অনিল বড়ুয়া থেকে চিশতী বাবা, ভণ্ডদের কারণে অলিদের বদনাম

মাহমুদ আল আজাদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ।।

গত নব্বই দশকের দিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদী ভাংগা, বসত ভিটাহীন অসহায় দরিদ্র ২২৫টি পরিবারকে হাটহাজারী সদর থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ের গহীন অরণ্যে বসবাস করার জন্য প্লট দেয় তৎকালীন সরকার। সেই গ্রামের নাম ছিল গুচ্ছগ্রাম (অর্থাৎ একত্রিত করা)। সেখানে সবার মতো করে প্লট পায় অনিল বড়ুয়া (প্রকাশ চিশতী বাবা)। ২ ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে বসবাস করে আসছে সবার সাথে। তার পুত্র-কন্যা তেমন লেখাপড়া করেনি দরিদ্রতার কারণে। দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত ছিল তারা। অনিল বড়ুয়া তখন ট্রাকের চালক ছিলেন, স্থানীয় কয়েকজন চালকের সাথে সেও চাকরি করতেন এক সাথে। তারা কিন্তু মুসলিম। সবাই নামাজ কালাম পড়লেও সে কখনো তাদের সাথে মসজিদে যেত না। নামাজের আহ্বান করলে সে তাদের উত্তর দিত দুনিয়ার সব স্থানে শয়তান পেশাব করার কারণে পবিত্র নেই। তাই আমি নামাজ মসজিদে পড়তে পারব না। আমার নামাজ মনে আছে, এবং পড়ি। কথাগুলো বললেন তার এক সহকর্মী আনুয়ার হোসেন তালুকদার গত (২৫ এপ্রিল) জুমার নামাজের পূর্বে আদর্শগ্রাম জামে মসজিদে।

কে এই অনিল বড়ুয়া, কি ভাবে হল চিশতী বাবা? প্রশ্ন জনমতে। সে ছিল পূর্ব চন্দ্রপুর বড়ুয়া পাড়ার বাসিন্দা। ট্রাকচালক হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেত সে। পাবনা জেলার কোন এক গ্রাম থেকে বিয়ে করে সে কয়েক বছর বসবাস করে আসছিল। পরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসা ভাড়া করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিল।

গত ১৯৯১ সনে হাটহাজারীর গুচ্ছগ্রামে সরকারি প্লট পায় সে। দীর্ঘ ১৮ বছর বসবাসে তিনি ট্রাকের চালক হিসেবে পরিচিত। তিনি মনছুরাবাদ পীরের মুরিদ হিসেবে দাবি করতেন। এলাকার কিছু নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে প্রতি বাংলা মাসের ৬ তারিখ গানের আয়োজন করতেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০/১২জনের একটি গ্রুপ করে সারা রাত নেশা করে গান বাজনায় মগ্ন ছিলেন অনিল বড়ুয়া। নিজেকে হঠাৎ নওমুসলিম হিসেবে দাবিও শুরু করেন। কিন্তু সমাজের কারো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজসহ কোন ঈদের নামাজে যেতে দেখেননি কেউ বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।

মৃত্যুর তিন-চার বছর আগে অসুস্থ হওয়ায় ড্রাইভারের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আদর্শগ্রাম পাকা রাস্তার ১নং সড়কে ছাতা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু নেশাটি বাদ দেয়নি। গাঞ্জা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করব সে ও তার কিছু সঙ্গীরা বলে অভিযোগ করেন। এক নামেই পরিচিত ছিল গাঞ্জা বাবা।আসলে কিছু বদমাস, ভণ্ড, প্রতারকদের কারণে অলি-আউলিয়াদের বদনাম ছড়ায়। কিন্তু এদেশ ষাট আউলিয়ার দেশ। পীর-আউলিয়াই এই বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছে সর্বপ্রথম।

অসুস্থ জনিত অবস্থায় ভণ্ড চিশতী মারা গেলে এলাকার কেউ দেখতে আসেননি। সে কি মুসলিম নাকি অমুসলিম তা নিয়ে ছিল সংশয়। সেও অসিয়ত করে গিয়েছে তাকে যেন মৃত্যুর পর মুসলমানদের কবরস্থান দাফন না করে। তার বাসস্থানে তাকে শায়িত করা হয়। মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে তার কিছু ভক্ত কবরস্থানে কবর তৈরি করতে গেলে স্থানীয় মৌলভী অদুদিয়া মাদরাসার শিক্ষক আবদুল ওহাব আল কাদেরী একটি কাগজ দেখিয়ে বলেন তিনি অসিয়ত করেছেন তাকে তার ঘরেই দাফন করতে। কিন্তু ঘরে কোনো ব্যক্তিকে কি দাফন করা যায়? সে প্রশ্ন ছিল এলাকাবাসীর।

