বড়দের মতো শিশুরাও অনেক সময় বাতরোগে আক্রান্ত হয়। এই অসুখটি শনাক্ত করা সহজ নয়, চিকিৎসাও দুরহ। আর ছোটদের বাত হলে ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়ে।
বাত বা জুভেনাইল ইডিওপেথিক আর্থরাইটিস হলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশেষ করে অস্থিসন্ধি বা হাড়ের সংযোগস্থল ফুলে যায় ও একটানা দীর্ঘ দিন ধরে ব্যথা চলে। সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে এই রোগ দেখা দিলেও ছোটরাও এই রোগটির হাত থেকে উদ্ধার পায় না অনেক সময়।
বাচ্চারা সাহসী
‘বাচ্চারা খুব সাহসী রোগী। শুধু বাত নয়, অন্যান্য অসুখ হলেও এটা লক্ষ্য করা যায়। ছোটদের ছোট করে দেখা হয় প্রায়ই।’ বলেন প্রফেসর ইওহানেস পেটার হাস। জার্মানির গার্মিশ পার্টেনকিয়র্শেন শহরে শিশু ও কিশোরদের বাতরোগ সংক্রান্ত কিনিকের প্রধান তিনি। এই বিশেষ কিনিকটি স্থাপিত হয় ৬০ বছর আগে। জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত বাতরোগের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র কিনিক এটি। চিকিৎসার বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয় করে থেরাপি দেয়া হয় এই কিনিকে। বাতরোগ বিশেষজ্ঞ, ফিজিওথেরাপিস্ট, সমাজকর্মী, মনস্তত্ববিদ ও শিক্ষাবিদ সবাই মিলে ছোট রোগীদের চিকিৎসা ও দেখাশোনা করেন। জার্মানিতে প্রায় ৪০ হাজার শিশু ও কিশোর নানা ধরনের বাত রোগে ভুগছে। এদের অর্ধেকই অস্থিসন্ধির দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণে আক্রান্ত হয়।
বাত রোগ সাধারণত হাঁটু, হাত ও পায়ের জোড়ায় দেখা দেয়। বাত রোগের উৎপত্তি কীভাবে, তা সুস্পষ্ট জানা যায়নি।
প্রফেসর হাস বলেন, এটা একটা অটো ইমিউন রোগ অর্থাৎ শরীরের প্রতিরোধ শক্তি নিজেই নিজেকে আক্রমণ করে বসে। প্রথমে অস্থিসন্ধির ওপরের ত্বক আক্রান্ত হয়, এরপর কার্টিলেজ বা উপাস্থি পরিশেষে আক্রান্ত হয় অস্থি। অসুখটা যাতে এই অবস্থায় পৌঁছাতে না পারে, সেটাই থেরাপির মূল লক্ষ্য।
আক্রান্ত হয় নানা অঙ্গপ্রতঙ্গ
কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন স্থান আক্রান্ত হয়। সংখ্যাটা পাঁচের অধিক হলে বলা হয় পলিআর্থরাইটিস। পাঁচের কম হলে বলা হয় ওলিগোআর্থরাইটিস। অনেক সময় খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু হয় বাত রোগ। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখের স্নায়ু আক্রান্ত হয়ে অন্ধত্বের আশঙ্কাও দেখা দেয়। যেমনটি হয়েছে ফাবিওর ক্ষেত্রে। মাত্র তিন বছর বয়সে বাতরোগ শনাক্ত করা হয় তার দেহে। তখন বা হাঁটু ফুলে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল ফাবিওর। বাবা ফ্রাঙ্ক ভাগনার জানান, ‘মনে প্রশ্ন জাগে, কেন ওকে এবং এত অল্পবয়সে আক্রমণ করলো অসুখটি। রোগ নির্ণয়ের পর বিরাট এক আঘাত লাগে। ডাক্তারদের রোগটি শনাক্ত করতেও অনেকদিন লেগে গিয়েছিল।’
কাঁধ, পা, হাতের কব্জি ও চোয়ালে বাত দেখা দেয়। হাঁটুর দুই দিক এবং নিতম্বও আক্রান্ত হয়েছে। ফাবিওর বয়স ১৫ বছর। সে প্রযুক্তিবিদ হতে চায়। সমবয়সীদের মতই সে তার রোগ, হাসপাতাল, ইনজেকশন, থেরাপি ইত্যাদি সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলে যেন সর্দিকাশি হয়েছে।
চলাফেরায় অসুবিধা
সংক্রমণের ফলে হাড়ের সংযোগস্থল ফুলে গিয়ে গরম হয়ে যায়। এতে আবার চলাফেরায় বাধার সৃষ্টি হয়। এই মুহূর্তে ফাবিওকে হাঁটতে হয় ক্র্যাচে ভর দিয়ে। কেন না অল্প কিছুদিন আগে তার হাঁটুতে অপারেশন করা হয়েছে। তিন মাস তার খেলাধুলা করা নিষেধ। সাইকেল চালানো ও সাঁতারে বাধা নেই। কারণ এতে হাঁটুর ওপর তেমন চাপ সৃষ্টি হয় না। ফুটবল ও বাস্কেট বল খেলার দিকে ঝোঁক রয়েছে ফাবিওর। অবশ্য অসুখের জন্য এই সব খেলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় বলে স্কুলেও নিয়মিত যাওয়া হয় না ফাবিওর। আগে সহপাঠীরা হাসি ঠাট্টা করতো তাকে নিয়ে। অবশেষে বাবা এক সমাজকর্মীকে নিয়ে ছেলের অসুখের ব্যাপারে এক ধরনের তথ্যপ্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এরপর বন্ধুবান্ধদের একটা ধারণা হয় ফাবিওর রোগটা সম্পর্কে।
আত্মবিশ্বাস বাড়ানো
‘বাচ্চাদের বাত হলে ব্যথা কমানোটা খুব গুরুত্বপূর্ণ’ বলেন প্রফেসর হাস। এছাড়া ফিজিওথেরাপির ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়, তা নাহলে বাতের চিকিৎসা ঠিক মত হলেও চলাফেরায় অসুবিধা থেকে যায়। ওলিগোআর্থারাইটিসে আক্রান্ত হলে বয়ঃসন্ধিকালে তা সম্পূর্ণ ভালোও হয়ে যেতে পারে। পরবর্তীকালে এই রোগটা আর টানতে হয় না বাচ্চাদের।
শিশুদের বাতরোগের কিনিকে সমবয়সীদের সঙ্গে মিলিত হতে পারে ছোট রোগীরা। সবারই একই ধরনের সমস্যা। এর ফলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় তাদের। নিজেদের আর একা বা অবহেলিত বলে মনে করে না। এই অসুখটি এমন এক সময় আক্রমণ করে, যখন বাচ্চাদের শারীরিক বর্ধনের সময়। শিশু রোগীদের মনোবল চাঙা রাখার দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়। বলেন প্রফেসর হাস। তার ভাষায়, আমাদের এখানে বিরাট এক ‘কাইম্বিং ওয়াল’ রয়েছে।
অনেকে প্রশ্ন করেন, বাতের কিনিকে এটা দিয়ে কী হবে? কিন্তু দুই সপ্তাহ থেরাপির পর, ছয় মিটার উঁচু খাড়া প্রাচীরটি বেয়ে একেবারে ওপরে উঠে যেতে পারলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় শিশু রোগীদের। তাই তো কেউ কেউ বলে ওঠে, ‘আমার বাত আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি অনেক কিছু পারি।’
সূত্র : ডয়চে ভেল