এবারের বিপর্যয়ে হাওরের প্রতি দৃষ্টি দিতে দেশবাসীকে বাধ্য করেছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল। এটা নিতান্তই প্রকৃতির খেলা নয়, বরং এর জন্য দায়ী বছরের পর বছর হাওরবাসীদের প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উদাসীনতা ও ঠিকাদারদের সীমাহীন দুর্নীতি। আমাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধীরাও এই অপবাদ থেকে মুক্ত নন, বরং দুর্যোগ মোকাবেলায় তাদের অদক্ষতা ও অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে ব্যাপক আকারে।
প্রথমেই প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন অনেক কর্তাব্যক্তি। অতিবৃষ্টি ও হাওরের বাঁধের উচ্চতা নিয়ে নিজেদের চেয়ার রক্ষা করতে তৎপর হয়েছেন। কিন্তু হাওরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আপনাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলা হলেও এখন সরকারি ভাষ্য মতেই আমরা দেখতে পাই যে, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় মোট ৬টি হাওর জেলায় ৬২টি উপজেলা, ৫১৮টি ইউনিয়নে সর্বমোট ৮,৫০,০৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আরো জেনেছি যে ২,১৯,৮৪০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২,৮৬০টি বাড়ি সম্পূর্ণ ও ১৫,৩৪৫টি বাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্রঃ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট।
এবার শুধু ফসলহানি নয় সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাণী। ৬টি জেলার ২০টি উপজেলায় ৪৬টি জলমহালের ২১৩.৯৫ মেট্রিক টন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় এই ভয়াবহতা প্রকট আকার ধারণ করেছিলো। শুধু সুনামগঞ্জ জেলাতেই ৩,৯০২টি হাঁস ও ০৪টি মহিষ মারা গেছে। তীব্র গো-খাদ্যের অভাব দেখা দেয়ায় হাওর এলাকার কৃষকেরা জলের দামে বেঁচে দিয়েছেন গবাদি পশু। অনেকেই এই পশুগুলোকে প্রস্তুত করছিলেন আসছে কোরবানীকে সামনে রেখে।
পরিশেষে হাওরের ব্যাপক বিপর্যয়ে টনক নড়েছে প্রশাসনের। ইতিমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাধিক জেলা সফর করেছেন ও ব্যাপক ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেই সাথে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন সামাজিক ও বেসরকারি সংস্থা। ব্যক্তিগত ও সমবেত ভাবেও অনেক সংগঠন চেষ্টা করেছে হাওরের প্রাণ ফেরাতে। হাওরবাসীর পক্ষ থেকে তাদের সবার প্রতি আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। তবে আমরা হাওরবাসী চেয়েছিলাম সুবিচার…
দুর্নীতি দমন কমিশন এবার বেশ কোমর বেঁধেই মাঠে নেমেছে। সুনামগঞ্জ ও সিলেটে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রজ্জু করেই ক্ষান্ত হয়নি, সাথে সাথেই সুনামগঞ্জের বহিষ্কৃত নির্বাহী প্রকৌশলী, পানি উনয়ন বোর্ড মোঃ আফসার উদ্দিন ও বাঁধ নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইব্রাহিম ট্রেডারস-এর স্বত্বাধিকারী মোঃ বাচ্চু মিয়াকে গ্রেফতার করেছে দুদক। পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর ১৬ জন আর বাকি আসামি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত কমিটির সদস্য।
একবার ভয়াবহ লঞ্চ ডুবিতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায় তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, তিনি পদত্যাগ করবেন কি না? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি : আমি কি লঞ্চ চালাচ্ছিলাম? অথচ উন্নত বিশ্বে এমন ঘটছে হরহামেশাই। যেমন কিছুদিন আগে লন্ডনের একটি টাওয়ারে আগুন লাগায় প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। স্থানীয় কাউন্সিলর তার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। আমরা এখন উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখাতে চলছি, দায় নেয়ার মানসিকতা আমাদের থাকা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে আরেকটা সমস্যা হলো আমরা নতুন ইস্যু পেলে পুরনো ইস্যু ভুলে যাই। হাওর এমনিতেই বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত। আমরা হাওরবাসী ত্রাণ নেবো, এটা কখনো ভাবিনি। কারণ আমরা গোটা দেশের খাবার আর মৎস্যের যোগান দিয়ে থাকি। আমাদের আছে একটি সমৃদ্ধ অতীত। আমাদের কৃষ্টি ও সাহিত্য বাংলাদেশের সাংস্কৃতিকে করেছে ঋদ্ধ। হাওরের এবারের বিপর্যয়ে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। মোটা চাল এখন গোটা বিশ্বের মধ্যে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি। ঈদে ভিজিএফ-এর চালের পরিবর্তে আটা দেয়া হলেও কোথাও কোথাও স্থগিত আছে এখনো পর্যন্ত চালের মজুদ নেই বলে।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ এখন চাল আমদানী করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ভিয়েতনাম থেকে চাল এলো বলে, তার পরেও চালের বাজার অস্থির। এসবের জন্য দায়ী হাওর নিয়ে দুর্নীতি। এর দায় কেউ নিজ থেকে নেবে বলে মনে হয় না। তাই প্রয়োজন সুবিচার। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই সুবিচার এখন হাওরবাসীর অন্যতম দাবি। সুবিচারের স্বার্থে আইনের সঠিক প্রয়োগ দেখতে চাই, আমরা জানতে চাই কাদের পকেট ভরিয়ে আমরা আজ হাত পেতেছি ত্রাণের জন্য…
লেখক : মানবাধিকার কর্মী