আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
ভারতের দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের বুক চিরে গেছে যে ন্যাশনাল হাইওয়ে টোয়েন্টি ফোর, সেই ব্যস্ত মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্রসিংয়ে, রোজ সকালেই অদ্ভুত ওই দৃশ্যটা চোখে পড়ত। পড়ত, মাত্র কয়েকমাস আগেও।
খোডা, ইন্দিরাপুরম আর দিল্লিগামী সড়কের ওই ত্রিমুখী মোড়টায় সকালের ব্যস্ত অফিস টাইমে রোজ দেখা যেত পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মহিলা, হাতে স্রেফ একটা লাঠি আর গলায় হুইশল ঝুলিয়ে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন।
না, তার পরনে পুলিশের মতো কোনও খাকি উর্দি পর্যন্ত নেই। একেবারে সাদামাটা সালোয়ার-কুর্তা, বড়জোর মাথায় একটা টুপি কখনো-সখনো- কিংবা গায়ে জড়ানো একটা শস্তার ফ্লুরোসেন্ট জ্যাকেট। ভদ্রমহিলার নাম ডরিস ফ্রান্সিস, ওই রাস্তায় নিয়মিত যাতায়াত করা লোকজন ‘ডরিস আন্টি’ নামেই চেনেন তাকে।
সেই ২০০৯ সাল থেকে একটানা তিনি এন এইচ টোয়েন্টি ফোরের ওই ব্যস্ত মোড়ে দাঁড়িয়ে বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কার-অটো-টেম্পোর চলাচল সামলাচ্ছেন, আর তার সঙ্গে হাজার হাজার পথচারীকে সাহায্য করছেন নিয়ম মেনে রাস্তা পার হতে।
আর ডরিস আন্টির লাঠির ইশারায় নিমেষে থেমে যাচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি, হুইশল দিয়ে রাস্তা পার করাচ্ছেন অগণিত লোককে- সেটাও ছিল দেখার মতো একটা দৃশ্য! রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-জল যাই হোক, সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত ডরোথির ছিল ওটাই বাঁধা রুটিন। কখনও পাশে ট্রাফিক পুলিশের কর্মীরা থাকতেন, কখনও বা থাকতেন না।

নেহাত কোনও দিন সাঙ্ঘাতিক অসুস্থ হয়ে না-পড়লে এই রুটিনের কোনও ব্যত্যয় হয়নি ডরোথি ফ্রান্সিসের জীবনে। বছরখানেক আগে ক্যানসারে শয্যাশায়ী হওয়ার আগে পর্যন্ত টানা সাত-আট বছর ধরে এই কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি।
কিন্তু বাহান্ন বছর বয়সে কেন এমন একটা অদ্ভুত মিশনে নেমেছিলেন ডরিস ফ্রান্সিস? যখন আরও সুস্থ ছিলেন ও ভালভাবে কথা বলতে পারতেন, তখন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন সে রহস্য। আসলে পথ দুর্ঘটনায় নিহত মেয়ের আত্মাকে শান্তি দিতেই এ রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
ডরিস বলেছিলেন, “ঘটনাটা ২০০৮ সালের। মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে একটা অটোতে (সিএনজি) চেপে আমরা যাচ্ছিলাম এন এইচ টোয়েন্টি ফোর দিয়েই। এমন সময় গাজিয়াবাদের দিক থেকে একটা ওয়াগন-আর গাড়ি তীব্র গতিতে এসে সোজা ধাক্কা মারে আমাদের অটোতে। আমরা তিনজন তিনদিকে ছিটকে পড়ি।”
“আমি আর আমার স্বামী দু’জনেই গুরুতর জখম হয়েছিলাম- কিন্তু সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা ছিল আমাদের মেয়ে নিকির। ধাক্কার আঘাতে ওর ফুসফুসে মারাত্মক চোট লেগেছিল, শরীরের নানা অংশ বেরিয়ে এসেছিল পর্যন্ত!” এর পর টানা এক বছরেরও বেশি সতেরো বছরের মেয়ে নিকি হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছিল- তবে তাকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু সেই দুষ্টু-মিষ্টি মেয়েটার স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি ডরিস।
সন্তানহারা মা এর পরেই স্থির করে ফেলেন, যে ক্রসিংয়ের কাছে বেপরোয়া ট্রাফিকের কারণে তার নিকি চিরতরে হারিয়ে গেছে সেখানে তিনি নিজেই ট্রাফিক সামলানোর ভার হাতে তুলে নেবেন। “আমার খালি মনে হত, সেদিন যদি ওই মোড়ে একজন ট্র্যাফিক পুলিশ থাকত তাহলে ওয়াগন-আর গাড়িটা অত জোরে ছুটে আসার কথা হয়তো ভাবতেই পারত না। হয়তো বেঁচে যেত নিকির জীবনটা!”
