আব্বা,
তুমি কেমন আছো? ২০০১ সালের ১৪ জুলাই শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার মিডটার্ম এক্সাম ছিলো, পড়ছিলাম, রাত দেড়টার মতো বাজে। তখন থেকেই আমার মুঠোফোনে প্রচুর ফোন আসতে শুরু করে, আর আসে বাসায় (কিশোরগঞ্জ) আসার আহ্বান। সারারাত ভেবেছি কি হয়েছে? ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি এই বিপর্যয়ের কথা। তুমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ্য ছিলে। তোমার মতো প্রাণোচ্ছ্বল আর জীবন্ত মানুষ কয়জন ছিলো এই পৃথিবীতে?
খুব ভোরে কিশোরগঞ্জের পথে যাত্রা শুরু করি সিলেট থেকে। বাসার সামনে তখন ভীষণ ভীড়, আর একটা অ্যাম্বুলেন্স। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহাতুর দৃষ্টিতে। কেন যেন মুহূর্তেই বুঝে যাই সবকিছু। তুমি শুয়ে ছিলে আমাদের ড্রয়িং রুমে; কফিনে। আমি বাকরুদ্ধ, অপলক তাকিয়ে কেবল তোমাকেই দেখছিলাম। কি শান্ত আর মিষ্টি যে দেখাচ্ছিলো তোমায়, মনে হচ্ছিলো তুমি ঘুমিয়ে আছো। তোমার বুকে একটু হাত দিয়ে ছুতে চেয়েছিলাম, কারা যেন আমাকে বাঁধা দিচ্ছিলো, মনে নেই। চা পাতা আর মিষ্টি একটা সুগন্ধ আসছিলো তোমার থেকে। আমি তোমার মুখে হাত রেখেছিলাম। খুব শীতল ছিলে। আমি কোন শব্দ করতে পারছিলাম না, কাঁদতে পারছিলাম না; কিন্তু চোখে ছিলো শুধুই অশ্রু। নিজেকে হারিয়ে ফেলি যখন আম্মা আর বোনদের দেখি। ভাবতেই পারছিলাম না কিভাবে বাঁচবো আমি তোমাকে ছাড়া!
রাজনীতি ছিলো তোমার রক্তের প্রতিটি কণিকায়। তুমি আমাদের যতোটা সময় দিয়েছো তার চেয়ে হাজারো গুণ বেশি সময় দিয়েছো তোমার প্রিয় গণমানুষকে। আর তার প্রতিদান তুমি পেয়েছো “নেতা” নামে ভূষিত হয়ে। গুটিকয়েক রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত ছাড়া তোমাকে ভালবেসেছে তৃণমূলের আপামর জনসাধারণ। একজন রাজনৈতিক নেতার কাছে এটাই মুখ্য।
তুমি এমন একজন বাবা, যে তার প্রথম সন্তানকে মায়ের কোলে রেখে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলে জীবনের পরোয়া না করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করে আমৃত্যু যে দল তুমি করেছো, তার প্রতিদানে তুমি কি পেয়েছো?
