মহিবুর রহিম ।।
১.
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। এখানে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে খেলে যায় পালাবদলের ঢেউ। প্রকৃতি তার সজ্জায় আনে রকমারি রূপের পরিবর্তন। এ পালা বদলের দোলা যেন মানুষের অন্তর সত্যকেও স্পর্শ করে যায়। তাই ঋতু পরিবর্তনের ছাপচিত্র অঙ্কিত দেখি বাঙালির মানস চেতনায়। আমাদের আবহমান সংস্কৃতির বুননে ঋতু এক স্থায়ী আসন নিয়ে আছে।
ঋতু পরিবর্তনের শুরুতেই গ্রীষ্মের আগমন। নিদাঘের খরতাপে এ সময় প্রকৃতি যেন হাহাকার করতে থাকে। প্রকৃতির ঝলসিত অন্তর কেঁপে ওঠে এতটুকু পানির স্পর্শের জন্য। অনন্ত তৃষ্ণা জাগ্রত তাপিত পৃথিবীর হৃদয়কে স্পর্শ করতে নেমে আসে অবিশ্রাম বৃষ্টিধারা।
তাই এ দেশের প্রকৃতিতে গ্রীষ্ম যেন চির প্রতীক্ষার কাল, যার অন্তরে বিরাজিত চির বিরহের বেদনার সুর। মানব মনের অন্তর্গত শূন্যতার মতো গ্রীষ্মের প্রকৃতি ছেয়ে থাকে অনন্ত তৃষ্ণার আকুলতা। তাই বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা আসে কখনো মিলনের ঋতু হিসেবে। আমাদের আবহমান চৈতন্যের মধ্যে বর্ষার আগমন তাই নতুনের সাড়া জাগায়। প্রাণের প্রস্ফুটনে বিমুগ্ধ জলাধারে কদম কেয়ার মৌতানে বর্ষা যেন স্নাত করে দেয় বাঙালির ব্যাকুল হৃদয়কে।
২.
এখন বিদেহ রাজ্যে ক্ষীণস্রোতা মহীর কিনারে
নিঃসঙ্গ পেতেছি শয্যা চোখ রেখে রাতের আকাশে
আকষ্মাৎ মনে হলো এ পৃথিবী তাপদগ্ধ কটাহের মতো
মনে হলো বৃষ্টি চাই, নতুন জন্মের জন্য চাই জল
চাই অনর্গল শব্দময় উচ্চসিত মেঘের গুঞ্জন।
মেঘের বিলাপ মানে ধরণীর মর্মের ক্রন্দন
তাই বীজ বুনে যায় ডেকে আনে উদ্ভিদ, উদ্ভেদ
সবুজ চামড়া অলা জলে ভরা উপমহাদেশ
আমার পিপাসা নেই তৃষ্ণা রজ্জু ছিড়ে খুড়ে ফেলে
আমি শুধু চেয়ে থাকি, আর বলি বৃষ্টি হোক তবে
হে বায়ু, মরুতগণ, অতিধীরে নামো পৃথিবীতে
নেমে এসো ধনীয় চাষীর ক্ষেতে মহীর কিনারে
হাতির পালের মতো মেঘের গম্ভুজ নিয়ে কাঁধে
নগ্ন হয়ে নেমে আসো আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে।
৩.
আষাঢ়ের ছাপচিত্র রয়েছে বাঙালির প্রাচীন সাহিত্যে। ‘চর্যাগীতি’ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এবং মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যে বর্ণিত ও বন্দিত হয়েছে বর্ষার প্রকৃতি। সমগ্র উপমহাদেশেই এই বৃষ্টি বিধুর ঋতুর স্তুতি ও বন্দনা পাওয়া যায় প্রাচীনকাল থেকেই। মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এক কালজয়ী কাব্যের মর্যাদা নিয়ে আজও আদৃত। যেখানে বর্ষার বৃষ্টির আর মেঘের গমন পথের বর্ণরা রয়েছে বহু বিচিত্র ইজেলে। কালিদাস লিখেছেন ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশিষ্ট সানুং।’
মেঘ যেখানে অনন্ত বিরহী যরে বার্তা নিয়ে বয়ে যায় প্রাচীন নিসর্গ ও নগরের দৃশ্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে। মানুষের মনের মধ্যে যে সজল স্নিগ্ধতার তৃষ্ণা আছে, একটু সতেজ স্পর্শের ব্যাকুলতা আছে, সেই অনাঘ্রাত ভালবাসার সদ্য ফোটা প্রথম কদম ফুলের মাসের নামই আষাঢ়।
রুক্ষ্ম, তাপিত, বিধূর বিশুষ্ক হৃদয় মাসের পর মাস তাই বর্ষার সজলতাটুকুর জন্য অপেক্ষা করে। তার অন্তরে ফোটার গোপন বাসনা আছে, যে মিলনের অপার বেদনা আছে আষাঢ় তাকেই যেন পূর্ণতা দিতে চায়।
৪.
