আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।
সাবেক রাষ্ট্রপতি, জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জিল্লুর রহমানের জীবন ও কর্মের ওপর বাংলা একাডেমি ‘বাংলার রাজনীতি ও জিল্লুর রহমান’ শীর্ষক প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।
অধ্যাপক ও সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সেকুল রচিত বইটিতে ষোলটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে জিল্লুর রহমানের ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর পরিবারের পরিচিতি, শিক্ষা জীবন, রাজনীতির জীবন শুরু এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয়ের ঘটনাপ্রবাহ স্থান পেয়েছে। অন্যান্য অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর ভাষা আন্দোলন, আওয়ামী মুসলিম লীগের আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ছয়-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১১-দফার আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক, অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চ গণহত্যা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, প্রবাসী সরকার গঠন ও পরিচালনা, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও সরকার গঠন, বাকশাল গঠন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাসহ ১৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ, খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র, ক্ষমতাদখল ও জেলহত্যাসহ পরবর্তী সরকারগুলোর শাসনামল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার ঘটনাপ্রবাহ বইটিতে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। বাসস
সিলেট সফরে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম পরিচয়ের ঘটনা সম্পর্কে জিল্লুর রহমান তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, ‘সেই সময় আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়ে মুজিব ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। মুজিব ভাই তখন সিলেট সফর করছিলেন। মুজিব ভাইয়ের নাম আগেই জানা ছিল, তার সাথে পরিচয় হয়নি, দেখা হয়নি। একদিন সকাল বেলা গণপ্রচারের উদ্দেশে কিছু দূর গিয়ে দেখলাম সামনে কিছুসংখ্যক মওলানা লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করছে। তৎকালীন সময়ে জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ নামক একটি রাজনৈতিক সংগঠন ছিল। যার নেতা ছিলেন হোসাইন আহমদ মাদানী। লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণের ফলে গতানুগতিকভাবে যা হবার তাই হলো। সভাটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। লক্ষ্য করে দেখলাম দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি তুলে ধরে রুখে দাঁড়িয়ে বললেন ‘কে আসবি আয়।’ একটি লোকের বজ্রকণ্ঠের চ্যালেঞ্জের সামনে মওলানারা উল্টো দিকে পালিয়ে যায়। ততক্ষণে আমরা সভাস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম। লক্ষ্য করে দেখলাম, সেই ব্যক্তিটিই মুজিব ভাই। আমি তার কাছে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করি। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন, মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা ও কথা হবার পর থেকে সক্রিয় রাজনীতির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায় এবং তখন থেকেই মূলত রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে প্রবেশ করি’।
জিল্লুর রহমানের ছাত্রজীবনে রাজনীতির বিষয়ে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, ‘ছাত্রনেতা হিসেবে জিল্লুর রহমান সাহেবের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ফজলুল হক হলের ছাত্রদের মধ্যে ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের জনপ্রিয়তা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্যাবিনেটের সমস্ত সদস্যসহ ১৯৫৩ সালে ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর কারণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আন্দোলনে বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে তার অবদান।’
বইয়ের ষোলটি পর্বের রচনাগুলো হচ্ছে- ব্রিটিশ ভারতে বাংলার রাজনীতি এবং জিল্লুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা, পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার রাজনীতি এবং ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে জিল্লুর রহমানের ভূমিকা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং জিল্লুর রহমানের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমল, খন্দকার মোশতাক সরকারের শামনামল, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামল ও বেসামরিকীকরণ, বিচারপতি সাত্তার সরকারের শাসনামল, এরশাদের সামরিক শাসনামল ও বেসরকারিকরণ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সরকারের আমল, খালেদা জিয়া সরকারের (প্রথম ও দ্বিতীয়) শাসনামল, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমল, বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল, খালেদা জিয়া সরকারের (তৃতীয়) আমল, রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল, সেনাসমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল। এসব পর্বে জাতীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় জিল্লুর রহমানের কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বইয়ের লেখক সাইফুল ইসলাম মুখবন্ধে বলেন, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানকে যিনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে মূল্যায়ন করে বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে উৎসাহ দিয়ে গ্রন্থটি রচনায় সহায়তা করেছিলেন।’ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বইটি গত এপ্রিল মাসে বাংলা একাডেমির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের আওতায় একাডেমির গবেষণা, সংকলন, অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়। চারশ’ ষোল পৃষ্ঠার বইটির প্রকাশক হচ্ছেন একাডেমির পরিচালক মোবারক হোসেন। বইটি নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত বেগম আইভি রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
প্রকাশক মোবারক হোসেন বাসসকে বলেন, একাডেমির বিশেষ কার্যক্রমের আওতায় এ বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। বইটিতে সাবেক রাষ্ট্রপতির জীবন ও কর্মসহ তাঁর শিক্ষা, সংগ্রাম, স্বাধীনতার আন্দোলন এবং স্বাধীনতার পর তাঁর সকল কার্যক্রম বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। পাশাপাশি বৃটিশ আমল থেকে এ দেশের রাজনীতির চিত্রও স্থান পেয়েছে।