নিকলী মানেই সাঁতার!

সুমন মোল্লা ও দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী (কিশোরগঞ্জ) ।।
শুকনো মৌসুমে যেমন-তেমন, বর্ষায় হাওর মানেই বিশাল জলরাশি। ঘর থেকে কয়েক কদম এগোলেই অথই পানি। হাওরের মানুষ সাঁতার শেখে জলের সঙ্গে লড়াই করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে।
তবে হাওর জেলা কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কিশোর-তরুণেরা এখন সাঁতার শিখছেন নিজের খ্যাতি দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে দিতে। সঙ্গে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার বিষয়টা তো রয়েছেই।

বড় সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিকলী উপজেলা পরিষদের পুকুরে অনুশীলনে ব্যস্ত কিশোর-তরুণেরা
বড় সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিকলী উপজেলা পরিষদের পুকুরে অনুশীলনে ব্যস্ত কিশোর-তরুণেরা

এই কিশোর-তরুণদের সামনে সেই উদাহরণ তৈরি করে দিয়েছেন নিকলীর ছেলেরাই—প্রখ্যাত সঁাতারু কারার মিজানুর রহমান ও কারার ছামেদুল ইসলাম। এই উপজেলারই আরও অন্তত ৪৪ জন তরুণ এই সাঁতারেই আলো ছড়িয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। যার সুবাদেই চাকরি মিলেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে। এঁদের মধ্যে আছেন তিন নারীও। বাড়ির পাশে এমন উদাহরণ থাকায় নিকলীর অনেক মা-বাবা এখন তাঁদের সন্তানদের তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় সাঁতার প্রশিক্ষকদের হাতে।

দৃষ্টান্ত ওঁরা

১৯৯৩ সাল। খেলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই সাফ গেমসের আয়োজক ঢাকা। সাঁতার ইভেন্টে নামলেন নিকলীর ১৯ বছরের তরুণ কারার মিজান। বাজিমাত করলেন তিনি। জিতলেন স্বর্ণপদক। ১৯৯৫ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসেও সেই স্বর্ণপদক ধরে রাখার কৃতিত্ব দেখালেন। সেই সুবাদে নৌবাহিনীতে খেলাধুলা কোটায় সৈনিক পদে চাকরি হয় তাঁর। এখন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হয়েছেন তিনি।
২০০১ সাল। পাকিস্তানে আয়োজিত সাফ সুইমিংয়ে নামলেন নিকলীর আরেক তরুণ কারার ছামেদুল। বাজিমাত করলেন তিনিও। সব মিলে জিতলেন চারটি স্বর্ণপদক। তার আগে ১৯৯৯ সালে নেপালে আয়োজিত সাফ গেমসে জিতেছেন রৌপ্য পদক। সাঁতারের সুবাদেই তিনি এখন নৌবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। ছামেদুল আর মিজান সম্পর্কে চাচাতো ভাইও।
‘সাঁতারুর খনি নিকলী’ থেকে সবশেষ উঠে আসা বিস্ময় তরুণের নাম আরিফুল ইসলাম। বাড়ির পাশের এমন সাঁতারুদের দেখে বড় হওয়া আরিফুল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) নবম শ্রেণির ছাত্র। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বয়সভিত্তিক সাঁতারে ১৩টি ইভেন্টের সব কটিতেই স্বর্ণপদক জিতেছে সে! এর মধ্যে গত বছর তিনটিতে করেছে জাতীয় রেকর্ড! আরিফুলের চোখ এখন সাফ গেমসে।
আরিফুলের বড় ভাই শরিফুল ইসলাম ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারে পাঁচটি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। গত বছর জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন পাঁচটি স্বর্ণ পদক। চাকরি করছেন নৌবাহিনীতে।
সাঁতারে নিকলীর তরুণদের খ্যাতির এই গল্প এখানেই শেষ নয়। নিকলীর স্থানীয় দুটি সাঁতার প্রশিক্ষণ ক্লাব, প্রশিক্ষক ও কয়েকজন কৃতী সাঁতারুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাঁতারে কৃতিত্ব দেখিয়ে নিকলী থেকে সেনাবাহিনীতে চাকরি হয়েছে ২৯ জনের। এ ছাড়া নৌবাহিনীতে আটজনের, বিমানবাহিনীতে তিনজনের, পুলিশে তিনজনের আর কারা পুলিশে তিনজনের চাকরি হয়েছে। সাঁতারে কৃতিত্বের সূত্র ধরে একটি উপজেলা থেকে এতজনের চাকরি পাওয়ার কৃতিত্ব বিরল। এঁরা সবাই বয়সভিত্তিক কিংবা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
কৃতী সাঁতারু কারার ছামেদুল বলেন, সাঁতার শিখে নিকলীর অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পাচ্ছেন। বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি পাচ্ছেন। তা দেখে এলাকার অনেক তরুণ-কিশোরেরা সাঁতারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
পেছনের কথা