কবিতার অত ছন্দ নেই, এত সুর ছিল না ভাষায়
নিকট আসিল দূর, বৃষ্টিতে বাজিল প্রাচীন কবির ছন্দ সুর
জগত পাবিয়া গেলো আজ রাতে, এমন বৃষ্টিতে হায়
সখি, তুমি না জানি কোথায়?
এমন বৃষ্টির চেয়ে প্রিয় কিছু নেই পৃথিবীতে। মনে হলো
আকাশ আগ্রহী হলো আজ রাতে আমাদের হৃদয় ভরে দিতে।
৫.
বর্ষা আসে দু’কুল প্লাবিত করে নদী ও বিস্তৃত শস্যের প্রান্তরে। এক ভিন্ন আমেজ ও আকর্ষণ তখন বাঙালির সমাজে সংসারে। উথলে ওঠা নদীর তরঙ্গ কলোলে আন্দোলিত হয় বাংলার গ্রাম, জনপদ। বাঙালি নারীর মনে বর্ষার অভিঘাত জাগায় বিধূর বেদনা। বঙ্গের চিরন্তন নারী হৃদয় নায়রের আশায় ধাবমান নৌকার মাঝিদের আকুল করে তুলে। বাংলার লোক-সংস্কৃতিকে এই সংবেদন অভিনব মূর্ছনায় ব্যক্ত, প্রকাশিত। পার্থিব আর অপার্থিব ভাবের মিশেলে বঙ্গ ললনার আকুতি প্রকাশিত হয়েছে আমাদের লোকসংগীতে।
বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও সংগীতে বর্ষার সুর-ব্যঞ্জণা মূর্ত হয়েছে অভিনব শিল্প যোজনায়। ভাব জগতের যে গভীর তত্ত্ব রবীন্দ্রনাথকে বিমোহিত করেছিল- বাংলার প্রকৃতি তার জন্যে অনেকাংশে দায়ী। বিশেষ করে বর্ষার অঝোর ধারা- আকাশ ছেঁয়ে মেঘের বয়ে যাওয়া রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে ধ্রুপদি ভাবের ব্যাকুলতায়।
“সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নির্ভৃত নির্জন চারিধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার-
জগতে/ কেহ যেন নাহি আর।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।”
কিংবা
“ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে,
ঘন গৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা।
গুরুগর্জনে নীপমঞ্জরী শিহরে,
শিখী দম্পতি কেকাকল্লোলে বিহরে।
দিগ বধূচিত হরষা
ঘন গৌরবে আসে উন্মাদ বরষা।”
( বর্ষামঙ্গল )
রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষা’কে সাহিত্যের এক অনন্য প্রেরণা হিসেবে দেখেছেন। বিশেষত ‘বর্ষা’ রবীন্দ্রনাথের কাছে সঙ্গীতের এক উৎস স্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ তার ‘আষাঢ়’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘বলিতে গেলে ঋতুর রাগরাগিনী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীত শাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব, কিন্তু সে কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখিতে পাই, বসন্তের জন্যে আছে ‘বসন্ত’ আর ‘বাহার’; আর বর্ষার জন্যে ‘মেঘমেলার’ ‘দেশ’ এবং আরও বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত।’ (বিচিত্র প্রবন্ধ)
