তোফায়েল আহছান ।।
২১ জুলাই ভোর থেকে একটা বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে জেলা শহর কিশোরগঞ্জ ও প্রাণের উপজেলা নিকলীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। বাসে করে অনেক বছর পর লম্বা জার্নি করলাম। সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা সদরে পৌছি।
প্রথম গন্তব্য ছিলো কিশোরগঞ্জ জেলা জজ কোর্ট। শ্রদ্ধেয় অ্যাডভোকেট মাসুদ ভাইয়ের সাথে দেখা করে কিশোরগঞ্জ সদরের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা। তার আগে বন্ধু হেদায়েতের (ফরিদ) সাথে দেখা করলাম। সব ব্যস্ততা ড্রয়ারে বন্দী করে আমাকে সময় দিলো বন্ধু হেদায়েত। খুটিয়ে খুটিয়ে কয়েক ধরনের খাবার দিয়ে নাশতা করালো। বিলটা দেয়ার জন্য ক্যাশ কাউন্টারের কাছে যেতে দিলো না। আমাদের বন্ধুমহল বরাবর এমনই। পরস্পরের প্রতি দায়িত্ববোধে পাগলপারা। সরি বন্ধু, তোর অনেক আগ্রহ, পীড়াপীড়ির পরও একটা দিন বেশি তোর সাথে কাটাতে পারলাম না। এই দেখার পর খণ্ড সময়ের জন্যও আর দেখা হলো না। আফসোস থেকে গেলো।
কোর্টের ক্যান্টিনে নাশতা খেলাম। যোগাযোগ হলো মাসুদ ভাইয়ের সাথে। তিনি জানালেন, এদিন তিনি কাজ থেকে ছুটি নিয়েছেন। সত্যিই আমি সৌভাগ্যবান। এমন দু’জন ব্যস্ত মানুষের পূর্ণ সঙ্গ খুব সহজেই পেয়ে গেলাম। সে কারণেই গুরুদায়িত্ব নিয়ে কিশোরগঞ্জসহ নিকলীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর কাজটা খুব সহজই মনে হলো।
জজকোর্ট এলাকায় আমাদের কাজ আছে এমন বিশিষ্টজনদের সাথে দেখা করলাম। আমাদের কাজ সম্পর্কে অবহিত করলাম। সবাই আমাকে এত সুন্দরভাবে নিলেন, অবাক হলাম। যাদের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিলাম, তারা তো আছেনই; ২১ জুলাই প্রথম পরিচয় হওয়া মিঠামইন উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের আতিথেয়তাও মুগ্ধ করেছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসকের কাছে ফোন করে দেখা করার সময় চাওয়া হলো। তিনি কোনো ভনিতা না করেই ডাকলেন। জজকোর্ট থেকে জেলা পরিষদ কার্যালয়ের দূরত্ব বেশি না হলেও জ্যামের কারণে কখনো এক ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। তিনি আধা ঘণ্টার মধ্যে যেতে পারবো কিনা জানতে চাইলেন। আমরা যদিও গিয়েছি আরো একটু বেশি সময় দেরি করে। তবু তিনি বসে থাকলেন আমাদের অপেক্ষায়। অভিভূত প্রশাসক মহোদয়; আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। প্রায় ২০ মিনিটের সাক্ষাতের সময়ে আমাদের চা-নাশতা দিয়ে আপ্যায়ন করিয়েছেন।
জেলা পরিষদ কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। প্রশাসক মহোদয়ের বেশি সময় নষ্ট না করে বের হওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাদের অবাক করে দিয়ে নিজ গাড়িতে শহরে পৌছে দেয়ার অফার করলেন। আমরাও সহজেই মেনে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। পরবর্তী গন্তব্য কিশোরগঞ্জ মডেল কলেজের কাছাকাছি পৌছে দিলেন।
কিশোরগঞ্জ মডেল কলেজের প্রিন্সিপাল মহোদয়। তিনি এক সময় নিকলী কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন। আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের একজন। যদিও দেখা হয়েছে হাতেগোনা কয়েকবার। কিন্তু মানুষ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনিও সুন্দর আতিথেয়তা দিয়েছেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। কিছু কাজের দায়িত্ব নিজে থেকেই গ্রহণ করলেন। নিকলীর আরেক গুণী ব্যক্তি গুরুদয়াল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল এবং বর্তমানে ঈশাখা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডীন আরজ আলী স্যারের সাথে কথা বলে আমাদের জন্য কিছু পরামর্শ সংগ্রহ করলেন।
