ইটনায় ধ্বংস হতে চলেছে আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটা

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে ।।

ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটা এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এই সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি গত ৫১ বছর ধরে বেদখলে আছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা আর ভূমি বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতায় লিজের নামে বাড়িটি দখলে রেখেছেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তির পরিবার। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে আনন্দমোহন বসুর এ জন্মভিটা সংরক্ষণের জন্য এলাকাবাসী ও সুধীজনদের দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন আর অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।

কয়েক একর আয়তনের বাড়িতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়ি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্মস্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শনার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে।

হাওরের প্রত্যন্ত গ্রাম জয়সিদ্ধিতে ১৮৪৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আনন্দমোহন বসু। ১৯০৬ সালের ২০শে আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে ভুগে কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ কর্মযোগী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গীয় রেনেসাঁর উত্তরণে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং উপমহাদেশের প্রথম ও একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ কীর্তিমান এ মানুষটির শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও তিনি অনন্য এক ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বসু পরিবার কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের পর জমিদারি গ্রহণ উচ্ছেদ আইনে ১৯৬৬ সালের ১৬ই জুন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব বসু পরিবারের সম্পত্তি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করেন। ওই সময় বসুবাড়ির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা তৈরি করে জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন কাউন্সিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আমির উদ্দিনকে বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। এরপর থেকে বাড়িটিতে প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে ৯৯ বছরের কথিত লিজের নামে ওই পরিবার বসু পরিবারের বাড়ি ও সম্পত্তি নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। এভাবে দীর্ঘ ৫১ বছর ধরে বেদখল হয়ে আছে আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটা।

আনন্দমোহন বসু সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা গেছে, আনন্দমোহন বসুর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু এবং মাতার নাম উমা কিশোরী দেবী। আন্দমোহন বসুর পিতা পদ্মলোচন বসু শিক্ষাজীবন শেষে ময়মনসিংহ সিটি কালেক্টরেটে চাকরি নেন। ময়মনসিংহ শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ছিল আনন্দমোহন বসুর ময়মনসিংহের পৈতৃক নিবাস। দারুণ মেধাবী আনন্দমোহন বসু ১৯৬২ সালে হার্ডিঞ্জ স্কুল (বর্তমান ময়মনসিংহ জিলা স্কুল) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। পরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে উত্তীর্ণ হন। সে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি লাভ করেন। ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি পাওয়ার সুবাদে তিনি উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ইংল্যান্ডে ক্যাম্ব্রিজের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে তিনি উচ্চতর গণিত বিষয়ে লেখাপড়া করেন। ১৮৭৪ সালে সেখানে গণিত বিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণী অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘র‌্যাংলার’ উপাধি লাভ করেন আনন্দমোহন বসু। ওই বছরই বার-এট-ল ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন এবং আইন ব্যবসা শুরু করেন। এর আগে ছাত্রাবস্থায় তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা অর্থাৎ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সহোদরা ‘স্বর্ণপ্রভা দেবী’কে বিয়ে করেন।

‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’-এর নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সিটি কলেজ’ ও ‘সিটি স্কুল’ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজ এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহের পৈতৃক বাড়িটি দান করে ১৮৮৩ সালে ‘সিটি কলেজিয়েট স্কুল’-এর কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এটির নাম ছিল ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ বিদ্যালয়ে শহরের সর্বাধিক ৬০৯ জন ছাত্র ছিল। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সিনেট সদস্য এবং শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহে কোনো কলেজ না থাকায় ১৮৯৯ সালে ‘ময়মনসিংহ সভা’ ও আঞ্জুমানিয়া ইসলামিয়া’ আনন্দমোহন বসুর কাছে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। ১৯০১ সালে তিনি ‘সিটি স্কুল’টিকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন এবং ১৯০৮ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘আনন্দমোহন কলেজ’।

আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটা উদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকাবাসী দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু সংরক্ষণ দূরে থাক উল্টো অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তাঁর পূর্বসূরিদের বসতবাড়ি। দখলদারের ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে বিখ্যাত এ মনীষীর জন্মস্থানটিকে দখলমুক্ত করে সংরক্ষণের দাবি আজো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের বাড়িটি উচ্চ আদালতের আদেশের পর উদ্ধার হওয়ায় আবারও আশায় বুক বাঁধছেন তারা। তাদের প্রত্যাশা, আনন্দমোহন বসুর জন্মভিটাটিকে উদ্ধার করে এটি সংরক্ষণ করতে সরকার শিগগিরই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

সূত্র : র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসু’র বেহাল জন্মভিটা (মানবজমিন, ২৯ মে ২০১৭)

Similar Posts

error: Content is protected !!