মানব মনের চিরন্তন রহস্য প্রকাশিত হয় বিরহে। সৃষ্টির শুরু থেকে মানবের অন্তরে যে গভীর শূন্যতাবোধ মানুষকে ভাব থেকে ভাষার দিকে ধাবিত করেছিল বিরহের সূত্রপাত সভ্যতার সেই ঊষালগ্ন থেকে। মানুষের এই বিরহকে ব্যঞ্জনা দিয়েছিল প্রকৃতির আবহমান পরিবর্তনশীলতা। বিশেষ করে বর্ষার অবিশ্রাম বর্ষণে বিরহী হৃদয়ের বেদনা সিক্তসলিলে নতুন মাত্রা লাভ করে। কাব্যে সংগীতে এই বিরহিনীর এক দুই তিন এভাবে দশটি রূপ প্রকাশিত।
নজরুলের বহু কবিতা ও গানে বর্ষার নান্দনিক রূপ প্রকাশিত হয়েছে। চিরকালের প্রেম-বিরহের চিত্রবহুল রূপ নিয়ে মেঘ ও বৃষ্টির বন্দনা রচিত হয়েছে। নজরুল প্রেম-বিরহের কবি নন। তিনি মূলত প্রেম ও বিদ্রোহের কবি। যেমনটা তিনি নিজে বলেছেন-
“মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি
আর হাতে রণতূর্য”
কিন্তু চিরকালের বর্ষাচিত্র নজরুলকে প্রেম-বিরহের দীক্ষাই দিয়েছে। ‘আজি এ শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে’। কিংবা ‘চোখের চাতক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“কাহার কাজল আখি- চাহি মোর নয়নে
ঝুরেছিল একা রাতে কবে কোন শাওনে,
আজি এ বাদল ঝড়ে সেই আখি মনে পড়ে,
বিজুলি খুঁজিছে তারে নভ-আঙনে।’
৬.
মধ্যযুগের কবিদের কবিতায় ‘বর্ষা’ একটি বড় স্থান অধিকার করে আছে। লোকসাহিত্যে যেমন ‘বারমাসী’ জাতীয় লেখায় ঋতুর বন্দনা হয়েছে, তেমনি মধ্যযুগের সাহিত্যেও ঋতু এক অনন্য প্রেরণা। বিশেষ করে মধ্যযুগের পদাবলী সাহিত্যে আমরা বর্ষার অসাধারণ বর্ণনা পাই। যেমন-
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ- পানে
না চলে নয়ান তারা ॥
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে
যেমন যোগিনী পারা ॥
এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনী
দেখয়ে খসায়ে চুলি ॥
হসিত বয়ানে চাহে মেঘ- পানে
কি কহে দু’হাত তুলি ॥
৭.
গগনে গরজে মেহু শিখরে ময়ূর।
আমারে ছুড়িয়া প্রিয়া রৈল্য মধুপুর ॥
সৈয়দ মর্তুজা কহে সখি অকুল পাথার।
নদীয়ার কিনারে ঝুরি না জানি সাতার ॥
৮.
চতুর্দিকে খনার মন্ত্রের মতো টিপ টিপ শব্দে সারাদিন বৃষ্টিধারা ঝরে। জমির কিনার ঘেষে পলাতক মাছের পেছনে জলাডোরা সাপের চলন নিঃশব্দে দিখছি চেয়ে। বর্ষণে ভিজছে মাঠ। যেন কার ভেজা হাতখানি রয়েছে আমার পিঠে। ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে আজও আমি উবু হয়ে আছি।
‘বর্ষা’ দিয়েছে বাঙালিকে গভীরতর ভাবের প্রেরণা। অনিত্য জীবনের সঙ্গে নিত্য জীবনাকাঙ্ক্ষার সম্মিলন ঘটেছে এই ঋতুর সর্বাত্মক সমারোহে। বর্ষা দিয়েছে এক নিজস্ব সংস্কৃতির জন্ম। প্রেমের মহিমায় এনেছে বিরহের মর্মস্পর্শী সুর। গতিমান সময়ের বুকে এঁকে দিয়েছে স্তব্ধতার অনন্ত প্রার্থনা। তাই ‘বর্ষা’ বন্দিত হয়েছে আবহমান কাল ধরে।
মহিবুর রহিম : কবি, প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি গবেষক। বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।