খাইরুল মোমেন স্বপন, বিশেষ প্রতিনিধি ।।
কল রিসিভ করা ছাড়া কিছুই বুঝে না। তবুও মোবাইল ফোনটি বুকে আঁকড়ে ২৪ ঘন্টাই খোলা রাখছেন। মেসেজ আসার শব্দও শঙ্কার কাঁপন তুলছে বুকে। এক মাস ধরে নিখোঁজ পুত্র হাদিসলামের (১৬) সন্ধানে থানায় জিডি ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে নির্ঘুম দিনাতিপাত করছেন এক গ্রাম্য মা। ইতিমধ্যে একাধিক মোবাইল থেকে আসছে সন্ধান সংবাদ। সংবাদ বিশ্বস্ততার জন্য দিচ্ছে পুলিশ পরিচয়ও। চাওয়া হচ্ছে মুক্তিপণ। বিভাগ থেকে বিভাগ ঘুরে শিকার হচ্ছে শুধুই হয়রানি।
সন্তান শোকে পাগল প্রায় মায়ের সাথে এমন প্রতারণা কেউ করতে পারে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও সে মায়ের। মা আনজু বেগম (৪২); কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নওবাড়িয়ার নূর মোহাম্মদের স্ত্রী। ঢাকা চকবাজার এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানা থেকে কর্মরত অবস্থায় নিখোঁজ পুত্র হাদিসলামের চিন্তায় আর সন্ধান প্রতারণায় দিশেহারা এখন আনজু বেগম।
নিখোঁজ হাদিসলামের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ধার কর্জের টাকা বিদেশ গিয়ে বিপদগ্রস্ত হাদিসলামের পিতা নূর মোহাম্মদ। এমতাবস্থায় স্বামীর ঋণের বোঝা আর সংবার খরচ চালাতে গিয়ে গলদঘর্ম আনজু বেগম। কয়েক মাস আগে স্কুলপড়ুয়া ছেলে হাদিসলামকে একই গ্রামের ইব্রাহিমের পুত্র কবিরের সাথে ঢাকায় শ্রমিকের কাজে পাঠায়। কবির হোসেনের ঢাকার চকবাজারে মায়ের দোয়া প্লাস্টিক নামে একটি কারখানা রয়েছে। এ বছরের ২২ এপ্রিল কারখানায় কর্মরত অবস্থায় হাদিসলাম নিখোঁজ হয়। মা আনজুকে জানানো হয় চার দিন পর। বাড়ির গন্ডি না পেরুনো আনজু বেগম ছেলে নিখোঁজের সংবাদে পাথর হয়ে যান। প্রতিবেশীদের পরামর্শে ছুটে যান কটিয়াদী থানায়। বিধি না থাকায় জিডি গ্রহণ না করে কটিয়াদী পুলিশ চকবাজার মডেল থানায় যেতে পরামর্শ দেয় আনজুকে। কারখানা মালিক কবির হোসেনের কাছে ছুটেন আনজু। মা আনজুকে বাদ দিয়ে নিজে বাদী হয়ে নিখোঁজের ২২ দিন পর ১৪ মে ২০১৬ তারিখে চকবাজার মডেল থানায় একটি জিডি দায়ের করেই দায় সারেন কবির হোসেন। জিডি নং- ৬২৫। অগত্যা মা আনজু বেগম ১৭ মে একটি জাতীয় দৈনিকে হাদিসলামের সন্ধানে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। ঐ দিনই খুলনার পাইকগাছা থানার এসআই রফিক পরিচয় দিয়ে একটি নম্বর থেকে জানানো হয় হাদিসলামের সন্ধান। ছেলের সাথে কথা বলতে চাইলে জানানো হয় হাদিসলাম অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে রয়েছে। ২০ হাজার টাকার প্রয়োজন। ধার কর্জের টাকায় আনজু ছুটে যায় সে থানায়। এস আই রফিক জানায়, আনজুকে ফোন দেয়া নম্বরটি তার নয়। এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। হতাশা আর ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা মাত্র পর দিন আসে আরেকটি কল। মা আনজু বেগমের কাছে হাদিসলামের মুক্তিপণ বাবদ ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। বিস্তারিত জানার আগেই অপর প্রান্ত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়।
এ দিকে কারখানা মালিক কবির মিয়া এ প্রতিনিধিকে জানান, ২২ মে ইসলামবাগের কোথাও তার অপর এক শ্রমিকের সাথে হাদিসলামের দেখা হয়েছে। দুজনে একসাথে চা-ও খেয়েছে। এ ঘটনার পর হাদিসলামকে সাথে সাথে কেন তার হেফাজতে নিয়ে আসা হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঐ শ্রমিক আমাকে বলেছে হাদিসলামকে কিছুটা এলোমেলো দেখা গেছে। দুই এক দিনের মধ্যেই হাদিসলাম কারখানায় ফিরবে বলে ঐ শ্রমিকের কাছে বলেছে। এ নিয়ে বৃথা চিন্তা করতে এ প্রতিনিধিকে নিষেধ করেন তিনি। মা আনজু বেগম বলেন হাদিসলামের কোন খোঁজ পাওয়া গেলে আমাকে সবার আগে জানানোর কথা। এ পর্যন্ত আমি কিছু জানি না। যে কোন মূল্যে আমি শুধু হাদিসলামকে পেতে চাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী জানান, এলাকায় কবিরের পরিবার দাপুটে হিসেবে পরিচিত। সে কারণে নিখোঁজের পরিবার কবিরের কাছে জোর দিয়ে কোন সহযোগিতাও চাইতে পারছে না। পুরো বিষয়টি রহস্যজনক।