একান্নবর্তী সম্ভ্রান্ত পরিবারের আদরের সন্তান মাসুম সওদাগর। দাদার ছিলো বেশ কয়েকটা হাজারমইন্না (১০০০ মণ পণ্য ধারণে সক্ষম) নৌকা। ইঞ্জিনচালিত নয়, বরং পাল, গুণা, ছৈইর ও বৈঠাই ছিলো সম্বল। হাওরে ছয় মাসের জন্য এই নৌকাগুলো কেরায়া (ভাড়া দেয়াকে বোঝাতে হাওর এলাকায় এই শব্দ ব্যবহার করা হয়) দেয়া হতো। শুকনো মৌসুমে এই বিরাটাকার নৌকাগুলো নদীর পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। সেই জলমগ্ন নৌকা তোলার জন্য কয়েকশ’ লোকের প্রয়োজন হতো। পানি সেচার পর সেই নৌকায় পাওয়া যেতো বিশাল আকারের বোয়াল, শিং, বাইম, মাগুর থেকে শুরু করে নানা জাতের হাওর এলাকার মিঠা পানির মাছ। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের জমি ছিলো তাদের। জলসেচের জন্য নিজেদের শ্যালো মেশিন ছিলো। কয়েক হাজার মণ ধান আসতো তাদের যাবারে (ধান রাখার পাত্রবিশেষ), নিজেদের খাবারের জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিতো। তাদের গোয়ল ঘরে গরু ছিলো প্রচুর। তাদের বিশাল যৌথ পরিবারে রান্না হতো একসাথে। অত্যন্ত সাবলীল, সৌখিন আর অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই পরিবারের সুদিন এখন শুধুই স্মৃতি। দাদার মৃত্যু, হাওরে ইঞ্জিনসহ স্টিলের নৌকার বিপরীতে কোণঠাসা কাঠের নৌকা ও কৃষির দুরাবস্থায় সেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান মাসুম এখন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অমানুষিক পরিশ্রম করে বিভক্ত হয়ে যাওয়া নিজের পরিবারকে টিকিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিয়োজিত। অভ্যাসের বাইরে ও বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে সে কিডনীর সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে প্রবাসে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আলীমুদ্দিন মিয়া ক্ষুদ্র কৃষক, মেয়ের বিয়ের জন্য এনজিও থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পাত্র পক্ষের সামান্য (!) দাবি মেটাতে। হাওরপাড়ের সাদাসিধে মানুষ, ভেবেছিলেন, ফসল ঘরে উঠলে সুদসমেত একেবারে ঋণের টাকা দিয়ে দিবেন। তাই ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করেননি। আসলে বাড়তি কোনো আয়ের পথ না থাকায় প্রতি সপ্তাহে তার পক্ষে কিস্তির টাকা দেয়া সম্ভব ছিলো না। সে বছরে ফসল তলিয়ে গেলো আগাম চলে আসা উজানের ঢলের পানিতে। ঋণ পরিশোধের জন্য আরো একবছর সময় চাইলেন। কিন্তু এনজিওর মাঠকর্মী তো আর এই দাবি মানতে পারবে না। তা হলে নাকি তাকেই পরিশোধ করতে হবে গ্রহীতার দায়! তখন সেই মাঠকর্মীর পরামর্শে তার স্ত্রীর নামে আরেকটি এনজিও থেকে নেয়া হলো নতুন ঋণ; উদ্দেশ্য আগের ঋণ পরিশোধ করা। আগেরটা শোধ হয়েছিলো, কিন্তু সদ্য নেয়া ঋণের কিস্তি তো সে পরিশোধে অক্ষম। এবার বাধ্য হয়েই নিতে হলো দাদন, মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদের হারে। এইভাবে তালগোল পাকিয়ে বৃদ্ধ বয়সে পরিবার পরিজন, নাতি নাতনি আর ভিটেমাটি ফেলে শুধু স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে চলে এলেন বন্দর নগরীতে। তারা দুজনেই গ্রাম ছেড়েছেন। কারণ ঋণের দায় ছিলো এই দুজনের উপরেই। বৃদ্ধ বয়সে কর্মক্ষম ছিলেন না তারা কেউই। তাই পেটের দায়ে হাওরপাড়ের এই দম্পতি ভিক্ষা শুরু করলেন। আলীমুদ্দিন মিয়ার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মভূমি থেকে যোজন যোজন দূরে, লজ্জা, ভয় ও নানা আশঙ্কায় তার লাশও আসেনি নিজের ভিটায়…
পিতা মাতার আদরের সন্তান আকাশ। বাবা হাওরের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ। বাবার ইচ্ছা ও আগ্রহে ছেলে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলো। হাওর এলাকায় শিক্ষার অবস্থা ভীষণ করুণ। এই আকাশের গ্রামের বাড়ি এমন একটা উপজেলায়, যা কিনা সারা দেশে শিক্ষায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এক জনপদ। পরিবারে আর তেমন কেউ নেই যে তাকে একটু পড়ালেখা নিয়ে পরামর্শ বা পথ দেখাবে। স্কুলের শিক্ষক ও প্রাইভেটই ভরসা। হোঁচট খেলো সে এসএসসি পরীক্ষায়। সেই যুগটা গনহারে জিপিএ পাঁচ পাওয়ার সময় ছিলো না। বহুল প্রত্যাশিত ফলাফল না পেয়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। শিক্ষিত হয়ে শহুরে জীবন যাপন করে ছেলে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই আশায় বাবা তাকে কৃষিকাজ শিখতেও দেননি। এখন এই অর্ধশিক্ষিত ছেলেকে নিয়ে তিনি কী করবেন? অগত্যা ছেলে পা বাড়ালো রাজধানীর দিকে। জুতার পাইকারি দোকানে কাজ পেলো সে। এখন সে জুতার গোডাউন সামলায়। সারাদেশে জুতা পৌঁছে দেয় এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন শহরে গিয়ে মালিকের পাওনা টাকা আদায় করে। বাবা মা তাকে বিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু স্ত্রী সন্তান থাকেন গ্রামের বাড়িতে। হতাশা ভর করে প্রায়শই আকাশের। এই জীবনই কি সে চেয়েছিলো?
