আবদুল্লাহ আল মহসিন ।।
মিঠাপানির অন্যতম উৎস এদেশের, নদী, নালা, খাল-বিল, ডোবা, হাওর-বাওর। কিশোরগন্জে হাওরবেষ্টিত উপজেলা নিকলী, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা। উল্ল্যেখিত উপজেলায় হাওরের আয়তন প্রায় ১১ হাজার ৭৫২ হেক্টর জায়গা পরিমাণ। এক সময় এই হাওর ছিল মিঠা পানির মাছের ভান্ডার, আর দেশী মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। একটা সময় ছিল যখন হাওর, নদী, খালে, বিলে দেশী মাছের লাফালাফির দৃশ্য চোখে পড়তো। কিন্তু এখন আর আগের মত হাওরে মাছের সেই পরিচিত দৃশ্য চোখে পড়ে না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা উৎসব আর আনন্দমুখর পরিবেশে মাছ ধরতো। দলবেধে পলো দিয়ে মাছ ধরার জন্য শত মাইল পথ পাড়ি দিতো হাওরের পথে। বিশেষ করে আশ্বিণ ও কার্তিক মাসে হাওরে মাছ ধরার উৎসবটা বেশি ছিল।
কুণী জাল, কড়াজাল, ঠেলা জাল, টাকজাল, বান্দরী জাল, আর নানান ফাদে ফেলে মাছ ধরা হয় হাওরে। কিন্তু বর্তমানে হাওরে দিনে দিনে দেশী মাছের প্রজাতি কমে যাচ্ছে। মাছের বাজারে গেলে দেশী মাছ কম পাওয়া যায়। হাইব্রীড মাছ আর বিদেশী মাছে ভরে গেছে সব। গবেষকদের দাবী, মিঠাপানির হাওরে প্রায় ২৬০টি প্রজাতির মাছ রয়েছে। এর মাঝে ১২টি প্রজাতির মারাত্মকভাবে বিপন্ন, আর ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হওয়ার হুমকীর সম্মুখীন।
মৎস গবেষণা ইনষ্টিটিউটের মতে বর্তমানে ৫৪ প্রজাতির দেশী মাছ চরম বিপন্ন হওয়ার পথে। আর চরম সংকটাপন্ন রয়েছে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগৃহীত তথ্য ও গবেষণা মতে দেশী প্রজাতি মাছ বিলুপ্ত হওয়ার সংখ্যা আরো বেশী। তারা বিপন্ন হওয়ার মাছের প্রজাতি ১০০ এর অধিক বলেছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা ৫৪ প্রজাতির মাছকে বিপন্ন ঘোষণা করেছে।
বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডান কিনে, চিতল, ঢিলা, খোলসে, কানিবাউস, আইড়, বাছা, টেংরা, শালবাইন, কানিপাবদা, মধুপাবদা, চেকা, কৈ, গজার, তিতপুঁটি, তারাবাইন, মাগুর, শিং, টাকি, চান্দা, চাপিলা, গোতুম, কাকিলা, রানী, ভেদা প্রভৃতি। হাওরে যে সকল মাছ আজ হারিয়ে গেছে তার মাঝে উল্ল্যেখযোগ্য হল, নামাবিল, সিন, ভমমাছ, চেলা পাতা, কাশি খয়রা, লালচান্দা, নাঙ্গাটালু, কোরাল, চিনারুল, বিনুশৈল, এলং মাছ প্রভৃতি। আগে হাওর পাড়ে সাধারণ মানুষসহ জেলেরা মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। দেশী মাছের প্রজাতি দিনে দিনে কমতে থাকায় প্রকৃত জেলেরাও বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকে আবার অন্য পেশায়ও জড়িয়ে গেছে।
দেশী মাছের বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে গবেষকরা বহুবিধ কারণ ও মন্তব্য করেন। সূত্র মতে, আশির দশকের প্রথম দিকেও ভূ-প্রকৃতি দেশী মাছ তথা মিঠা পানির মাছের অনুকূল ছিল। বর্তমান বিশ্বায়নের বৈশ্বিক প্রভাব ও অত্যধিক শিল্পের প্রসার প্রকৃতিতেও পড়েছে। তাছাড়া হাওরে আগের মত জলজ উদ্ভিদও নেই। যা প্রাকৃতিক তথা দেশী প্রজাতি মাছের বংশ বিস্তার ও খাদ্যের জন্য অত্যধিক প্রয়োজন। উন্মুক্ত জলাশয়ে বিদেশী মাছ চাষ, নদী-খাল ভরাট, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও কীটনাশক প্রয়োগের কারণেও দেশী মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কিশোরগন্জ জেলা মৎস কর্মকর্তা ডঃ মোঃ মুজিবুর রহমান বলেন, নদী ভরাট, ইন্জিনচালিত নৌকার ফুয়েল পানিতে পড়ে পরিবেশ নষ্টসহ নানা কারণে দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। হাওরে দেশী মাছের আগের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে হলে ডিমওয়ালা মা মাছ মারা বন্ধ করতে হবে। সজীব করতে হবে জলাশয়। হাওরের দেশী মাছ বেচে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সরকারী পর্যায়ে এখনই সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
ছবিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে ফেসবুক গ্রুপ Our Nikli থেকে