সকাল থেকে এ পর্যন্ত পূর্ণ সঙ্গ দিয়েছেন আমার শ্রদ্ধেয় অ্যাডভোকেট মাসুদ ভাই। তিনি জেলা জজকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। অতি অমায়িক মানুষ।
ততক্ষণে আমার বন্ধু এনজিও কর্মকর্তা শ্যামল চক্রবর্তী জোর তাড়া দিতে লাগলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। আগে থেকেই দুপুরের দাওয়াত দেয়া ছিলো। দেরি করছি দেখে একটু রাগই হলো। নির্দিষ্ট স্থানে দাড়িয়ে থেকে ফোন দিলাম। নিজস্ব বাহন মোটরসাইকেল নিয়ে হাজির হলো শ্যামল। তার আগে দেখা হলো সদ্য হাওর ভ্রমণ শেষ করা আমার সহকর্মী আহমদ আমিন (আল আমিন) ভাইয়ের সাথে। তিনি অতি ব্যস্ত মানুষ। একটি জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছেন। অতি ব্যস্ততার মাঝেও আমরা দুই বন্ধুর সাথে যেতে আগ্রহী হলেন।
শ্যামলের স্ত্রীও আমার বন্ধু মানুষ। লিজা। আমি তাকে আপা বলেও সম্বোধন করি। বলা চলে, ওদের বিয়ের পর থেকে লিজা আমার আপা হিসেবে আর শ্যামলকে “ভাইসাব” বলেই বেশি সম্বোধন করে থাকি। ২১ জুলাই শ্যামল-লিজার ছোট ছেলে অনন্যর জন্মদিন। আগে থেকেই জানা ছিলো। তবু কোনো ধরনের ভদ্রতা না দেখিয়ে খালি হাতে বাসায় হাজির হলাম। দুই ছেলেসহ ওদের গোছানো পরিবারটিকে দেখে খুবই ভালো লাগলো। দুপুরের খাবারে দামি দামি নানা ধরনের খাবার আইটেম যোগ করে আপ্যায়ন করলো।
পরবর্তী গন্তব্য কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন স্কুল। যে জায়গাটি গত ঈদুল ফিতরের দিন সন্ত্রাসী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে। এই দুর্ঘটনার কারণে একটু ভয় পাচ্ছিলাম; কোনো ঝামেলা হয় কি না! সহকর্মী আল-আমিন ভাইয়ের অভয় পেয়ে রিকশাযোগে স্কুলে পৌছলাম। গেটে ঢুকলেই ডানপাশে প্রধান শিক্ষকের কক্ষ। দরজার ওপরে ছোট্ট করে প্রধান শিক্ষকের নামসহ পদবি লেখা দেখে ঢুকে গেলাম। চলমান দায়িত্বে আছেন নিকলীর আরেক কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় মুকাররম হোসেন শোকরানা। কক্ষে ঢুকে ওপরের দিকে তাকাতেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। চারজন সাবেক প্রধান শিক্ষকের ছবি টানানো; সম্ভবত সেরা অথবা কোনো বিশেষ ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় চারজন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের ছবি লাগানো। সারির প্রথম ছবিটিই নিকলীর শিক্ষার দূত আবদুল হামিদ স্যারের। স্যারের প্রতি প্রতিষ্ঠানের আর চলমান প্রধান শিক্ষকের ভালোবাসা দেখে আমিও নিকলীবাসী হিসেবে গর্বিত হলাম।
এবার গন্তব্য ঠিক হলো বাদল ভাইয়ের সাথে দেখা করা। খায়রুল আলম বাদল। কিশোরগঞ্জের নেহাল গ্রিন পার্কের ম্যানেজার। নিকলীর প্রতিভাধর আরেক সেরা ব্যক্তিত্ব। নিজের মেধা আর শিল্পের ঝলকানিতে রাঙিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তার সৃষ্টি দেখে চমকে যাননি, এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। আমিও প্রথমবারের মতো এসে এদিন মুগ্ধ। কিভাবে সম্ভব! ছোটকাল থেকে দেখে আসা মানুষটির এমন কাজের চর্চা কখনো দেখিনি। পুরো পার্কটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দীর্ঘ সময় তার সাথে আড্ডা দিলাম। বিশ্বাস করুন, শুধু এই শিল্পগুলোই নয়, তার প্রতিটি দিকই আপনাকে আকৃষ্ট করবে। তাকে ভালো না বেসে পারবেই না কেউ। এত সব সুন্দর সুন্দর গুণের অধিকারী মানুষটির দুটি পা আল্লাহ সাধারণ চলাফেরার অনুপযোগী করে রেখেছেন! তার গুণের কথা লিখে শেষ করার নয়। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি, তিনি আরো কিছু জটিল রোগে ভুগছেন। আল্লাহর কাছে তার জন্য সুস্থ-সুন্দর দীর্ঘ জীবনের জন্য আবেদন করছি।
