আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
বিশ্বে সৌরশক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বিশ্বে ৬০ লাখ সৌর প্যানেলের মধ্যে ৪০ লাখই বাংলাদেশে ব্যবহার করা হয়। ‘রিনিউয়েবলস ২০১৭ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট’-এ এসেছে এই তথ্য।
বাংলাদেশের দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলা। ঢাকা থেকে সড়ক পথে দূরত্ব ২৮৭ কি.মি.। সেখান থেকে আরো ৭৫ কি. মি. দূরে চরফ্যাশন উপজেলা। সেই উপজেলার দক্ষিণ আইচা এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাকির হোসেন তালুকদার সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন গত ৬ বছর ধরে। তিনি তার বাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুই জায়গাতেই প্যানেল বসিয়েছেন।
জাকির যখন সৌরবিদ্যুৎ নেন, তখন এলাকায় বিদ্যুতের কোনো সংযোগ ছিল না। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ আসার পরও সৌরবিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়নি তার কাছে। তার কথায়, ‘‘বিদ্যুৎ তো সব সময় থাকে না, তখন সৌর বিদ্যুৎই ভরসা।’’
একটি প্যানেল বসাতে তখন ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল তার। তবে সেই টাকা তিনি কিস্তি সুবিধা নিয়ে শোধ করেছেন। জাকির জানালেন, ‘‘ওই একবারই খরচ। আর কোনো খরচ নাই। আমি ৬-৭টি বাতি জ্বালাই। ফ্যান চালাই। টিভিও চালানো যায়। ২০ বছরের ওয়ারেন্টি আছে।’’
চরফ্যাশনের প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই এখন সৌরবিদ্যুৎ আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও ব্যবহার করা হয় এই বিদ্যুৎ।
রিনিউয়েবলস ২০১৭ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ সৌরশক্তির প্যানেল রয়েছে। এছাড়া ক্লিন স্টোভ ও বায়োগ্যাস ব্যবহারেও সামনের দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। এতে প্রচুর কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে ৫ম স্থানে রয়েছে।
২০১৬ সাল থেকে বিশ্বে ৬০ লাখেরও বেশি স্থানে সৌরশক্তি ব্যবহার চলছে, আর এতে উপকৃত হচ্ছে আড়াই কোটি মানুষ। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি সৌরশক্তির প্যানেলে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। এর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।
প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরইএন এই প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের অর্থায়ন করেছে জার্মানির অর্থনৈতিক সহায়তা ও উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক বিষয় ও বিদ্যুৎ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রকল্প এবং ইন্টার-অ্যামেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিপি)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘মিনি গ্রিড ও স্ট্যান্ড অ্যালোন দুই ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে বাংলাদেশ। মূলত ক্ষুদ্রঋণের কারণেই প্রায় ৪০ লাখ সৌরশক্তি প্যানেল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।’’ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই বেশ কিছু আফ্রিকান দেশ রয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমানে দেশের ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পাওয়ার গ্রিড দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রক্রিয়া অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। জাতীয় গ্রিড পৌঁছায় না এমন স্থানেই ওই ৪০ লাখ সৌরশক্তি প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬ কোটি মানুষের কাছে বিদ্যুৎ এখনো পৌঁছায়নি বলে রিপোর্টে দাবি করা হয়।
২০১২ সালে এই খাতে ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছিল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে তা দাঁড়ায় ১৫৮ মিলিয়ন ডলারে। আর ২০১৬ সালে সেটা হয় ২২৩ মিলিয়ন ডলার। নতুন অর্থ বছরে সৌরশক্তি ব্যবহারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করায় এই খরচ আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ জনপ্রিয় করার পিছনে প্রথম থেকেই কাজ করেছে গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শক্তি। গ্রামীণ শক্তির তখনকার প্রধান দীপাল সি বড়ুয়া এখন নিজেই একটি সৌরশক্তি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ব্রাইট গ্রীণ এনার্জি ফাউন্ডেশন’। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৯৬ সালে আমরা সোলার হোম সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন দেশের ১৫ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেতো। আমরা ১০ হাজার সিস্টেম ইনস্টল করার পর বিষয়টি নজরে আসে। বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলকে ফান্ড দেয় বিশ্বব্যাংক। এখন মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে।’’
দীপাল সি বড়ুয়া আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রধান সুবিধা হলো সব মৌসুমেই সূর্যের আলো পাওয়া যায়। ফলে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সহজ। শুরুতে হোম প্যানেলের দাম অনেক বেশি থাকলেও এখন ৭-৮ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এখন ১০ ধরণের সোলার এনার্জি সিস্টেম আছে। যে যার চাহিদা অনুযায়ী বসাতে পারেন।’’
তিনি জানান, ‘‘বাড়ির ছাদে সৌরশক্তি প্যানেলগুলো সূর্যের আলো থেকে শক্তি নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুবিধা হলো এই যে, এরা ছোট বা বা বড় দু’রকমই হতে পারে। বাড়ির ছাদে ৫ কিলোওয়াট বা ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো যায়। এর মাধ্যমে সৌরকোষের সাহায্যে সৌরআলোককে সরাসরি বিদ্যুতে পরিণত করা হয়।’’
অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব চুলা (ক্লিন কুকিং স্টোভ) ব্যবহারে বাংলাদেশে বিশ্বে ৫ম স্থানে রয়েছে। ২০১৪ সালে এমন পাঁচ লাখ চুলা স্থাপন করা হয়। এমন চুলা আমদানিতে সরকারি সহায়তার কারণে এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে রিপোর্টে বলা হয়।
২০১৫ সালে ২ কোটি পরিবেশ বান্ধবচুলা সরবরাহ করা হয়। বিশ্বে সবচেয় বেশি ব্যবহার করে চীন। এরপর ভারত, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ।
বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট ব্যবহারেও বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ম স্থানে রয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে ৪৫ হাজার ৬১০টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে।
২০১৬ সালে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নার বিষয়টি বেড়ে গেছে। এশিয়াতেই এই হার অনেক বেশি। সবেচেয়ে বেশি চীনে (৪ কোটি ২৬ লাখ)। এরপর ভারতে (৪৭ লাখ)। এশিয়ায় আরও ৬ লাখ ২০ হাজার বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে।
২০১৬ সালে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গাড়িতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। চলতি বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সৌরশক্তিচালিত তিন চাকার অ্যাম্বুলেন্স দেখা যেতে পারে।
২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সারাবিশ্বেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ১.১ শতাংশ বেড়েছে। আর এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৯৮ লাখ মানুষের।
তথ্য-প্রযুক্তি খাতে সোলার ফটোভোলটাইক ও জৈব জ্বালানি সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে। সারাবিশ্বেই বিশেষ করে এই এশিয়াতে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এই সংখ্যা বেড়েছে ১০ শতাংশ।
সূত্র : সৌরশক্তি ব্যবহারে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ [ডয়েচে ভেলে]