নিয়ত শুদ্ধ হওয়া জরুরি

এইচ এম আব্দুর রহিম ।।

নিয়ত অর্থ সঙ্কল্প। এটি মনের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি আমল। এতে নেই কোনো কষ্ট-ক্লেশ, নেই কোনো মেহনত-মুহাজাদা। প্রতিটি কাজ দ্বীনি হোক কিংবা দুনিয়াবি, শুরুতেই নিয়তকে শুদ্ধ করা জরুরি। সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করার সঙ্কল্প হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত। এই নিয়ত মুমিন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব কাজকে নেকির কাজে পরিণত করতে পারে। হজরত উমর ইবনে খাত্তাব রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী করিম সা:কে বলতে শুনেছি, নিশ্চয়ই সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যার নিয়ত সে করবে। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া লাভের জন্য কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত ওই বিষয়ের জন্য হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছিল’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদিস। এ কারণে নবীজী সা: শিক্ষা দিয়েছেন যে, প্রত্যেক আমল করার জন্য নিয়ত জরুরি। শুধু আমল নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের নিয়তের ওপর প্রতিদান দেয়া হবে। বোঝানোর জন্য নবী সা: হিজরতের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথা বলেছেন। একজন মুহাজির হিজরতের পূর্ণ প্রতিদান পায়। পক্ষান্তরে অন্য ব্যক্তি বাহ্যত একই আমল করার পরও বঞ্চিত হয়। এর নিগূঢ় রহস্য তিন অক্ষরের নিয়ত শব্দের মধ্যে নিহিত রয়েছে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্যের উদ্দেশ্যে হিজরত করবে তার হিজরত হবে মকবুল ও প্রতিদানযোগ্য। সে পাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অশেষ সওয়াব। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পার্থিব কোনো উপকার যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা প্রেয়সী নারীকে বিয়ে করার নিয়তে স্বজন ও স্বদেশ ত্যাগ করে বাহ্যত তা হিজরত হলেও তা হবে ব্যর্থ ও প্রতিদানের অযোগ্য। একই কষ্ট ও মুজাহাদা করার পরও মুহাজিরের পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবে। এই হাদিস থেকে নিয়তের গুরুত্ব ও ফজিলত জানা গেল। উত্তম নিয়তের কারণে মানুষ আমলের সওয়াব পাবে।
পক্ষান্তরে নিয়তের ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার কারণে সে হবে প্রশ্নের মুখোমুখি। নবী সা: বলেছেন, ‘কেউ একনিষ্ঠ মনে শাহাদতের প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দান করবেন। যদিও সে স্বীয় বিছানায় মৃত্যুবরণ করে’ (সহিহ মুসলিম)। আরেকটি হাদিসে তাবুক যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘মদিনায় এমন কিছু মানুষ রয়েছে (তাবুক পর্যন্ত) প্রতিটি পথে প্রান্তরে; প্রতিটি টিলা-টক্করে যারা তোমাদের সাথেই ছিল। তারাও তোমাদের মতো জিহাদের সওয়াব লাভ করবে। কারণ পূর্ণ নিয়ত থাকা সত্ত্বেও অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজর তাদের জিহাদে অংশ নিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে’ (সহিহ মুসলিম)। এই উভয় হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, শুধু নিয়তের আমলের কারণে যেকোনো মহৎ ও ফজিলতপূর্ণ আমলের সওয়াব তাদের মতোই পাওয়া যাবে; যারা কষ্টসাধনা করে নিজেদের আমল সম্পাদন করেছে। অথচ সে ব্যক্তি পূর্ণ ইখলাসের সাথে ওই আমলের শুধু নিয়তই করেছিল আর কিছুই করতে পারেনি। অতএব উত্তম ও কল্যাণ কাজের জন্য বেশি বেশি নিয়ত করা জরুরি। সাথে সাথে ভ্রষ্ট নিয়ত এবং ভ্রান্তলক্ষ্য মনে পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকা উচিত। নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদকে ডাকা হবে এবং তার ওপরে দেয়া নিয়ামতগুলো একে এক স্মরণ করানো হবে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হবে তুমি কি এগুলো ভোগ করেছিলে? সে স্বীকার করে নেবে। বলবে হ্যাঁ, এসব নিয়ামত আমি ভোগ করেছি। তখন আল্লাহ বলবেন ওই নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ তুমি কী আমল করেছো? তখন সে বলবে, আমি আপনার রাস্তায় লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি এ জন্য লড়াই করেছ যেন তোমাকে বীর উপাধি দেয়া হয়। তা তো দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আনা হবে, যে নিজে ইলেম শিখেছে, কুরআন পড়েছে এবং অপরকে শিক্ষা দিয়েছে। তাকে আগের ব্যক্তির মতো আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতগুলো স্মরণ করানো হবে এবং সে তা স্বীকার করে নেবে। আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করবেন, এ প্রতিদানে তুমি কী আমল করেছো? সে বলবে তোমার ইলেম শিখেছি ও কুরআন পড়েছি এবং অপরকে শিখিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, বরং তুমি এ জন্য ইলেম শিখেছ লোকে তোমাকে আলেম বলবে। তা তো বলা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তৃতীয় আরেক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে যে চিরবিত্তশালী, যাকে আল্লাহ তায়ালা প্রচুর ধনসম্পদ ও ঐশ্বর্য দান করেছিলেন। আগের ব্যক্তির মতো তাকেও আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হবে, তুমি আমার জন্য কী আমল করেছো? সে বলবে আল্লাহ, ব্যয়ের জন্য এমন কোনো তোমার পছন্দনীয় খাত বাদ দিইনি, আর এগুলো তোমার সন্তুষ্টির জন্য করেছি।
আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো; বরং তুমি এ জন্য করেছো লোকেরা তোমাকে দানবীর উপাধি দেয়। তা তো দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’ (সহিহ মুসলিম)। এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, শত কাজ করার পরও নিয়ত সঠিক না হলে কী করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে! প্রকৃতপক্ষে সব কাজে নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা জরুরি। ইখলাসের সাথে কাজের জন্য পরিশুদ্ধ নিয়ত করলে কোনো কারণে কাজটি করতে না পারলেও শুধু নিয়তের কারণে ওই কাজের আমল করার সওয়াব পাওয়া যাবে। আবার ভ্রষ্ট নিয়তের কারণে বড় ধরনের উত্তম ও নেক আমলেরও সামান্য মূল্য থাকবে না।

 

লেখক : প্রবন্ধকার

সূত্র : নয়া দিগন্ত

Similar Posts

error: Content is protected !!