ফসলহানির জন্য প্রকৃতি ও কৃষককে দায়ী করলো পাউবো

ইফতেখার মাহমুদ ।।

এ বছর হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানির জন্য প্রকৃতি ও কৃষককে দায়ী করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। গত বছর দায়ী করা হয়েছিল ইঁদুরকে। তবে প্রকৃতি ও ইঁদুরের পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হয়নি। কিন্তু এবার হাওরে ব্যাপক ফসলহানির কারণে পথে বসেছে কৃষক।

পাউবো বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার হাওরে আগাম অতিবৃষ্টি হয়েছে। আর কাটা ধান নৌকায় করে নির্বিঘ্নে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধের আট শ জায়গা কেটে ফেলেন কৃষকেরা। এতেই ধান ডুবেছে, মাছ ও হাঁস মরেছে, ঘর ভেঙেছে।

এবারের মতো ছয় জেলায় একযোগে না হলেও, গত বছর প্রায় একই ধরনের ঢল নেমেছিল সুনামগঞ্জে। এতে ডুবে নষ্ট হয়েছিল প্রায় ২ লাখ টন ধান। তখন পাউবো বেশিরভাগ দোষ চাপিয়েছিল ইঁদুরের ওপর। দুষ্টু ইঁদুরের দল নাকি হাওরের বাঁধ ফুটো করে দিয়েছিল। আর ওই ফুটো দিয়ে পানি ঢুকে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়।

পাউবো প্রকৃতি আর ইঁদুরের ঘাড়ে দোষ দিলেও সরকারের অন্য সংস্থাগুলো বাঁধ নির্মাণে গাফিলতির জন্য বরাবরই পাউবোর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের দুর্নীতিকে দায়ী করে আসছে। কিন্তু পাউবো অন্যদের তদন্ত প্রতিবেদনকে আমলেই নেয় না। তারা নিজেরা তদন্ত করে বারবার ইঁদুর আর প্রকৃতির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।

গত বছরের এপ্রিলে বাঁধ ভাঙার কারণ খুঁজতে পরিকল্পনা কমিশন ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) দুটি তদন্ত কমিটি করেছিল। বাঁধ মেরামতে পাউবো, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি-অনিয়মকে সরাসরি দায়ী করে প্রতিবেদন দেয় তারা।

পাউবোর একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে প্রধান করে গত বছর যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তার প্রতিবেদন গত বছরের এপ্রিলে জমা দেয়া হয়। এতে হাওরে বাঁধ ভাঙার কারণ হিসেবে প্রধানত ইঁদুরকে দায়ী করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৭টি হাওরের বাঁধের মধ্যে ২৭টিতে ইঁদুর গর্ত করে ফেলায় বাঁধ ভেঙে যায়। আর প্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে।

গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সুনামগঞ্জের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার ও পিআইসির কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ওই প্রকৌশলী আফসার উদ্দীন বেনামে (আত্মীয়ের নামে) কাজ নিয়ে তা ঠিকমতো করেননি। ঠিকাদার ও পিআইসি নিম্নমানের কাজ করলেও তা সময়মতো শেষ করেননি। কিন্তু ঠিকাদারদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ায় কাজ তদারকের দায়িত্বে থাকা পাউবোর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তা এড়িয়ে গেছেন।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে। তিনি বলেন, ‘হাওরের বাঁধ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছি কি না, তা খতিয়ে দেখতে আমরা একাধিক তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটিগুলোর প্রতিবেদন আসার পর আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে এতটুকু বলতে পারি, কোনো দুর্নীতিবাজ ও অনিয়মকারী পার পাবে না।’

গোয়েন্দা সংস্থাটি গত বছর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দীন, উপসহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও শাহ আলম, এসডিও খলিলুর রহমান, পিআইসির সভাপতি আবদুস সালাম, এসএও সজীব পাল, উপবিভাগ-১-এর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ ও এসএও রফিকুল ইসলামকে দায়ী করে। অথচ পাউবো তখন তাঁদের কারোর কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। দোষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ইঁদুরকে।

