বছরে মাত্র একবার ফসল উৎপাদন করে। তাও কোনো কোনো বছর আগাম বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়। এ বছরের অতিবৃষ্টিতে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার খবর আমাদের নিকলী.কম-এ দেখে খারাপ লাগলো। চিন্তা করতে লাগলাম এ নিয়ে কিছু একটা লেখা দরকার। প্রায় ৭ বছর হলো কোরিয়া থাকি। এদেশের কৃষি ব্যবস্থা কত আধুনিক। সেচ ব্যবস্থা, পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আমাদের দেশ কতটা পিছিয়ে, বিশেষ করে আমাদের হাওর এলাকার কৃষকরা কতই না পিছিয়ে। আমার নিজের চিন্তাধারা থেকে হাওর এলাকার কৃষকদের কয়েকটি প্রধান সমস্যা ও সমাধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরছি :
আগাম বন্যা
হাওরের কৃষকদের এটি একটি প্রধান সমস্যা। অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানি থেকে প্রায় প্রতিবছরই আগাম বন্যার কারণে অনেক ফসল নষ্ট হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
এটি একটি অন্যতম সমস্যা। খালগুলো খননের অভাবে প্রায় সারাবছর শুকিয়ে থাকে। আর যে মৌসুমী রাস্তাগুলো আছে সংস্কারের অভাবে কৃষিপণ্য পরিবহনের অযোগ্য। হাওরের রাস্তাগুলোতে এপ্রিল মাসে মাটি ফেলা হয়, যার ফলে কয়েকদিন পরেই আগাম বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
বর্ধিত উৎপাদন খরচ
সার, বীজ ও শ্রমের অধিক মূল্যের কারণে উৎপাদন খরচ দিন দিন বেড়েই চলছে। অথচ সেই তুলনায় বিক্রয়মূল্য অনেক কম। এতে কৃষিকাজে মানুষ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
চোর-ডাকাতদের তথা নিরাপত্তার অভাববোধ
হাওরের চাষীরা চোর-ডাকাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। তাদের বাতান থেকে চাষের গরু ডাকাতরা নিয়ে যায়। ধান উঠানোর পর ডাকাতদের একরপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ উপঢৌকন দিতে হয়। না দিলে সব ধান নিয়ে যায়।
দাওয়ালের অভাব
হাওরে প্রায় সবার জমি এক সাথে কাটতে হয়। এসময় দাওয়ালের তীব্র সংকট দেখা যায়। এ সমস্যাগুলি থেকে সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হলো :
ক) আগাম বন্যা থেকে রক্ষার জন্য নদীগুলোর ড্রেজিং-এর মাধ্যমে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আরো সক্রিয় করার মাধ্যমে বন্যা নিরোধকারী বাধ অধিকহারে নির্মাণ করা যেতে পারে। হাওরে একে ওয়াপদা বাধ বলা হয়ে থাকে।
খ) হাওরের খালগুলোকে খনন করলে এতে নৌ চলাচল ও সেচ দুটোরই উপকার হবে। আর বিদ্যমান রাস্তাগুলোকে সাবমার্সেবল বা সেমিপাকা করলে পরিবহনে খুবই উপকার হবে।
গ) অধিকহারে কৃষিতে বর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা যেতে পারে।
ঘ) হাওরের থানাগুলোকে সমন্বয় করে পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে চোর-ডাকতের উপদ্রব কমে যায়। এই ব্যাপারে প্রশাসনের নজরদারি বাড়িয়ে দিতে হবে।
ঙ) দাওয়ালের সংকট সমাধানকল্পে ধান কাটার মেশিনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কারণ বর্তমানে সারাবিশ্বে মেশিনের সাহায্যে ধান কাটা হয়। এতে যেমন খরচ কমবে তেমনি দ্রুততার সাথে অনেক কাজ করা যাবে।
চ) তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে চাষাবাদে দেশকে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ফসলের প্রক্রিয়াকরণের প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে সময় বাঁচানো যেমন সম্ভব তেমনি উৎপাদন খরচ কমে যাবে উল্লেখযোগ্য হারে। শুধু ধান চাষের ক্ষেত্রেই পৃথিবীর দেশে দেশে দেখা যায় জমি তৈরি, চারা রোপণ, আগাছা নিধন, সার প্রয়োগ, ধানকাটা, মাড়াই; সবকিছুই সম্ভব প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবিত পণ্য ব্যবহার করে।
উপরোক্ত প্রস্তাবনাগুলো ছাড়াও শঙ্কর জাতের ধান রুপণ করতে হবে। যেসব জমি আগাম বন্যায় প্লাবিত হয় সেখানে বি-আর ২৮ রুপন করা যেতে পারে। এতে দ্রুত ফলন ফলে। একটি কথা মনে রাখা উচিত কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। কৃষক বাচঁলেই দেশ বাচঁবে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে চাষ পদ্ধতির কিছু ভিডিও দেয়া হলো :
লেখক : দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী, রাজনীতিবিদ