ওপরের তিনটি ঘটনা মোটেই কাল্পনিক নয়; বরং একেবারেই বাস্তব জীবন থেকে নেয়া। এই তিনটি চরিত্রের প্রত্যেকেরই জন্ম আমাদের হাওরপাড়ে। সাদাসিধে এই মানুষগুলো দ্রুত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে ছিটকে পড়ছে সমাজের মূল স্রোতধারা থেকে। আবহমান কাল থেকেই হাওরপাড়ের মানুষের জীবন অত্যন্ত সহজ আর সরল। তাদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে কৃষির ওপর বিশেষত, তারপর প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণ। এর বাইরে অন্য কোনো কাজ তারা কেন, তাদের পূর্বপুরুষেরাও জানতো না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হালের বলদের জায়গা দখল করেছে ট্রাক্টর। ড্রামে পিটিয়ে ধান ছড়ানো হয় না এখন, এসেছে রকেট মেশিন। হাওরের বাতাসের সাহায্য নিয়ে নারীদের কূলায় ধান উড়িয়ে চোছা (যে ধানে চাল হয় না) বাছার বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে মটরের উচ্চগতির পাখা। ধান ভাঙ্গিয়ে চাল করতে ঢেঁকি কিংবা গাইল-ছেহাইট নয় আছে চালের কল। নিমিষেই কাজ হয়ে যায়, গায়ে-গতরে খুব একটা খাটতে হয় না; যা একটু পয়সা খরচ হয় শুধু। পরিবর্তনের এই সময়ে শ্রমিকের চাহিদা কেবল ধানের চারা রোপন ও কাটার সময়। এই সময়টাতে শ্রমিকের খুব অভাব দেখা দেয়। তবে ক্রমাগতভাবে কৃষির ওপর হাওরবাসীদের আস্থা ও নির্ভরতা কমে যাচ্ছে। কৃষিতে লাভ কম হওয়ায় ও নানা সামাজিক প্রতিকূলতায় মানুষ দলে দলে ছেড়ে যাচ্ছে হাওর।
এই বছর হাওরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেটা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। আগাম পানিতে ক্ষেতের ফসল তলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় মরে গেছে হাওরের মাছ। হাওর এলাকায় অনেকেই সৌখিনতার বশে এমনকি বাণিজ্যিক ভাবেও গরু মোটাতাজা করে থাকেন কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে। এবারের বিপর্যয়ে লাখ টাকার ষাঁড় পানির দামে বিক্রি করে দিয়েছেন শুধুমাত্র গো-খাদ্যের অভাবে। প্রশিক্ষণ এ ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগি পালন করে তরুণ ও যুব সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টা করলেও এবার তাদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যাপকভাবে।
মানুষ স্থানান্তরিত হয় বা নিজের ভিটেমাটি ছাড়ে বিভিন্ন কারণে। তবে মোটাদাগে দুটো কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। এক হলো Pull factor অর্থাৎ উন্নত ও ভালোমানের জীবনের প্রত্যাশায় মানুষ স্থানান্তরিত হয় আবার push factor-এর কারণে মানুষ বাধ্য হয় স্থান ত্যাগ করতে। কৃষির ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত, পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হাওরবাসী দলে দলে এখন এলাকা ছাড়ছে। হাওরপাড়ে এটা নিয়ে দেখা দিতে পারে সামাজিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের ঢেউ কি তবে গোটা দেশকে স্পর্শ করবে না? প্রায় ২ কোটি মানুষের হাওর এলাকার জন্য ভাবুন, উদ্যোগ নিন, রক্ষা করুণ হাওরের জীব বৈচিত্র। হাওরের আবহমান সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় সম্পদ।
লেখক : উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী