যেভাবে হয়ে উঠলেন আজকের জেমস

মাহতাব হোসেন ।।

পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। ছোট থেকেই হয়ত বাউন্ডুলেপনা পেয়ে বসেছিল তাকে। উত্তরবঙ্গের এই ছেলে নওগাঁর পত্নীতলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় বাবার সাথেই ঘুরে বেড়াতে হতো। বাবা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারমান হলেন আর তাকেও থাকতে হলো চট্টগ্রামে সেখান থেকে মাথায় উঁকি দিল নতুন পাগলামি। আর এই পাগলামিই আজ তাকে বিশ্বের মাঝে তুলে ধরেছে।

সংগীত নিয়ে পাগলামি যথারীতি শুরু হলো। মন কোনোদিকেই নেই সারাদিন হইহুল্লোড়। নাইনে পড়া অবস্থায় তার বাবা যখন বুঝলো ছেলের দ্বারা পড়াশোনা সম্ভব নয় তখন ঘর থেকে তাকে বের করে দেয়া হলো। ঠাঁই হলো চট্টগ্রামের আজিজ বোর্ডিং-এ। আর এই আজিজ বোর্ডিং হয়ে ওঠে তার গানের জগত। আজিজ বোর্ডিং জেমসের জীবনে বিশাল স্মৃতিময় রেখা আলোকপাত করে গেছে। যার কারণে জেমস এখনও স্মৃতিকাতর হন তার অতীতের সে সময়কে নিয়ে।

চট্টগ্রামের মায়া ছাড়তেই হয় জেমসকে। সেই মায়া না ছাড়লে জেমস মূলধারায় আসতে পারতেন না। তারকা হওয়ার জন্য জেমস কখনও গান করেননি, মনের তাগিদ থেকেই মিউজিক নিয়ে পড়ে থাকতেন দুষ্টু ছেলের দলের জেমস। সে সময় তিনি ইংরেজি কাভার গানগুলো করতেন। ৮৬ সালে ঢাকায় এসে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ প্রকাশ করেন। এরপরই আসিফ ইকবালের লেখা ‘অনন্যা’ জেমসের প্রথম একক অ্যালবাম। যেটা বের হয় ১৯৮৭ সালে। যার প্রতিটি গানই অসাধরণ। বিশেষ করে ‘অনন্যা’ কিংবা ‘ওই দূর পাহাড়ে’ গানগুলো বুকের মাঝে সত্যিই কাঁপন জাগায়। তবে এই গান শুনে কারো পক্ষে ধারণা করা সম্ভব হবে না যে গানটি জেমস গাইছেন। তারপর ‘জেল থেকে বলছি’।

জেমসের মিউজিক জীবন শুরু আশির দশকের একেবারে শুরুতে, চট্টগ্রামে। বাবার চাকরিসূত্রে চট্টগ্রামে চলে যান। কিন্তু বাবা যখন ঢাকা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ডিরেক্টর জেনারেল হয়ে চলে আসেন। জেমস থেকে যান চট্টগ্রামে। আজিজ বোর্ডিং-এর ‘বারো বাই বারো’র একটি ছোট্ট রুমে চলে সংগ্রামী জীবন। সামনের একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া আর সন্ধ্যায় চলে যেতেন আগ্রাবাদের হোটেলে।

সেখানের নাইটক্লাবে বাজাতেন-গান করতেন। ‘ফিলিংস’-এর ভোকাল ছিলেন আরেক অসাধারণ প্রতিভাধর কণ্ঠের অধিকারী পাবলো। সে সময় ঘরছাড়া জেমস ও ‘ফিলিংস’ ব্যান্ড যাদের অনুশীলন থেকে শুরু করে থাকা, খাওয়া সব হতো সেই ‘আজিজ বোর্ডিং’-এর এক কামরায়। সেই কামরায় তাঁদের কত বিনিদ্র রাত কেটেছে শুধু গান তৈরির নেশায়।

‘ঝর্না থেকে নদী’, ‘স্টেশন রোড’ অপূর্ব গানগুলোর মাঝে যেখানে জেমস-এর নীরব হাহাকার, প্রেমের আকুতি, অন্যায়ের প্রতিবাদ সব কিছু ফুটে উঠেছে। ৯২ সালে জেমস ভালোবেসে মডেল ও অভিনেত্রী রথিকে বিয়ে করেন এবং ২০০১ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বেনজীরকে বিয়ে করেন। ‘জেল থেকে বলছি’ নিয়ে আসা জেমস ও ফিলিংস আবার ঝলসানি দিয়ে ওঠে। সেটা ১৯৯৩ সাল। আবার জানান দেন জেমস আছেন।

অডিও বাজারে বড় ধরনের একটা ঝাকুনি দিয়ে ‘জেল থেকে বলছি’ নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে ভেরিয়েশন ইমেজ তৈরি করে ফেলে। এই সময়টাকে অডিও বাজারের চরম সফল যুগ বলা হয়। সংগীতবোদ্ধারা তাই বলে। কেননা একই সাথে শীর্ষ আরো দুই শিল্পীর গান তখন দেশ মাতিয়ে রেখেছে। ‘জেল থেকে বলছি’ এক ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির করুণ অনুভূতি ও আর্তনাদ জেমসকে নন-মেটালিক আবেগী ধারার গায়ক হিসেবে পরিচিতি পেতে সহায়তা করে। ১৯৯৫ সালে জেমসের দ্বিতীয় একক বের হয়। ‘পালাবে কোথায়’ অ্যালবামের প্রিয় আকাশী গানটি জেমসকে আরো রহস্যময় করে তোলে।
আমার আকাশী
ফ্রান্কফুটের বইমেলায়
নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমায়
ফ্লোরেন্সে সিসটাইন চ্যাপেলের-
মিকেলাঞ্জেলোর
মহান সৃষ্টির -’পিয়েতা’র সামনে দাঁড়িয়ে
তোমাকে মনে পড়েছে…

সেই বছরে প্রিন্স মাহমুদের প্রথম ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবাম ‘শক্তি’তে দুটি গান করেন। বাংলা ব্যান্ড জগতে নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই জেমস এক উন্মাদনার নাম হয়ে ওঠে। কনসার্টে উন্মাদনা শুরু জেমস থেকেই। জেমস যখন দেশের সংগীতবাজারে আলোচিত নাম সেই সময় তার ভয়াবহ কিছু সমালোচক তৈরি হয়। বিরোধিতা করতে শুরু করে জেমসের গায়কীর ধরনকে। ৯৬ সালে সেই সব সমালোচকদের মুখে ছুড়ে মারেন ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’ অথবা কবি শামসুর রাহমানের ‘সুন্দরীতমা আমার’। সুন্দরীতমা গানটি কবি শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে করা গান যা জেমস অনুমতি নিয়ে করেন। ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো’ তখন পাড়া-মহল্লায় বড়-ছোট সকলের মুখে।

জেমস যে শুধু জেমস এই দুর্লভ সত্য প্রতিষ্ঠিত করেন ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’। এই অ্যালবাম এতটাই শ্রোতাপ্রিয়তা পায় যে ব্যান্ড বলতে যাদের নাক সিঁটকে যেত সেই মুরব্বিরাও মনোযোগ দিয়ে শুনলেন দুঃখিনী দুঃখ করোনা। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে জেমস স্থান করে নেয়, স্থান করে নেয় পাড়ার রকের আড্ডাবাজদের মনে। অনেকেই বলেন এই অ্যালবামের ‘যদি কখনও ভুল হয়ে যায়’ গানটি জেমস-এর সর্বকালের সেরা একটি গান। কেননা এই গানে জেমস-এর আবেগ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে কোনো মানুষের চোখে জল আনতে বাধ্য করতো।

‘লেইস ফিতা লেইস’ অ্যালবামটি ব্যানারে সর্বশেষ অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘সিনায় সিনায় লাগে টান’ গানটা শ্রোতাদের হৃদয়ের খুব গভীরে পৌঁছেছে। সেই সময়ের সেরা সব গীতিকার- লতিফুল ইসলাম শিবলী, বাপ্পি খান, দেহলভি, আনন্দ, তরুণ, মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ, প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবুদের জেমস-এর জন্য আলাদাভাবে গান লিখতে হতো। কেননা জেমসের গানটা শুধুমাত্র সুর নির্ভর নয় তারচেয়ে বহুগুণ বেশি কথা নির্ভর।

জেমসের কিছু গান যেগুলো না উল্লেখ করলেই নয়। প্রিন্স মাহমুদের সুর ও সংগীতের মিক্সড অ্যালবামের ‘বাংলাদেশ’ (পিয়ানো), তাজমহল গড় (পিয়ানো), ‘জানালা ভরা আকাশ’ (শক্তি), ‘আমি ও আঁধার’ (শক্তি), ‘শেষ দেখা’ (শেষ দেখা), ‘মা’ (এখনও দু চোখে বন্যা), ‘ফুল নিবে না অশ্রু নিবে’ (দেয়াল), ‘মন আমার পাথরের দেয়াল তো নয়’ (দেয়াল), ‘কিছু ভুল ছিল তোমার’ (দাগ থেকে যায়)’ নিষ্পাপ আমি’ (স্রোত), স্যার (দীর্ঘশ্বাস) আত্মহত্যা পাপ (যন্ত্রণা), দহন অ্যালবাম। জুয়েল বাবুর সুর ও সংগীতে ‘ওরে দেখে যারে তুই’ (মেয়ে), ‘পদ্ম পাতার জল’ (ও আমার প্রেম), ‘আরও কিছুক্ষণ রবে কি বন্ধু’ (নীরবতা), সাদা কালো (নীরবতা), ‘কিছুটা আশা তুমি রেখো” (নীরবতা), ‘বর্ষা আমার চোখের প্রিয় ঋতু (সন্ধি), ‘যত দূরে যাও বন্ধু আমার’ (তারকা মেলা), লাকি আখন্দ এর সুর ও সংগীতে ‘লিখতে পারি না কোন গান’ (বিতৃষ্ণা জীবনে আমার), ‘ভালবেসে চলে যেও না’ (বিতৃষ্ণা জীবনে আমার), শফিক তুহিনের সুর ও কথায় শূন্য করে বুক, বৈশাখী ঝড়ে (সারেগামা) সহ আরও অনেক অনবদ্য অসাধারণ সব গান আজো সে যুগের এবং এ যুগের শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরে।

লতিফুল ইসলাম শিবলী, বাপ্পি খান, আসাদ দেহলভি, আনন্দ, তরুন, মারজুক রাসেল, গোলাম মোরশেদ লায়ন, প্রিন্স মাহমুদ ও রনিম জেমস-এর জন্য আলাদাভাবে গান লিখতেন। যে গানের কথাগুলো ছিল ভিন্নধর্মী। কাব্য নির্ভর কথা। গানের কথায় গভীরতা ছিল বলেই জেমস অনন্য, জেমস আলাদা। আর তার গানের গীতিকারদের এখনো সবাই সমীহ করে চলেন। আসাদ দেহলভীর সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন পরে বিচ্ছেদ এই অভাব বুঝতে দেননি প্রিন্স মাহমুদ। আফসোসের ব্যাপার গোলাম মোরশেদ লায়ন এখন সংগীত থেকেই দূরে। তবে জেমসের গান সবচেয়ে বেশি লিখেছেন যিনি তাঁর নাম রাজীব আহমেদ। ‘ঠিক আছে বন্ধু’ কিংবা ‘দুষ্ট ছেলের দল’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান তাঁরই লেখা।

মিলেনিয়াম পরবর্তী সময়জুড়ে জেমসের অনেক হিট গান এসেছে রনিমের লেখনি থেকে। ‘আমি এক দুঃখওয়ালা’, ‘আগামীকাল আমার শততম দুঃখ বার্ষিকী’, ‘ঘুমে ঘুমে পালকি চড়ে’, ‘রাজকুমারী’, গান গাও, ‘নায়ক আমি’, ‘চাঁদের হাতে লিখেছ কাহার নাম’ এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান লিখছেন রনিম রহমান। জেমস ঢেলে কথার ওপর ঢেলে দিয়েছেন নিজস্ব দরদ। যার ফলে ঘুমে পালকি চড়ে গানটি আধ্যাত্মিক রুপে অজস্র অর্থ সরবরাহ করে দেবে শ্রোতার কানে। ‘আমি এক দুঃখওয়ালা’র কল্যাণে এখনো কত শত দুঃখওয়ালা আনমনে গেয়ে যায় ‘অধিক সুখের বিনিময়ে কেউ দুঃখ বেচতে পারো।’

‘জেমস’ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেরও একটি প্রিয় গায়ক রূপে পরিচিত হয়েছেন। ২০০৬ সালে ভারতের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় প্রযোজক, পরিচালক মহেশ ভাট-এর ‘গ্যাংস্টার’ ছবিতে ‘ভিগি ভিগি’ গান দিয়ে হয়েছেন ভারতের কোটি জনতার প্রিয় শিল্পী। এরপর একই প্রযোজকের ‘ওহ লামহে’ ‘মেট্রো’ ছবিতেও কণ্ঠ দিয়ে চমকে দিয়েছেন পুরো ভারতকে। সর্বশেষ ওয়ার্নিং সিনেমায় টাইটেল সং ‘বেভাসি’ ধারাবাহিকতা ঠিক রাখার সাথে নিজের জনপ্রিয়তাকেও উর্ধ্বমুখী করছেন।

হিন্দি ছবির প্লে-ব্যাকে ধারাবাহিক সাফল্যের পর এবার জেমস ফিরছেন হিন্দি অডিও অ্যালবামের মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে মুম্বাই স্টুডিওতে রেকর্ড করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিজের জনপ্রিয় গানগুলোর হিন্দি ভার্সন, যা অনেক দিন ধরেই করার কথা চলছিল। যে গানের তালিকায় থাকছে মা, মীরা বাই, তেরো নদী সাত সমুদ্দুর, দুখিনি দুঃখ, যেদিন বন্ধু, জেল থেকে বলছিসহ জনপ্রিয় ১০টি গান।

আজকের বিশ্বতারকা জেমসের দুঃখ জেমসের সাফল্য বাবা-মা কেউই দেখে যেতে পারেন নাই। আর তাইতো তাঁর কণ্ঠে ‘বাবা কতদিন দেখি না তোমায়’ কিংবা ‘মা’ গানে এতটা দরদ ঝরে পড়েছে। দেশের সব ধরনের শ্রোতাদের এই গান স্পর্শ করে যায় এখনও।

সূত্র : যেভাবে তৈরি হলেন আজকের জেমস (কালের কণ্ঠ, ২ অক্টোবর ২০১৬)

Similar Posts

error: Content is protected !!