এ বছর হাওরের বাঁধ ভেঙে ১০-১২ লাখ টন ধান নষ্ট হওয়ার পর চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠলে নড়েচড়ে বসে পাউবো। দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে হইচই পড়ে যাওয়ার পর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দীনকে সুনামগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত অন্য ছয়জন কর্মকর্তা এখনো আগের পদে বহাল।

গত বছর হাওরে বাঁধ নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের খবর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছেও এসেছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তারা পাউবোর কাছে হাওরের কাজের অগ্রগতি, বাঁধ ভাঙার কারণ ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো, তা জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। আর পাউবো ১০ মাস পর অর্থাৎ এ বছর বাঁধ ভাঙার পর তার জবাব দেয়।

দুদক থেকে বলা হচ্ছে, গত বছর যাঁরা বাঁধের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরাই এ বছরের বাঁধ মেরামতের দুর্নীতির সাথে জড়িত। তাঁদের দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে এবার হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলহানি হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য ইতিমধ্যে দুদক থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে। তারা পাউবোর মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদও করেছে।

এ ব্যাপারে পাউবোর মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদককে আমাদের জবাব দিতে কিছুটা দেরি হয়েছে এটা স্বীকার করে নিয়েই বলছি, এ ধরনের ঘটনার তদন্ত করা অনেক কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’ আফসার উদ্দীনকে গতবারই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হলো, অথচ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি—এ প্রশ্নের জবাবে পাউবোর মহাপরিচালক বলেন, চাইলেই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। আর একজন কর্মকর্তাকে হাওর থেকে প্রত্যাহার করার পর নতুন কাউকে দায়িত্ব দিয়ে কাজ বোঝানো কঠিন। সে জন্য আগেরজনকে রাখা হয়েছিল।

হাওরে বাঁধ ভাঙার কারণ হিসেবে ‘ইঁদুর তত্ত্বের’ সাথে অবশ্য একমত নন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাঁধ বিশেষজ্ঞ এ এম এম সফিউল্লাহ। তাঁর মতে, ইঁদুরের কারণে বাঁধের কিছু অংশের ক্ষতি হতে পারে। তবে বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে যাবে এমনটা মনে হয় না। আর বাঁধ যদি সঠিক নকশা অনুসরণ করে বানানো হয়, অর্থাৎ বাঁধের ভেতরে যদি যথেষ্ট পরিমাণে বালু দেয়া হয় আর ইঁদুর ফুটো করলেই তা মেরামত করা হয়, তাহলে বাঁধ ভাঙার কথা নয়।

গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০ কোটি টাকার কাজ ১১৪টি প্যাকেজে বাস্তবায়নের জন্য ই-দরপত্রের মাধ্যমে দেয়ার কথা ছিল। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দীন অসৎ উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ না দিয়ে পছন্দের ব্যক্তিকে কাজ দেন। ঠিকাদারি পাওয়া প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা আগাম কমিশন হিসেবে আদায় করেছেন। এ বিষয়ে আফসার উদ্দীনের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাঁকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।

গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাউবোকে হাওরের বাঁধ মেরামতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ওই সময়ের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়। পাউবোর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন বলে জানা যায়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ২৬৮ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ পুনরাকৃতির জন্য ৫০ কোটি ও ৯৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ডুবন্ত ভাঙা বাঁধের ভাঙা অংশ বন্ধকরণ ও মেরামত করতে বাকি ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ তো শেষ হয়ইনি, বরং কাজ না করে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের (হ্যাপ) সদস্যসচিব আনিসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গত বছর, এর আগের বছর এবং এ বছর হাওরের বাঁধ মেরামতের কাজ পর্যবেক্ষণে গিয়েছিলাম। কোনোবারই আমরা ইঁদুরের কারণে বাঁধ ভেঙেছে বলে প্রমাণ পাইনি। বরং বাঁধ নির্মাণে ত্রুটিপূর্ণ নকশা, কাজের গাফিলতি ও দুর্নীতির যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি। আগেরবারের দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এবার এত বড় বিপর্যয় হতো না।’ তিনি হাওরের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

সূত্র : সব দোষ ইঁদুর আর প্রকৃতির! (প্রথম আলো, ১৪ মে ২০১৭)

Similar Posts

error: Content is protected !!