সিংপুরের কার্গোঘাটে ‘চুরি-চামারির বাজার’!

মোহাম্মদ আল আমিন ।।

নিকলী উপজেলার সিংপুর বাজার কার্গোঘাট। ঘাটের কিনার ঘেঁষে টিনের ছোট ছোট অনেকগুলো চালা ঘর। দেখলে মনে হবে- ছোটখাটো আলাদা একটি বাজার গড়ে উঠছে এখানে। এলাকাবাসী এর নাম দিয়েছে ‘চুরি-চামারির বাজার’। হাওরের লোকজন এ নামে চেনে কার্গোঘাটটিকে।
singpur-cargo-ghat
গত শুক্রবার ১৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্গোঘাট এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়, কয়েকটি কার্গো ও ভলগেট রাত যাপনের জন্য নোঙর করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কার্গো নোঙর ফেলার কাজ শেষ করেছে। এ সময় নৌযানের লোকজন জানান, রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত কার্গো আসবে এখানে। কার্গোঘাটের সামনেই টিনের ছোট ছোট চালা ঘরগুলো। প্রতিটা ঘরই ডিজেল রাখার বড় বড় পাত্রে ঠাসা। কোনো কোনো ঘরের সামনে পাথর ও বালু স্তূপ করে রাখা।

ঘাট ঘুরে দেখা গেল, নদীর পাড়ে ১৭টি টিনের চালা। একটি ঘরে বসে থাকতে দেখা গেল এলাকার এক তরুণকে। তার ঘরে বড় বড় বেশকিছু ট্যাংকি সাজানো। প্রতিটি ট্যাংকিতে আবার নাম লেখা। এখানে কিসের ব্যবসা হয়? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজেল বেচি।’ কার কাছে বেচেন? তিনি উত্তর দেন, ‘কার্গোওয়ালাদের কাছে।’ তবে আড়ালেই এক লোক জানান, উল্টো কথা এটা। প্রকৃতপক্ষে তারা কার্গো বা নৌযানের লোকজনের চুরি করা ডিজেল বা ইঞ্জিনওয়েল কম দামে কিনে রাখেন। রাত বাড়ার সাথে সাথে তাদের ব্যবসা জমজমাট হয়। পাথর, বালু, কয়লাও বিক্রি হয় এখানে।

এক কার্গোশ্রমিক অভিযোগ করেন, অনেক সময় তেল বা মালামাল বেচতে বাধ্য করা হয় তাদের। এলাকার আরেকজন জানান, কোনো রাখঢাক নেই, সবার সামনেই চলছে এ অপকর্ম। তিনি বলেন, শুধু তেল কিংবা পাথর-বালু-কয়লা নয়, মাদকের বড় বড় চালানসহ অবৈধ মালামালও হাতবদল হয় এখানে। নদীর পাড়ে বসানো ছোট ছোট টিনের চালাঘরগুলো একটু ভালো করে দেখতে গেলে সেখানকার এক বৃদ্ধ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ক্যারে আইছুইন এনো। আফনেরার লাইগ্যা কি আমরার পোলাপাইনে কিছু কইরা খাইতও ফারত না।’

আলমাস উদ্দিন নামে এক যুবকের সাথে দেখা হতেই তিনি প্রথমে এ প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। পরিচয় পর্ব শেষে জানা গেল তিনি কার্গো থেকে টাকা তোলেন। তাছাড়া ওই ব্যবসার সাথেও জড়িত।

এলাকাবাসী জানান, এ কার্গোঘাটে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার চুরি-বাণিজ্য হয়। কার্গোর লোকজন, রাতের আঁধারে তেল, পাথর, বালু ও সিমেন্ট স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে।

সাধারণ ছোটখাটো ফেরিঘাটও থাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে। সেখান থেকে ইজারা বাবদ বছরে সরকারি কোষাগারে কিছু টাকাপয়সা জমা হয়। কিন্তু কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত নিকলীর সিংপুরের এ কার্গোঘাটের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে নেই। সরকার এখান থেকে পায় না কিছুই। সরকার না পেলেও এখান থেকে সরকারি দলের লোকজনের পকেট ভারি হচ্ছে ঠিকই। সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় একটি মসজিদকে নামকাওয়াস্তে কিছু টাকা দিয়ে কোনো রকম ইজারা ছাড়াই কার্গোঘাট ও সেখানে গড়ে ওঠা অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক নেতা মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি চক্র। মোহাম্মদ আলীর সাথে এ ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন আলমাস উদ্দিন নামে এক যুব নেতা।
singpur-cargo-ghat2
সিংপুর বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধনু নদী। এটি ব্যস্ততম একটি নৌপথ। এ নৌপথ দিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মালামাল পরিবহন করা হয়। ফলে প্রতিদিন অসংখ্য কার্গো ও ভলগেট এখান দিয়ে চলাচল করে। কয়লা, সিমেন্ট, বালু, রড, পাথর, ইটসহ নানা ধরনের পণ্য পরিবহন হয় এ পথ দিয়ে। সিলেট থেকে ঢাকা কিংবা ঢাকা থেকে ছাতক বা দূরের কোনো গন্তব্যে যেতে নৌযানগুলোর বেশ কয়েক দিন লেগে যায়। রাত হলে এ কার্গোঘাটে থামে নৌযানগুলো।