কিন্তু কথিত এ মোল্লা ফতোয়া দিয়ে দিয়েছে পারবে। তখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল এলাকার সর্বস্তরের জনগণ। ছুটে এসে বাঁধা দিয়েছিলেন হাটহাজারী মাদরাসার প্রবীণ শিক্ষক মাওলানা ইয়াইয়ার পুত্র মাওলানা শোয়াইবসহ অনেকেই। এলাকার পরিস্থিতি শান্ত করতে তখনি ছুটে আসেন ইছাপুর মাদরাসার শিক্ষক অত্র এলাকার বাসিন্দা ক্বারী আবদুল মালেক। তার কথায় আর কেউ প্রতিবাদ বা বাঁধা প্রদান করেননি। শর্ত ছিল ঘরের চালসহ দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে শুধু কবরটার চিহ্ন রাখবে যাতে অপবিত্র না হয়।

কিন্তু কোথায় গেল সেই শর্ত। ২০১১ সালে দাফনের পরের বছর থেকে গোপনে তিন মাস অন্তর অন্তর ঢোল-তবলা দিয়ে নারী পুরুষ মিলে রাতভর গান বাজনায় মগ্ন ছিল, অতিষ্ঠ ছিল আশপাশের মানুষ। মাঝে মধ্যে সমাজের কর্তাদের বিচার দিলেও কোন সুরাহা পায়নি তারা। বলত তাদের ঘরে যা ইচ্ছে তাই করবে এটা আমাদের কিছু না। বলবেই তো অন্ধ পরিবেশের মুর্খ সমাজ কর্তা হলে যা হয় আর কি। সেই আস্তানার নাম দেয় ইবরাহীম চিশতী দায়রাপাক দরবার। বিভিন্ন সময় অভিযোগ দিত এলাকাবাসী সেটার নাম দিয়ে তার ২পুত্র সিএনজিচালক জাহেদুল ও হামিদুল রশিদ দিয়ে টাকা সংগ্রহ করত। পরিবার নিয়ে চলতো এ কৌশলের দায়িত্ব নেয় ম.জ.ম আবদুল ওহাব আল কাদেরী। তিনিও নারীঘটিত অভিযোগে এলাকায় বিতর্কিত ব্যক্তি। বিগত ৭ বছর গোপনে এ সব কাজ করলেও এবার প্রকাশ্যে তারা ওরস পালনের ঘোষণা দিয়ে লিফলেট বিতরণ করলে স্থানীয়দের দৃষ্টিগোচর হলে থানা ও উপজেলা ইউএনওর নিকট এ ভণ্ডামীর কার্যক্রম বন্ধের জন্য লিখিত অভিযোগ করেন।

অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে গত (২৭ এপ্রিল) থানা পুলিশের ফোর্স নিয়ে এলাকাবাসীকে সঙ্গে করে বিকেল ৪টার দিকে ভণ্ড বাবার আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয় মুহূর্তে। প্রায় কয়েকশত উৎসুক জনতা এ ভণ্ডামির কার্যক্রম বন্ধের স্লোগান তোলেন ও গুঁড়িয়ে দেয়া আস্তানার চিত্রগুলো দেখতে থাকেন।

এ বিষয়ে ইউএনও রুহুল আমিন প্রতিবেদককে জানান, এ এলাকায় ভণ্ডামী করতে অলি আওলিয়াদের বদনাম রটাতে ও মাজার বানিয়ে ধান্দা করতে মূলত তাদের এ পরিকল্পনা। কিন্তু এলাকার এত লোক থাকতে এ সব বিষয় আগে থেকে কেন বন্ধ করা হল না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন তখনি বন্ধ করলে আজ এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত না। তবে সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে এলাকাবাসী এ বিষয়ে জনমত সৃষ্টি করে তা প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ভণ্ড বাবার আস্তানাটি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। এটাকে পুঁজি করে তারা ধর্ম ব্যবসার পরিকল্পনা শুরু করতে চেয়েছিল। যার নামাজ কালামের বিশ্বাস নাই সে কিভাবে পীর হয়। সব ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না।

Similar Posts

error: Content is protected !!