“এখন ওই ক্রসিংয়ে আমি নিজেই দাঁড়িয়ে যদি বেপরোয়া যানবাহন সামলাতে পারি, তাহলে হয়তো কয়েকটা জীবন নিশ্চয় বাঁচাতে পারব। মৃত্যুর ওপারে গিয়ে নিকি এর চেয়ে বেশি শান্তি কিছুতেই পাবে না”, বলতে বলতে ধরে আসে ডরোথির গলা। ব্যাস, যে কথা সে-ই কাজ। সে দিন থেকেই তার মিশনে লেগে পড়েন ডরিস।
“প্রথম প্রথম যে অসুবিধা হত না, তা বলব না। আমার ইশারায় গাড়িগুলো থামতে চাইত না, পাল্টা প্রশ্ন করত আপনার কী এক্তিয়ার আছে ট্রাফিক কন্ট্রোল করার? লোকজনও অনেকেই মানতে চাইত না।”
“কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সবাই একদম পাল্টে গেল। লোকে বুঝল যে আমি থাকার ফলে ওই মোড়টা পারাপার করা অনেক নিরাপদ হচ্ছে, সহজ হচ্ছে। এখন তো গাড়ির কাঁচ নামিয়েও অনেকে বলে যায় থ্যাঙ্কিউ আন্টি, অনেকে থাম্বস আপ দেখায়”, তৃপ্তির হাসি হেসে সে দিন বিবিসিকে বলেছিলেন ডরিস ফ্রান্সিস।
‘আনসাং ইন্ডিয়ানস’ নামে একটি বিবিসি সিরিজেও তুলে ধরা হয়েছিল ডরিসের এই অসামান্য কাজের কথা। বিবিসির ওই সিরিজে তাকে অভিহিত করা হয়েছিল দিল্লির ‘ট্র্যাফিক কুইন’ হিসেবে। ডরিস ফ্রান্সিসের এই নিঃস্বার্থ সেবাকে স্বীকৃতি দিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষও।

গাজিয়াবাদের পুলিশ প্রধান আকাশ টোমার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “উনি একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের ট্রাফিক পুলিশের পরিপূরক ভূমিকা পালন করেছেন বহু বছর ধরে।” “খোডা-ইন্দিরাপুরম ক্রসিংয়ে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাওয়ার পেছনে ডরিস ফ্রান্সিসের যে বিরাট অবদান আছে তা স্বীকার করতে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই।”
কয়েক মাস আগে দুরারোগ্য ক্যানসার ডরিস ফ্রান্সিসের জীবনীশক্তি অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে- এখন আর তিনি আগের মতো লাঠি হাতে আর হুইশল ঝুলিয়ে এন এইচ টোয়েন্টি ফোরের মোড়ে এসে দাঁড়াতে পারেন না। কিন্তু গাড়ির চালক বা পথচারীরা ওই ক্রসিংটা পেরোনোর সময় অনেকেই নিশ্চয় ভাবেন, ‘কই, ডরিস আন্টিকে তো আর দেখা যাচ্ছে না’! তবে ক্রসিংটা যে এখন অনেক সহজে পেরোনো যায়, সেটা ভেবে তারা আন্টিকে মনে মনে নিশ্চয় ধন্যবাদ দিতেও ভোলেন না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা, ৫ আগস্ট ২০১৮