বিশেষ প্রতিনিধি ।।
মাত্র শ’খানেক মুসল্লি নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় এবার ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদগাহ’র ইতিহাসে এতো কমসংখ্যক মুসল্লি নিয়ে ঈদ জামাত কোনো কালে হয়েছে কি না কেউ স্মরণ করতে পারছেন না।
গত ঈদের জঙ্গি হামলার চাপা উৎকণ্ঠা ও ঈদ জামাতের আগে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে মাঠে এবার মুসল্লি কম হয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের লোকজন।
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে শুরু হয় জামাত। ইমামতি করেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। জামাতের আগে আর্চওয়ের ভেতর দিয়ে মুসল্লিদের মাঠে ঢুকতে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রত্যেক মুসল্লিকে অন্তত তিনবার তল্লাশির মুখে পড়তে হয়।
আবদুল কাইয়ুম নামে এক মুসল্লি জানান, মাঠে তাদের চেয়ে তিনগুণ ছিল আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য।
ঈদের জামাতকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। শোলাকিয়া মাঠ, এর আশপাশ ও শহরে তিন প্লাটুন বিজিবি, বিপুলসংখ্যক র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক মোতায়েন ছিল।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও শোলাকিয়া ঈদগাহ কমিটির সভাপতি মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, ঈদ-উল-ফিতরে জঙ্গি হামলার ঘটনায় এবারে ঈদ-উল-আযহায় মুসল্লীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩ প্লাটুন বিজিবিসহ, র্যাব, পুলিশ ও আর্মড পুলিশ মোতায়েন করা হয়। প্রতিবারেই ঈদ-উল-ফিতরের তুলনায় ঈদ-উল-আজহায় মুসল্লীদের উপস্থিতি কম হয়ে থাকে। এবার ১৮৯তম ঈদ-উল-আজহার জামাতে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আরো কম লোক হয়েছে।
এবারের জামাতে লোক কম হলেও তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, ওজুখানা ও টয়লেটের মতো জরুরি সেবার আয়োজন করেছিল প্রশাসন। দূর-দূরান্তের মুসল্লিদের জন্য করা হয়েছিল দুটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা। পুলিশ জানিয়েছে, এবার শোলাকিয়ার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত এক হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এদিকে শোলাকিয়া ঈদ জামাতে লোকসমাগম কম হবার পেছনে বর্তমান ইমামের ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ডকেও দায়ি করছেন কেউ কেউ। অভিযোগ আছে, ২০০৯ সালে শোলাকিয়া মাঠের নির্ধারিত ইমাম আবুল খায়ের মুহাম্মদ ছাইফুল্লাহকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানের ইমাম হিসেবে নিয়োগ হন এনজিও পরিচালক ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। এ নিয়ে স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছিল। আওয়ামীঘনিষ্ঠ এ আলেমকে শোলাকিয়ার ইমাম নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই স্থানীয় আলেমসমাজ তাকে ‘বিতর্কিত’ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আখ্যা দিয়ে তার পেছনে নামাজ পড়া ‘মাকরুহ’ হবে বলে জানিয়ে দেন। ফরীদ উদ্দীন মাসউদের মুনাজাতে রাজনৈতিক বন্দনা মুসল্লিদের বিরক্তির কারণ হয়। তাছাড়া মাওলানা মাসউদ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে গিয়ে শোলাকিয়ার ইমাম পরিচয় দিয়ে নাস্তিক ব্লগারদের সাথে একাত্মতা পোষণ করায় সে সময় কিশোরগঞ্জে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেশের আলেমসমাজ তাকে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ কিশোরগঞ্জে ইমাম ও উলামা পরিষদের এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের অন্যতম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় অনুষ্ঠিত এ কনভেনশনে সর্বসম্মতিক্রমে মাওলানা মাসউদকে বয়কটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কনভেনশনের সভাপতি দেশের প্রখ্যাত আলেম ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিব মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ্ মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে লিখিত প্রস্তাব পাঠ করেন। এরপর থেকেই অনেক আলেম ওলামা ও স্থানীয় বাসিন্দারা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের পেছনে নামাজ পড়েন না। ইদানিং কওমি মাদরাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি বিষয়ে বেফাকের সাথে ফরীদ উদ্দীন মাসউদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে কওমী মাদরাসার আলেম-ওলামা ও শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নতুন করে তার পেছনে নামাজ না পড়ার আহ্বান জানিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালায়।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ শহীদি মসজিদের ইমাম ও জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল, মাওলানা আনওয়ার শাহ সহযোগি এক পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, শোলাকিয়ায় ঈদুল ফিতরে সাধারণত লোক হয় বেশি। ঈদুল আজহায় এর অর্ধেক হয়। গত ঈদের আতঙ্কই কাজ করেছে লোকদের মাঝে। তবে এত কম হওয়ার কথা নয়!
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের ব্যক্তিগত বিষয়ে আপত্তির কারণে মুসল্লি কম হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কিছু বলতে চাননি মাওলানা আনওয়ার শাহ। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কথা বললে রাজনৈতিক হয়ে যাবে। তাই আমি কিছু বলতে চাই না।’
শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, ‘আগের দিন রাত থেকেই প্রবল বৃষ্টি ছিল। ঝড়ো বাতাস ছিল। তাই মানুষজন মাঠে না এসে আশপাশের মসজিদে চলে যান। তাছাড়া শোলাকিয়ায় সাধারণত ঈদুল ফিতরে ৪/৫ লাখ মুসল্লি হলেও ঈদুল আজহায় এর চার ভাগের এক ভাগ হয়। এবার কয়েক হাজার হয়েছে। এর পেছনে বৃষ্টিই ছিল মূল কারণ। অবশ্য মানুষের মনে গত ঈদে হামলার আতঙ্কটাও রয়ে গেছে। আর নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ তৎপরতা ছিল। অনেক সময় অতিরিক্ত তৎপরতা মানুষের প্রতি অনিহা সৃষ্টি করে। তবে আমি মনে করি, এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার ছিল।’
তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে মুসল্লি কম হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা শোলাকিয়ায় মুসল্লি কম হওয়ার জন্য আমাকে দোষারোপ করছেন তারা মূলত আমার প্রতি বিদ্বেষ থেকেই এমনটা করছেন। তিনি বলেন, সরকার তো আমাকে শোলাকিয়ার ইমাম করেনি, স্থানীয় কমিটি এ দায়িত্ব দিয়েছে।
গত ঈদুল ফিতরে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে মাঠে যেতে পারেননি ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। এবার কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মাঠে উপস্থিত হন তিনি।