সন্ধ্যা প্রায় হয়েই আসলো। আমার এদিনই নিকলীতে যাওয়ার কথা। বাদল ভাই তাড়া দিলেন, বাড়ি যদি আজ যেতেই হয়, দেরি যেন না করি। সন্ধ্যার পর আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা পাওয়া যায় না। সোয়া ছয়টার দিকে আল-আমিন ভাইসহ বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আখড়াবাজার এসে দেখা করতে হলো আমার বড় ভাবি ও ভাতিজা-ভাতিজির সাথে। রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে এক নজর দেখতে বাসায় ঢুকলাম। ভাবি আমার জন্য বেশ কয়েক রকমের খাবার রান্না করেছিলেন। দুপুরে খেতে আসিনি বলে আমার পছন্দের কিছু পিঠা বানিয়ে রেখেছেন; সাথে গরুর গোশতের ভুনা। খাওয়ার জন্য তাড়া থাকলেও সময় স্বল্পতায় কিছুই করার ছিল না। আমার স্বভাবগত কারণ জানা থাকায় বাক্সবন্দি করে খাবারগুলো দিয়ে দিলেন। আমি চিন্তামুক্ত হলাম, আর যা-ই হোক, পছন্দের খাবারগুলো হাতছাড়া তো হলো না!
দেরি করে স্টেশনে আসার পরও কৌশল আর ভাগ্যের ওপর ভর করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা একটা ম্যানেজ হলো। ভাড়া নিলো স্বাভাবিকের চেয়ে দেড়গুণ। খেদ নেই; অসময়ে বাড়ি যাওয়ার গাড়ি পেয়েছি। সে-ই অনেক। রাত সাড়ে ৯টায় বাড়ি ফেরার আগে বানিয়াহাটিতে পূর্বনির্ধারিত সংক্ষিপ্ত একটি মিটিং সেরে নিলাম। শ্রদ্ধেয় ফারুক ভাই, ঝোটন ভাই ও স্বপন ভাইয়ের সাথে আমি ছিলাম এই মিটিংয়ের সদস্য। পরবর্তী দিনের কর্মপরিকল্পনার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি হলো। এদিকে আমার অসুস্থ আম্মা ও ছোট বোন বার বার খোঁজ নিচ্ছিলেন কতদূর এসেছি। অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। আম্মা না খেয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
এবার নিকলী পৌছার পর আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্খীরা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি রেসপন্স করেছেন। সবারই ভালোবাসার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি ছিলো। আমিই ছিলাম এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। একেবারে স্বার্থপরের মতো কাজের পেছনে ছুটলাম। কাউকেই সময় দিতে পারিনি। ২২ জুলাই। খুব সকাল সকাল আমার স্কুলজীবন থেকে সবচে ভালো বন্ধু “কাশেম” তার গিন্নির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ছাতাসহ বেরিয়েছিলো। একসাথে জুম্মার নামাজ পর্যন্ত আড্ডা দিবো, ঘুরবো। দেখা হতেই তাকে সাফ জানিয়ে দিলাম, একসাথে ঘুরাফেরা হচ্ছে না। কারণ জানালাম। একটুও অভিমান করলো না। হাসিমুখে বিদায় জানালো। আমি বন্ধু চিনতে ভুল করিনি। সত্যিই তুমি আমার স্কুলজীবনের সেরা বন্ধু। তোমাকে প্রতিটি কাজে মন থেকে স্মরণ করি। তোমার বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়নগুলো ফলো করার চেষ্টা করি। এনামুলকে তো ফোন করেছিলাম দেখা করবো বলে। তা-ও পারিনি।
দ্বিতীয় দিনের পরিকল্পনামতো ঝুটন ভাই, মহসিন এবং আমি মিলিত হলাম বানিয়াহাটির মোড়ে। নিজস্ব আর্ট স্কুলের ব্যস্ততার জন্য আরেক সফরসঙ্গী শ্রদ্ধেয় স্বপন ভাই আমাদের সাথে যোগ দিতে পারলেন না। তিনজনই গেলাম শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু আবদুল জব্বার স্যারের বাসায়। কিছুদিন আগে স্যারের চোখে একটা বড় ধরনের অপারেশন হয়েছে। বার্ধক্য এবং চিকিতসার জন্য কিছুটা দুর্বল মনে হলো। কিন্তু কাজের বেলায় অসুস্থতার কোনো চাপ দেখালেন না। প্রতিটি দিকনির্দেশনা দিলেন স্কুলজীবনে দেখা স্যারের সতেজ ভঙিমায়। বলে রাখা ভালো, যে কাজের জন্য দুই দিনের এই ট্যুর; সেই কাজটির নেতৃত্বে রয়েছেন আবদুল জব্বার স্যার। তিনি আমাদের চা-নাশতা করালেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক ব্রিফ করলেন। কার কার সাথে দেখা করতে হবে তালিকা ঠিক করে দিলেন।