শুরুটা হয়েছিল নিকলী সদর ইউনিয়নের মীরাহাটি গ্রামের আবুল হাশেমের (৬০) হাত ধরে। আবুল হাশেম সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্থানীয় এক সাঁতার প্রতিযোগিতায় বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চ্যাম্পিয়ন হন। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। আবুল হাশেম জানালেন, পরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে একটি রৌপ্য, ১৯৭৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুটি রৌপ্য এবং একই সালে ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় পাঁচটি স্বর্ণ জিতলেন।
নিকলীর মধ্যে আবুল হাশেমই সাঁতার কেটে প্রথম সাফল্য পান। শুরুর দিকে তাঁকে দেখেই স্থানীয় অনেকেই সাঁতারে আসতে থাকলেন। আর ১৯৯৩ সালে কারার মিজান সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পর সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

 

দুটি প্রশিক্ষণ ক্লাব

কারার মিজান সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পরের বছর ১৯৯৪ সালে আবুল হাশেম নিকলী সুইমিং ক্লাব গড়ে তুললেন। ২০১১ সালে গড়ে ওঠে ভাটি বাংলা সুইমিং ক্লাব। দুটি ক্লাবই বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের অনুমোদন পেয়েছে। নিকলী সুইমিং ক্লাবের সদস্য ও প্রশিক্ষণার্থী ১০৫ জন। ভাটি বাংলার সদস্য ও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ১২০।
নিকলী সুইমিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম ও ভাটি বাংলা সুইমিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কারার তোফায়েল আহমেদ শোনালেন সাঁতারে নিকলীর ছেলেদের গৌরবের গল্প। পরে জানালেন, নৌবাহিনীর পারভেজ আহমেদ জাতীয় পর্যায়ে জুনিয়র মিড সাঁতারে ২০০৫ সালে পাঁচটি স্বর্ণপদক, সেনাবাহিনীর রফিকুল ইসলাম ২০০৮ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুটি স্বর্ণ, সেনাবাহিনীর আনোয়ার হোসেন ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে সাঁতারে তিনটি স্বর্ণপদক পান। সেনাবাহিনীর নিয়ামুল হক ২০০৯ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ ১৯ কিলোমিটার সাঁতারে তৃতীয় স্থান পান। বিকেএসপির ছাত্র নাজমুল হক (২২) ২০০৫ সালে জাতীয় সাঁতারে চারটি স্বর্ণ, ২০০৬ সালে তিনটি স্বর্ণ, ২০০৭ সালে চারটি স্বর্ণপদক পান। সাঁতারই এঁদের সবার জীবন বদলে দিয়েছে।
আবুল হাশেম বলেন, ‘এই সাঁতার আমাদের খ্যাতি দিয়েছে। দেশবাসীর কাছে নিকলীর পরিচয় তুলে ধরেছে।’
সরেজমিনে একদিন