কিশোর-ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি শুরু করে যুদ্ধে গেলে। হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকার জয় বাংলা বাজার হয়ে ভারতে। যোগ দিয়েছিলে মুজিব বাহিনীতে। হিমালয়ের কোল ঘেষা সুবিখ্যাত ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি। দেরাদুন থেকে দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে কমান্ডার হয়ে দেশে ফিরে যুদ্ধ করেছো হাওর এলাকায়। কিশোরগঞ্জ স্বাধীন হয়েছে একদিন পর আর সর্বশেষ যুদ্ধ বাইল্লাবাড়িতেও তুমি ছিলে। মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রয়াত শেখ মনি (১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ শহীদ), তোফায়েল চাচা (বর্তমান মন্ত্রী), প্রয়াত রাজ্জাক চাচাদের (সাবেক মন্ত্রী) সার্বিক পরিচালনায় আরো ছিলেন জনাব সিরাজুল আলম খান, যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে রহস্য পুরুষ বা দাদাভাই নামেই খ্যাত। তুমি যাদের সান্নিধ্য পেয়েছো, তা অনেকেরই ভাগ্যে জোটেনি।
সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করার প্রথম প্রতিবাদ হয়েছিলো তোমাদের নেতৃত্বেই কিশোরগঞ্জের আখড়া বাজার আমাদের বাসার সামনে থেকে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় তোমাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো প্রথম। তুমি ছিলে রাজবন্দী। (শুনেছি, তোমাদের সেবা করার জন্য দুই জন কয়েদি থাকতো। তোমাদের প্রতিমাসে জ্যাম, জেলী, ঘি এমনকি সিগারেট পর্যন্ত দেয়া হতো। তুমি সে সময় বেশ সিগারেট খেতে। আর আমরাই তোমাকে সেটা ছাড়াতে পেরেছিলাম অনেক পরে। তবে দুঃখের বিষয়, তুমি সিগারেট ছেড়ে পান খাওয়া শুরু করলে। তোমার জন্য রেড লিফ জর্দার কৌটা রাখতো আমাদের মোক্তার আলী ভাইসহ আরো বেশকিছু ঠিক করে রাখা পান দোকান। তোমার জর্দাসহ পানের সুগন্ধ এখনো আমি পাই…) ময়মনসিংহ জেলে তুমি, রাজ্জাক চাচা, তোফায়েল চাচা একসাথেই ছিলে অনেক দিন। যখন মুক্তি পেলে তখন আওয়ামী লীগ করার লোক পাওয়া যেতো না, পারলে এড়িয়ে যেতো। জীবন যৌবন সব দিয়েছো তুমি এই দলের জন্য আর নিকলীর মানুষের জন্য।
১৯৮৫ সালে নিকলী উপজেলা নির্বাচনে মাত্র ১৮৭ ভোটে তোমাকে পরাজিত করা হয় সম্মিলিত প্রয়াসে। বলা ভালো, তোমাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সেদিন জনতার ক্ষোভ, অশ্রুও তোমাকে বিচলিত করেনি, উত্তেজিত করেনি, তুমি ছিলে শান্ত। এর প্রতিবাদ আর প্রতিউত্তর উত্তাল জনতা দিয়েছে ১৯৯০ সালের অভূতপূর্ব নির্বাচনে। ১০ হাজার ৫ শ’রও বেশি ভোটে তোমাকে জয়যুক্ত করে ভাটি-বাংলার রাজধানী নিকলীর মানুষ। সাবেক একজন সংসদ সদস্যসহ ৩ প্রার্থী মিলেও তোমার ধারে কাছে আসতে পারেনি। তোমার বিজয় রুদ্ধ করতে অপচেষ্টা তখনো ছিলো; কিন্তু জনগণ ফল ঘোষণা পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন কার্যত ঘেরাও করে রাখে।
তুমি যখন ছিলে তখন নিয়মিত আমাদের বাসায় আসতেন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের অগণিত নেতা-কর্মী। শহরে আমাদের বাসার অবস্থান হচ্ছে সবচেয়ে সহজ আর হাতের কাছেই এমন একটা ব্যাপার। কিন্তু তার পরেও তোমার রাজনৈতিক সহকর্মীরা হাতে গোনা দুয়েকজন ছাড়া কেউ আজ পর্যন্ত খোঁজ নেননি আমাদের।
আব্বা,
