১৪ ফেব্রুয়ারি, দেশের ইতিহাসে এক রক্তাক্ত দিন

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে অনেকেই লাল রঙের পোশাক পড়ে দিনটি উদযাপন করে থাকেন। তবে এই মাটিতে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অন্য এক লাল রঙের গল্প আছে। রক্তাক্ত সেই গল্প। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসন আমলে ছাত্র-ছাত্রীর লাল রক্তে ভেজা সেই ইতিহাস। ১৪ ফেব্রুয়ারিকে এই দেশের ছাত্ররা রক্তাক্ত ইতিহাসের মাধ্যমেই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। ওই মুহূর্তে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্যরা চুপ হয়ে গেলেও ছাত্ররা এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। এরশাদ ক্ষমতা দখলের প্রথম দিনেই এর প্রতিবাদ জানিয়ে পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হয় ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম, হাবিব ও আ. আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। সামরিক সরকারের দমন পীড়নের ভেতরই ছাত্ররা নানা ভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

১৯৮২ সালে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। এরই ধারবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ওই সমাবেশ ডাকে মিছিল বের হয়। সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট ও স্মারকলিপি দিতে মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে গুলিতে বেশ হতাহতের ঘটনা ঘটে। বহু শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়।

সেই মিছিলে অংশ নেয়া সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেনের দেয়া বর্ণনা অনুসারে জানা যায়, ‘মিছিলের প্রথমে শতাধিক ছাত্রীর অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মতো। খুবই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল, উৎসবের মতো অনেকটা। ব্যারিকেডের সামনে যখন মিছিল যায় হাইকোর্টের গেট ও কার্জন হল-সংলগ্ন এলাকায়, তখন মেয়েরা ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন। নেতারা তারকাঁটার ওপর উঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। মিছিলটি ছিল হাইকোর্টের গেট থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। কিন্তু কোনো উসকানি ছাড়াই তারকাঁটার একদিক কিছুটা সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে রঙিন গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর ভেতরে ঢুকে বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করে। সাধারণ ছাত্ররা তখন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। পুলিশ তখন ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। তখন শিশু একাডেমীতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা দিপালী নামের এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। তবে দিপালীর লাশ পুলিশ গুম করে ফেলে। জয়নাল পড়েছিলেন কার্জন হলের মধ্যে। তাঁকে ধরে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।’

সেই দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, বিকালে শহীদ জয়নালের জানাযায় হাজার হাজার ছাত্র অংশ নেয়। সেনাবাহিনী-বিডিআর-পুলিশ শাহবাগ, টিএসসি চত্বর, কলাভবনের সামনে, নীলক্ষেত, কাঁটাবনের রাস্তা ধরে পুরো অঞ্চল ঘেরাও করে ফেলে। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে পুলিশ অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে। এ সময় বহু ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়। উপাচার্যের কার্যালয়ে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মেরে হাত-পা ভেঙে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তৎকালীন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। কলাভবনের ভেতরে ঢুকে পুলিশ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক যাঁকে পেয়েছে তাঁকেই নির্যাতন করেছে। ওখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খ ম জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে। ওই বিভীষিকাময় দিনের বর্ণনা করেছেন স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্রনেতা মোস্তাক হোসেন, ‘আমরা জয়নালের লাশ লুকিয়ে ফেলেছিলাম মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে। লাশের খোঁজে পুলিশ চারুকলায় ঢুকে ছাত্রদের নির্যাতন ও গ্রেফতার করে। পুলিশ খুঁজে খুঁজে পোশাকে রঙিন গরম পানির চিহ্ন দেখে দেখে গ্রেফতার করে। অবশেষে মুহসীন হলের ডাইনিংয়ে লাশ পাওয়া গেলে অন্যান্য হলে লাশের তল্লাশি বন্ধ করা হয়।’

এদিন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানান সাবেক এই ছাত্রনেতা। তবে সরকারি হিসেব মতে এক হাজার ৩৩১ জন। এর কিছুদিন পরে সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করে।

এই ঘটনার পরই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সূত্র : ইতিহাসের পাতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি এক রক্তাক্ত দিন  [বাংলা, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮]

Similar Posts

error: Content is protected !!