বের হয়ে গেলাম। সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে নিকলী সদর লাগোয়া উত্তরের ইউনিয়ন দামপাড়া বাজারে গিয়ে প্রথম দেখা করলাম আরব আলী স্যারের সাথে। তিনি আমাদের দামপাড়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা অফিসে বসিয়ে আপ্যায়নের চেষ্টা করলেন। আমাদের অনুরোধের মুখে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আমাদের কাজের খুব প্রশংসা করলেন। অন্তর থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আরো কয়েকজন মুরুব্বির সাথে দেখা হলো, সবাই খুব পজিটিভ আমাদের কাজের ব্যাপারে; মনে হচ্ছিলো প্রত্যেকেই আবার নিজেদের স্কুলজীবনে হয়তো ফিরে গেলেন।
ফোন দিলাম বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নিকলী উপজেলা শাখার সভাপতি জনাব ইসহাক ভূঞাকে। অমায়িক এই গুণীজন আমাদেরকে তখনই বাড়িতে যাওয়ার জন্য বললেন। নিকলী উপজেলার দ্বিতীয় চেয়ারম্যানের সাথে সরাসরি কখনো কথা বলিনি। ভাবগম্ভীর একজন মানুষকে চিন্তা করতে লাগলাম। কী হবে, কী বলবেন, আমি কিভাবে সামনা করবো? ভেবে ভেবে কিছুটা অস্থিরতা কাজ করছিলো। নিজেকে শান্ত রাখতে কৌশল হিসেবে আমাদের বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকাটির লগি হাতে কাজে লেগে গেলাম। হ্যা, কিছুটা ফল দিয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা নরসুন্দা নদীতে তখন প্রচণ্ড স্রোত। উত্তর দিক থেকে পানির প্রবাহ। আমাদের যাত্রা স্রোত ঠেলে এগিয়ে যাওয়া। ট্রলারটি শক্তি ও আকারে বড় হওয়ায় খুব তাড়াতাড়িই পৌছে গেলাম। অবাক করে দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে ইসহাক ভূঞা সাহেব আমাদের নদীর ঘাট থেকে রিসিভ করলেন। চমতকার ব্যক্তিত্ব। আতিথেয়তায় মুগ্ধ করলেন আমাদের। কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ করলেন, বিটিভি’র একটি নাটকের কথা; যেখানে নিকলীর একটি অঞ্চলকে হেয় করে বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। বললেন, খোঁজ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর কথা। ২০ মিনিটের আলোচনায় উপলব্ধি করলাম, নিকলী উপজেলার মানুষ সঠিক ব্যক্তিকেই তাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিলেন।
স্যারের বাড়িতে গিয়ে খবর পেলাম তিনি মজলিশপুর বাজার ঘাটে গোসল করতে গিয়েছেন। সেদিকেই হাঁটলাম। কিছুদূর এগোতেই দেখা পেলাম লিকলিকে গড়নের ফরিদ স্যারকে। খালি গায়ে ভেজা লুঙ্গি ও গামছা কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। নিকলী গোড়াচাঁদ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সাহিত্যের শিক্ষক এবং সাবেক প্রধান শিক্ষক। স্কুলজীবনে ক্লাস লেকচারে যে শিক্ষকগণ আমার মনে গেঁথে আছেন; ফরিদ স্যার অন্যতম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সতিদাহ প্রথাবিরোধী লেখালেখি নিয়ে তাঁর দেয়া লেকচার এখনো মনে পড়ে। কঠিন যে ছদ্মনামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য) লেখালেখি করতেন সেটি গলগল করে স্যারকে শোনালাম। স্যার খুবই খুশি হলেন। আমাদের জন্য দোয়া করলেন এবং দেখা করার উদ্দেশ্য জেনে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।