সম্প্রতি ভাটি বাংলা সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষণ দেখতে গিয়ে জানা গেল, তাদের প্রশিক্ষণ চলে নিকলী উপজেলা পরিষদের ভেতরে একটি পুকুরে। স্থানীয় অন্য একটি পুকুরে চলে নিকলী সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষণ।
কথা হলো সাঁতার প্রশিক্ষক, সংগঠক ও প্রশিক্ষণার্থী সাঁতারুদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, নিকলীতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাতো দূরের কথা, ডাইভ দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। প্রশিক্ষণার্থীরা সুইমিং পোশাক, কিকবোর্ড, হ্যান্ড প্যাডেল, ওয়াটার গ্লাস, ওয়াটার ক্যাপ ছাড়াই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। অনেকে আসেন গামছা পরে। আর বর্ষাকালে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ‘প্রকৃতির সুইমিং পুল’ হাওরের পানিতে।
ভাটি বাংলা সুইমিং ক্লাবের সদস্য বিকেএসপির ছাত্র আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সাঁতারে প্রচুর শক্তি ক্ষয় হয়। শারীরিক সামর্থ্যের জন্য উন্নত খাবার গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের সাঁতারুদের অনেকে আসেন না খেয়ে।’
তারপরও সাঁতারে এই হাওরপারের ছেলেদের কৃতিত্ব সম্পর্কে আরিফুল বলেন, নিকলীর সাঁতারুদের মনোবল চাঙা। সঙ্গে একটি তথ্য তুলে ধরেন তিনি—বিকেএসপির সাঁতার বিভাগে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ জন। এর মধ্যে নিকলীরই ১৭ জন।
স্থানীয় সাঁতার প্রশিক্ষক আবদুল জলিলের ভাষায়, সাঁতার জানলেই সাঁতারু হওয়া যায় না। নিয়ম মেনে অনুশীলন করতে হয়।
এখানেই কথা হয় সাঁতার শিখতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে। স্থানীয় স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হিমেল মিয়া ও মাউন মিয়া। হিমেল আন্তস্কুল ও জাতীয় পর্যায়ে বয়সভিত্তিক সাঁতারে ১০টি এবং মাউন পাঁচটি স্বর্ণপদক জিতেছে। তারা জানায়, ভালো সাঁতারু হয়ে পূর্বসূরিদের মতোই সুনাম কুড়াতে চায়।
পিছিয়ে নেই নারীরা

সাঁতার কৃতিত্বে পিছিয়ে নেই নিকলীর নারীরাও। নিকলীর মেয়ে রুমানা আক্তার, প্রিয়াঙ্কা আক্তার ও নাসরিন বেগম সাঁতারে কৃতিত্ব দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি করছেন। প্রিয়াঙ্কা আক্তার ২০১৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে একটি রৌপ্যপদক পান। আর রোমানা আক্তার একই সালে জাতীয় পর্যায়ে পেয়েছেন ১১টি স্বর্ণপদক। তাঁদের দেখেই কিশোরী-তরুণীরাও আসছে সাঁতারে।
ভাটি বাংলা ক্লাবে ১২০ জন সদস্য ও প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে ২২ জন নারী। আর নিকলী সুইমিং ক্লাবে সদস্য ও প্রশিক্ষণার্থী ১০৫ জনের মধ্যে ১৯ জন নারী।
কথা হয় অনুশীলন করতে আসা সাঁতারু রেহেনা আক্তারের সঙ্গে। রেহেনা এবার নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। ছেলেদের পাশাপাশি নারীদের সাঁতার প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে কোনো সমস্যা হয় কি না, এমন প্রশ্নে রেহেনা জানান, আগে হতো, এখন হয় না। কারণ, সবাই বুঝতে পারছে, সাঁতার শিখলে অনেক কিছু পাওয়া যায়।

 

তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০১৫

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!