শুক্রবারে ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সুনামগঞ্জের মিয়ারচর থেকে বালু নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর যাচ্ছে আলমগীর-১ নামের একটি ভলগেট। এ নৌযানের শ্রমিক শাহপরান (৩০)। তিনি জানান, নৌযানগুলো রাতে চলাচল করে না। তাই তিন-চার দিনের কোনো গন্তব্যে যেতে হলে তাদের স্থানে স্থানে রাতযাপন করতে হয়। সিংপুর কার্গোঘাটও এ রকম একটি ঘাট, যেখানে মালাবাহী বা খালি নৌ-যানগুলো নোঙর ফেলে রাতে অবস্থান করে। আর এ অবস্থানের বিনিময়ে তাদের রাতপিছু নৌযানভেদে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় মোহাম্মদ আলীর কাছে। সন্ধ্যার পর ঘাটে তার লোকজন টাকা আদায় করে। প্রতিদিন রাতে এ ঘাটে শতাধিক নৌযান অবস্থান করে বলে জানা গেছে।

সিংপুর এলাকার সলিমুল হক বলেন, এটা কার্গোঘাট নয়, এটাকে এখন ‘চুরি-চামারির বাজার’ হিসেবে পরিচিত করে ফেলেছেন মোহাম্মদ আলী।

singpur-cargo-ghat3
শিমুল নৌ-পরিবহনের মিস্ত্রি খোকন মিয়া জানান, তিনি কোনোদিন ভলগেটের তেল বা মালামাল বিক্রি করেননি। তবে এখানে এসব ব্যবসা হয়ে থাকে। এসকে এলাহী কার্গোর মাস্টার মো. কামাল বলেন, সবাই এসব করে না, দুর্নীতিগ্রস্ত লোকজনই এ ব্যবসা করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কার্গো শ্রমিক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সব কার্গোই কম-বেশি চুরি করা তেল বা মালামাল বিক্রি করে এ ঘাটে। এলাকার লোকজন জানান, এখানে বাজার মূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে পাথর, কয়লা, বালু ও সিমেন্ট কেনা যায়।

সিংপুর বাজার জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি এমদাদুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন ছিল- আপনারা এ কার্গোঘাটটি ইজারা দিতে পারেন কি না? জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে এ প্রথা চলে আসছে। এ ঘাটকে ঘিরে যে অবৈধ ব্যবসা, চুরির মাল বেচাকেনা হয়, তার সঙ্গে একমত নন জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো উচ্ছেদ হওয়া প্রয়োজন।
singpur-cargo-ghat4
সিংপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এলাকার স্বার্থে প্রতি নৌযান থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা হারে টোল আদায় করা হয়। অতিরিক্ত টাকা আদায় করছি না। ঘাটে কার্গোর লোকজন যে চুরি করা মালামাল বিক্রি করে তার সাথে তিনি জড়িত নন দাবি করে বলেন, লোড-আনলোড করে কার্গো বা ভলগেটে যে অতিরিক্ত মালামাল থাকে তা-ই পথে বিক্রি করে দেয় সংশ্লিষ্টরা। এসব কিনে এলাকার অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি পরিবার চলে।

সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক বলেন, কার্গোঘাটটি নিয়ে ইউনিয়নের বদনাম হচ্ছে। যদি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ইজারা হতো তাহলে ইউনিয়নের রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা যেত। আর অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চুরির মালামাল বেচাকেনাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিংপুরে কার্গোঘাটে যে অবৈধ ব্যবসা ও চুরির মাল বেচাকেনা হয়, তা সত্য হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

সূত্র : নিকলীতে ‘চুরিচামারির বাজার’ (নয়া দিগন্ত, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)

Similar Posts

error: Content is protected !!