মজলিশপুর থেকে দামপাড়া হয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম। ততক্ষণে জুম্মার সময় হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি গোসল করে মসজিদে গেলাম। দীর্ঘদিন যাবত এই মসজিদে নামাজ পড়া হয় না। নিকলী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতিতে ভরপুর এক পবিত্র জায়গা। মসজিদে দেখা হলো হারুন ভাইয়ের সাথে। তিনি সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির ব্যানারে অংশ নিয়েছিলেন। তিনিও আমাদের চলমান প্রকাশনায় লেখা দিয়ে সহযোগিতার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেন।
দুপুরের খাবার খেয়ে ব্যাগসহ আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করলাম। আসার পথে অতিগুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করলাম।
নিকলী উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশনা সংক্রান্ত অফিসিয়াল চিঠি পৌছে দিলাম। তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে আমাকে পরামর্শ দিলেন। কিভাবে প্রকাশনাটি আরো সমৃদ্ধ করা যায়, কার কার সাথে যোগাযোগ করা যায়, পরবর্তী পদক্ষেপ কি কি হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। উনার সহধর্মিনী নিকলী কলেজের প্রিন্সিপাল পারভিন আপাও প্রকাশনায় লেখা দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। দুপুরের এ সময়টায় সাধারণ সবাই বিশ্রামে থাকেন। কিন্তু ব্যস্ত মানুষ দু’জনই আমাকে ক্লান্তিহীনভাবে সঙ্গসহ নানান পরামর্শ দিলেন। আপ্যায়ন করলেন বিশেষভাবে অর্ডার করে বানিয়ে আনা মিষ্টি দিয়ে। মিষ্টি খাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিলো না। একবার চামচ কেটে মুখে নিতেই বাকিগুলো শেষ করতে তেমন সময় নিলাম না। সত্যিই খুবই মজাদার। কোনো ভেজাল নেই। আগে তেমন একটা জানতাম না দামপাড়া বাজারের মিষ্টির কারিগররা এত ভালো মিষ্টি বানাতে পারেন।
উপজেলা চেয়ারম্যান মহোদয়ের বাসা থেকে বের হয়ে দ্রুততার সাথে পৌছলাম বন্ধু কাশেমের বাড়িতে। একরকম জোর করেই বললাম খাবার পরিবেশনের জন্যে। কাশেম ও তার গিন্নি কিন্তু আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন খাওয়ানোর জন্য। জুম্মার নামাজ শেষে দুপুরের খাবারটা একসাথে খাওয়ার অফার আগেই করেছিলো কাশেম। হলো না। তাই এই সুযোগটা আর হাতছাড়া মন চাইলো না। হাঁসের গোশত, ডিম ভাজা, আলুর (জামাই পলা) ভাজি, ডাল এবং ঘন (হলুদ রঙের) গরুর দুধ দিয়ে খাওয়ালেন কাশেম-ভাবি।
এদিন বাদ আসর মরহুম আবদুল হামিদ স্যারের স্মরণ সভা ও মিলাদ মাহফিলে অংশ নিই। আনুষ্ঠানিকতা শেষে ট্যুরের সর্বশেষ দেখা করি সুইজারল্যান্ড প্রবাসী শ্রদ্ধেয় কারার কাউসার ভাইয়ের সাথে। তাকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিই। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সুইজারল্যান্ড শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ছুটি কাটাতে এসেছেন বাড়িতে। আমাদের নিকলী ডটকম-এর বিশেষ প্রকাশনায় লেখার পাশাপাশি এটিকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরামর্শ দেন।
দুই দিনের কিশোরগঞ্জ ও নিকলী ট্যুর করে আরো একটা বিশেষ অর্জন হলো। আমার আব্বা সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন দেখে অনেক ক্ষেত্রেই আব্বাকে নতুনভাবে চিনলাম। দেখা হওয়া বিশিষ্টজনদের প্রায় সবাই আব্বার সরাসরি স্টুডেন্ট ও স্নেহভাজন। বিষয়বস্তুর বাইরে গিয়ে প্রায় সবাই আব্বার বিভিন্ন গুণের কথা যখন বলছিলেন তখন অনেক গর্ববোধ হচ্ছিলো। বেশ কিছুদিন যাবত আব্বার দেয়া ছোট ছোট শিক্ষাগুলো বার বার মনে পড়ছিলো। এরই মধ্যে বিশিষ্টজনদের কথাগুলো আরো গভীরভাবে ভাবিয়ে তুললো আমাকে। তিনি কুতুব উদ্দিন মীর, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক। আমার আব্বা। আমার অহঙ্কার। আমার জীবনের সেরা শিক্ষক।