তুমি না থাকায় অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে বেশি চিনেছি মানুষ। চেনা মানুষেরাও গিরগিটির মতো খোলস বদলায়। তবে তোমার জন্য এখনো চোখের জলে বুক ভাষায় অগণিত ভক্ত স্বজন, বিশেষ করে তোমার কর্মীরা। একজন অন্ধ বৃদ্ধা এসেছিলেন আমাকে একটু ছুঁয়ে দেখবে বলে। অশ্রুসজল নয়নে বলছিলেন, “তুমি নেতার পুত, একটু ছুয়া দেখি বাপ?” আমার জন্মভূমি দামপাড়ার মুরুব্বিরা বলেন, আগে পুলিশ আসলে তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই নাকি এলাকায় পা রাখতো। আর এখন? এখন তারা বুঝে, কি ছিলে তুমি…
আব্বা,
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে তোমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের খুব দরকার ছিলো। কিন্তু তোমাদের কেউ কেউ খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলে। তুমি ভাগ্যবান, তুমি জনতার বিপুল সম্মান নিয়ে চলে গেছো। এই দেখো ঝিনাইদহে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তার ছেলের বয়সী নিজ দলের বিপথগামী ক্যাডারেরা কি নিদারুণ ভাবেই না পিটিয়ে আহত করেছে। এখন আবার হাইব্রিড কালচার চলছে খুব। তোমার মতো লোকের প্রয়োজন হয়তো ফুরিয়ে গেছে। পায়ের নিচে শক্ত মাটি এনে দিয়েছো তোমরাই। আর কি অবলীলায় তোমাদের গায়ে হাত দেই আমরা! তুমি কি বিশ্বাস করো, যারা এই হামলা করেছিলো, তারা কোন বাবা-মায়ের সন্তান? কি তাদের দর্শন? তারা কি মুক্তিযুদ্ধের “চেতনা” কি, সেতা জানে?
টাঙ্গাইলের প্রবীণ ও তুখোর আওয়ামী রাজনীতিবিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক সাহেবকে হত্যা করেছে আরেক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠকের পরিবারের বখে যাওয়া তিন ভাই। তাদের মধ্যে একজন আবার সংসদ সদস্য, একজন পৌর পিতা, আরেকজন ব্যবসায়ী সমিতির নেতা। তাদের পথকে পরিষ্কার করতে। আমরা কি আজ তাদের হাতে নিরাপদ? এটাই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা? আর বড়জোর ১০/১৫ বছর হয়তো তোমাদের পাওয়া যাবে। তোমরা বিদায় নিচ্ছ একে একে। এখনো কি হয়নি আমাদের বোধোদয়, তোমাদের সম্মান জানানোর?
তবে তরুণ প্রজন্ম আজ এখন অনেক সচেতন, তারা জানতে চায়। তারা তোমাদের সম্মানের চোখে দেখে। তা না হলে এই দেশ কবেই পথ হারাতো।
আমার মেয়েদের (সায়রা নিবরাস ও সায়রা নিহাদ, আমার দুই নয়নের মণি) জন্য ভীষণ দুঃখ হয়। ওরা জানতেও পারলো না তোমাকে। তুমি জানলে নিশ্চয়ই খুশি হবে, তোমার নাতনিরা তোমার নাম জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় : আমার দাদাভাইয়ের নাম “নেতা”। আর তোমার ছবি দেখলেই চুমু খায়। কেউ শেখায়নি ওদের। এটাই হয়তো পরম্পরা, রক্তের বন্ধন…
ঘুমাও তুমি……
ইতি
তোমার আদরের অনুপম মাহমুদ
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
পুনশ্চঃ আপনাদের পরিবারের শহীদ, মরহুম এবং জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে লিখুন। আমরা জানতে চাই, আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মহানায়কদের। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই শুরু হউক এই নব যাত্রা। অনলাইনে থাকুক আমাদের পূর্বপুরুষের বীরত্বগাঁথা। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন দলের বৃত্তে আবদ্ধ না রেখে, আসুন তাদের রাখি সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
আপনারাও লিখতে পারেন আপনাদের অনুভূতি amadernikli@gmail.com এই ঠিকানায়। আশা ও বিশ্বাস, www.amadernikli.com এই দায়িত্বটুক পালন করবে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে।