বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল শুধু নদী ও বন্যার গল্পে সীমাবদ্ধ নয়; এখানে লুকিয়ে আছে শত বছরের জীবিকা ও সংগ্রামের অনন্য ইতিহাস। একসময় গোবরের লাকড়ি, খরস্রোতা নদীতে জেলেপেশা, কিংবা মৌসুমি কৃষিকাজ—এসবের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনযাত্রা। আধুনিকতার ঢেউয়ে অনেক পেশাই আজ বিলুপ্তপ্রায়। সেই হারানো ঐতিহ্য ও টিকে থাকা সংগ্রামের গল্প নিয়ে শুরু হয়েছে নিকলীকেন্দ্রিক প্রথম অনলাইন সংবাদমাধ্যম “আমাদের নিকলী ডটকম”-এর ধারাবাহিক ফিচার প্রতিবেদন—“হাওরাঞ্চলের ব্যতিক্রমী জীবিকা”। আজ থাকছে “হাওরপাড়ের বিলুপ্ত ঐতিহ্যের সোনালী অধ্যায়”
মোহাম্মদ তোফায়েল আহছান ।।
বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে একসময় জলপথ ছিল প্রধান যাতায়াত মাধ্যম। বিশেষত কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় মানুষের জীবন-জীবিকা নৌকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিল। বাংলার গ্রামীণ জীবন ও জলজ সভ্যতা একে অপরের পরিপূরক। নদীমাতৃক এই দেশের গ্রামাঞ্চলে মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি, এমনকি সামাজিক যোগাযোগও একসময় নৌকার ওপর নির্ভরশীল ছিল। হাতে বাওয়া নৌকা শুধু একটি যানবাহন নয়, এটি ছিল জীবনের ছন্দ, লোকজ ঐতিহ্যের প্রতীক এবং হাজার বছরের নদীসংস্কৃতির ধারক। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে—যেখানে বছরের অর্ধেক সময় পানি আর ঢেউয়ের রাজত্ব—সেখানে নৌকা মানেই জীবন।
মানুষ, মালপত্র, কৃষিপণ্য, পশুখাদ্য পরিবহন কিংবা বিয়ের শোভাযাত্রা—সবকিছুরই ভরসা ছিল একটাই, নৌকা। জলই ছিল জীবনের রাস্তা, আর নৌকাই ছিল সেই জীবনের বাহন। সত্যিই, নৌকাবিহীন জীবন ছিল অকল্পনীয়। আর এই নৌকাগুলোর মধ্যে বিশেষ মর্যাদা পায় এক অনন্য বাহন—গস্তি নৌকা বা ছইয়াঅলা নৌকা। বর্ষার বিস্তীর্ণ জলে, গোধূলির আলোয় বা চাঁদনি রাতে, নৌকার ছইয়ের নিচে গড়ে উঠত গল্প, গান।
নৌকার বৈচিত্র্য ও নির্মাণশৈলী
বাংলার নৌকার জগৎ বহুমাত্রিক। কাজের ধরন, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিক প্রয়োজন অনুসারে প্রতিটি অঞ্চলের নৌকার আকৃতি, নির্মাণ উপাদান ও নকশায় ছিল ভিন্নতা। কোথাও মাছ ধরার নৌকা, কোথাও যাত্রী পরিবহনের ডিঙি, আবার কোথাও পণ্য বহনের বৃহৎ “বালাম নৌকা”; হাওরাঞ্চলে পণ্য বহনের বড় “বালাম নৌকাকে” রপ্তানি নাউ বলা হতো।
অঞ্চলভেদে, গঠনশৈলী, জলপথের ধরন ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানান ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল। দেশের নদীনির্ভর জনপদগুলো একসময় নৌকার বৈচিত্র্যে ভরপুর ছিল। নৌকার যেসব নাম পাওয়া যায় এর মধ্যে ছিপ, বজরা, ময়ূরপঙ্খী, গয়না, পানসি, কোসা, ডিঙি, পাতাম, বাচারি, রপ্তানি, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি, নায়রি, সওদাগরি, ইলশা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, বেদে বা সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, বৌচোরা নৌকা, লক্ষ্মীবিলাস, গন্ডীবিলাস, খেয়া নৌকা, বাইচের নৌকা। এই নৌকাগুলোর মধ্যে কিছু ছিল যাত্রীবাহী, কিছু পণ্যবাহী, আবার কিছু বিশেষভাবে মাছধরা বা ধর্মীয়-উৎসবীয় কাজে ব্যবহৃত হতো। অধিকাংশ নৌকাই প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিছু আবার একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, একেবারে স্বল্প পরিমাণে রয়েছে মানুষের একান্ত প্রয়োজনের তাগিদে ব্যবহারের জন্য। কোনো কোনো স্থানে পর্যটক আকর্ষণ করতে নৌকাগুলোতে আধুনিক সুবিধা সংযোজন করে বাহারি রকমের বাণিজ্যিক প্রচলন শুরু করেছে। তবে দেশব্যাপী সাধারণ নৌকাগুলো প্রচলন কমে যাওয়ার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে মাঝিমাল্লা ও নৌকা তৈরির কারিগরের সংখ্যাও।
হাওরাঞ্চলের প্রচলিত নৌকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যবহৃত ও পরিচিত ছিল—ডিঙি নৌকা (এর মধ্যেও শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তবে এরকম নৌকায় যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল অন্তত ১২ জন। ডিঙি নৌকায় মাছ ধরা, যাত্রী ও অল্প পরিমাণে পণ্য পরিবহনও করা হতো)। এ ছাড়াও বালাম নৌকা বা রপ্তানি নৌকা (পণ্য পরিবহনের জন্য বড় আকারের); গস্তি বা ছইয়াঅলা নৌকা (যাত্রী পরিবহনের জন্য আরামদায়ক ও মর্যাদাসূচক বাহন); কোসা নৌকা (ছোটখাটো কাজে ব্যবহারের জন্য, এর পরিবহন ক্ষমতাও কম) উল্লেখযোগ্য।

প্রতিটি গস্তি নৌকা তৈরির পেছনে লুকিয়ে থাকে এক প্রজন্মের কারিগরি জ্ঞান ও শ্রমের গল্প। স্থানীয়ভাবে পাওয়া গামারি, শিরিষ, জারুল কিংবা সেগুন কাঠ—এ সব ছিল প্রধান উপকরণ। কাঠ নির্বাচনই ছিল প্রথম শিল্প; নৌকার আয়ু ও ভর বহনের সামর্থ্য নির্ভর করত কাঠের গুণমানের ওপর। তাই কারিগররা আগে কাঠ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতেন, কখনো রোদে সপ্তাহের পর সপ্তাহ রেখে, আবার কখনো ধোঁয়া বা লবণজলে প্রক্রিয়াজাত করে তা মজবুত করতেন।
এরপর শুরু হতো নৌকার দেহ গড়ার সূক্ষ্ম কাজ—পাটাতন বসানো, দেহের বাঁক মাপা, ছইয়া বা ছাউনির কাঠামো তৈরি, দাঁড়ের ভারসাম্য ঠিক করা—সবকিছুই হতো অভিজ্ঞ কারিগরের চোখের পরিমাপ ও হাতে গড়া নিখুঁত কৌশলে। কোনো নকশা বা যন্ত্র ছিল না; প্রজন্মের পর প্রজন্মে মুখে মুখে শেখা অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁদের মাপকাঠি।
ছইয়ার বাঁক তৈরি করা ছিল এক ধরনের শিল্প। বাঁশের সরু কঞ্চি ও পাটের দড়িতে বাঁধা ছইয়া শুধু ছায়া দিত না, বরং নৌকার সৌন্দর্যেও যোগ করত এক অনন্য মাধুর্য। প্রতিটি নৌকা তাই হয়ে উঠত ভিন্ন, যেন প্রতিটি কারিগরের নিজের হাতের স্বাক্ষর বহন করে।
গস্তি নৌকা: আভিজাত্যের প্রতীক
গস্তি নৌকা বা ছইয়াঅলা নৌকা ছিল একেবারে আলাদা ধাঁচের। দৈর্ঘ্যে ২৫ থেকে ৩০ ফুট এবং প্রস্থে ৩ থেকে ৫ ফুটের এই নৌকাটি দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ছিল ভ্রমণেও আরামদায়ক। শক্ত কাঠের তলদেশ, তারও ওপর সমতল অংশে গোড়া’য় বসানো হতো পাটাতন, এরপর ছাউনি বা ছইয়া বসানো হতো।
ছাউনিটি বড় ও অর্ধচন্দ্রাকৃতির; দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭ থেকে ৯ ফুট, প্রস্থে ৩ থেকে ৫ ফুট এবং উচ্চতায় ৪ থেকে ৫ ফুট। বিশেষ প্রজাতির শক্ত নমনীয় বাঁশ দিয়ে বানানো হতো ছাউনির ভিত্তি। এরপর ছাউনির পরতে পরতে বসানো হতো তালপাতা বা কুঁচি পাটের চাটাই, মসৃণ কাপড়; বৃষ্টির পানি ঠেকাতে ব্যবহৃত হতো মোটা ত্রিপল বা তালের পাতা। উপরিভাগে আবার বাঁশের সুন্দর বুনন করা স্তর বসানো হতো। এতে ছাউনি বা ছইয়াটা দেখতে যেমন সুন্দর হতো, তেমনি ব্যবহারের জন্যও উপযোগী হতো। কোনো কোনো নৌকার ছাউনিতে বাঁশের পরিবর্তে বেত ব্যবহার করা হতো। এতে সৌন্দর্য বাড়াতে নিখুঁত বুননের কাজ করা যায় এবং তুলনামূলক শক্তও হয়। নানান কারুকাজ এবং নকশা করা ছাউনিটিই ছিল নৌকার মূল বৈশিষ্ট্য। এ থেকেই এর নাম হয়েছে “ছইয়াঅলা নৌকা” বা “গস্তি নৌকা”। স্থানীয় ভাষায় “গস্তি” শব্দটি মূলত ছাউনির ইঙ্গিতবাহী।
ছাউনির নিচের জায়গাটি ছিল যেন এক ভাসমান বসার ঘর—জলের বুকে গড়ে ওঠা এক ক্ষুদ্র সংসার। সামনের দিকে কাঠের দরজা, যা কখনো খোলা রেখে নদীর বাতাসে মন ভরানো যেত, আবার কখনো নরম কাপড়ের পর্দা টেনে দেওয়া হতো। পেছনের অংশটি খোলা বা পর্দা টানানো থাকত; এতে বাতাস চলাচল অব্যাহত থাকে, আবার পর্দাপ্রথারও যেন ব্যত্যয় না ঘটে।
এই নৌকার যাত্রী হতেন মূলত সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল পরিবারের সদস্যরা—বিশেষত নারীরা, যারা সমাজের চোখে পর্দানশীন থেকেও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতেন এই ছাউনির আড়ালে বসে। নদীর ঢেউয়ে দুলতে থাকা এই ছাউনিওয়ালা নৌকা হয়ে উঠত তাঁদের চলমান আশ্রয়—যেখানে ছিল গোপনীয়তা, আরাম, নিরাপত্তা ও এক অনন্য শান্তি। অনেকে দীর্ঘ সফরে এই নৌকার ভেতরেই রান্না-বান্না, গল্পগুজব বা নামাজ আদায় করতেন। ফলে এটি শুধু যাত্রার বাহন নয়, বরং ছিল নদীপথের জীবনের এক অপরিহার্য অঙ্গ, জলভিত্তিক সংস্কৃতির এক নিঃশব্দ প্রতীক।

নৌকার কাঠামো, উপকরণ ও পরিচালনা
গস্তি নৌকা প্রশস্তে দুই প্রান্তকে শক্তভাবে ও নির্দিষ্ট দূরত্বে আটকে রাখার জন্য বসানো হতো মোটা কাঠের দণ্ড, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় গোড়া। এটি শুধু নৌকার ভারসাম্য রক্ষা করত না, মাস্তুল বা পাল বাঁধার দণ্ডকেও স্থির রাখতে সহনীয় ছিল।
প্রতিটি নৌকায় থাকত একাধিক উপকরণ—একটি বৈঠা (মাঝি ব্যবহার করেন দিকনির্দেশে), দুটি দাঁড় (সামনের গতি ত্বরান্বিত করতে), একটি ছইর বা লগি (নৌকা ঠেলার জন্য), একটি মাস্তুল ও পাল (বাতাসের সহায়তায় চলাচলের জন্য)। কখনো কখনো অতিরিক্ত বৈঠা, লগি ও দাঁড় মজুত রাখা হতো; ভেঙে গেলে, হারিয়ে গেলে বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
নৌকার নিয়ন্ত্রণ ও চালনা করতেন সাধারণত তিনজন মাঝিমাল্লা—মূল মাঝি (যিনি পেছনে বসে নৌকার দিকনির্দেশ দেন), দুইজন মাল্লা (মাঝির সামনে উল্টো মুখ করে বসে দাঁড় টানেন এবং প্রয়োজনীয় সময়ে নৌকার সামনে গিয়ে লগি চালান)।
মাঝিমাল্লাদের জীবন ও উপার্জন
গস্তি নৌকার মাঝিমাল্লারা ছিলেন হাওরাঞ্চলের সমাজে মাঝিমাল্লাদের মধ্যে এক বিশেষ ও সম্মানিত শ্রেণি। তারা শুধু নৌকার মাঝি নন, ছিলেন দক্ষ নাবিক, অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক ও যাত্রাপথের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। বিশাল জলরাশির বুক চিরে চলতে হলে প্রয়োজন হতো দিকজ্ঞান, সাহস আর আবহাওয়ার সূক্ষ্ম ধারণা—যা এই মাঝিরা রপ্ত করেছিলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
তারা জানতেন কোন দিক দিয়ে বাতাস বইছে, কোন ঢেউয়ের ভাঁজে লুকিয়ে আছে বিপদ, কোথায় জল গভীর, কোথায় অগভীর কাদা। রাতের আঁধারে তারা তারার অবস্থান দেখে পথ চিনতেন, দিনের বেলায় বাতাসের গতি ও ঢেউয়ের ঢাল দেখে দিক নির্ধারণ করতেন। হাওরের বিস্তীর্ণ জলপথ তাঁদের কাছে ছিল এক খোলা মানচিত্র, যার প্রতিটি বাঁক ও ভাঁজ তাঁরা চিনতেন হৃদয়ের মতো।
যাত্রীরা শুধু নৌকার ওপর নয়, মাঝিদের ওপরও রাখতেন পূর্ণ আস্থা। তারা ছিলেন যোগাযোগের মাধ্যম, সংবাদবাহক, আবার অনেক সময় অতিথিপরায়ণ গল্পকারও। তাদের হাতেই নির্ভর করত দূরের গ্রামে যাতায়াত, রোগী পৌঁছানো, কিংবা পণ্যবাহী নৌকার নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানো। এভাবেই গস্তি নৌকার মাঝিমাল্লারা হাওরজীবনের এক অপরিহার্য ও প্রাণবন্ত অধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন।
এই মাঝিমাল্লারা নৌকা চালনায় যেমন পারদর্শী ছিলেন, তেমনি নৌকা রক্ষণাবেক্ষণেও অভিজ্ঞ। তারা জানতেন কোন কাঠে পানি কম ঢোকে, কোন সময় ছইয়ার কাপড় বদলানো দরকার, কিংবা কোন দিকের বাতাসে পাল উঠাতে হবে। হাওরাঞ্চলের অন্য মাঝিদের তুলনায় গস্তি নৌকার মাঝিমাল্লারা নিজেদের “বনেদি” ভাবতে পছন্দ করতেন। তাদের পোশাক, চালচলন ও কথা বলায় ছিল একরকম আত্মবিশ্বাস ও গর্ব।
সাধারণত মূল মাঝিই নৌকার মালিক হতেন। তাঁর সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্য বা চুক্তিভিত্তিক মাল্লারা কাজ করতেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে গস্তি নৌকার এক দিনের ভাড়া ছিল ২০০ থেকে ২৫০ টাকা (এটি ছিল যথেষ্ট অর্থ। অন্য ডিঙি নৌকায় যখন দিনের আয় ছিল সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ১২০ টাকা)। দূরপাল্লার যাত্রায় বা একাধিক দিনের ভ্রমণে মাঝিমাল্লাদের তিন বেলার খাবার দিতেন যাত্রীরা। আবার স্বল্প দূরত্বে গেলে দুপুর ও রাতের খাবারই যথেষ্ট হতো।

সামাজিক মর্যাদা ও ব্যবহারিক গুরুত্ব
গস্তি নৌকা ছিল শুধু যাতায়াতের বাহন নয়, বরং ছিল সামাজিক মর্যাদা, রুচি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেখানে খোলা নৌকায় যাতায়াত করতেন, সেখানে গস্তি নৌকায় সওয়ারি হতেন সমাজের ধনী, সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল পরিবারের সদস্যরা। নৌকার সুগঠিত কাঠামো, ছইয়ার নিচে ছায়াময় আরামদায়ক আসন, আর মাঝিমাল্লাদের যত্নশীল সেবায় এই যাত্রা যেন হয়ে উঠত এক রকম আভিজাত্যের অভিজ্ঞতা।
বর্ষাকাল শুরু মানেই ছিল হাওরপাড়ে উৎসবের আমেজ, শুরু হতো বিয়ের মৌসুম। তখন দূরের গ্রামে বরযাত্রা বা কনের বাড়ি যাওয়ার জন্য গস্তি নৌকার বিকল্প ছিল না। জলপথে সাজানো বরযাত্রার নৌকাগুলো ছিল যেন ভাসমান আনন্দযাত্রা—ছইয়ার নিচে বসা সাজপোশাক পরা বর, সঙ্গে বরণীয় আত্মীয়স্বজন; বাইরে ছইয়ার কিনারায় দুলছে রঙিন কাপড় ও ফুলের মালা।
পর্দা প্রথা মেনে চলা পরিবারের জন্য গস্তি নৌকা ছিল একান্ত উপযোগী। ছইয়ার ভেতরের অংশ ছিল যেন এক চলমান গৃহের মতো—সুরক্ষিত, আরামদায়ক ও নিশ্চিন্ত। সেখানে নারীরা নিরাপদে বসে পথের দৃশ্য উপভোগ করতে পারতেন, গন্তব্যে পৌঁছাতে পারতেন পরিপূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে। ফলে গস্তি নৌকা হয়ে উঠেছিল শুধু ভ্রমণের মাধ্যম নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।
আভিজাত্য, গোপনীয়তা ও আরাম—এই তিন কারণে গস্তি নৌকার কদর ছিল সর্বাধিক। ফলে বিয়ের বরযাত্রা বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রাখতে হতো নৌকা। এক এলাকায় এমন নৌকার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা দু-একটি মাত্র।
মৌসুমভিত্তিক সংকট ও পেশাগত টানাপোড়েন
বর্ষা ফুরিয়ে গেলে যখন হাওরের জলধারা ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করত, তখন গস্তি নৌকার দিনও যেন অস্তমিত সূর্যের মতো নিভে আসত। বিশাল জলরাশির রাজ্য তখন পরিণত হতো ফেটে যাওয়া খাল-বিল, কাদামাটির জমিন আর আঁকাবাঁকা সরু জলপথে। নৌকার নিচের কাষ্ঠ তখন আর জলের পরশ পেত না; ভারী গস্তি নৌকা চালানো হয়ে উঠত প্রায় অসম্ভব। একে একে শুকিয়ে যেত নদী, খাল, আর হাওরের বুকভরা নাব্যতা।
এই সময় মাঝিমাল্লাদের জীবনেও নেমে আসত এক মৌসুমি পরিবর্তন। কেউ মজুরি কাজে যোগ দিত, কেউ কৃষকের ঘরে শ্রম দিত, আবার কেউ অন্য ছোট নৌকায় মাছ ধরা বা পণ্য পরিবহনের কাজে যুক্ত হতো। যাদের হাতে একটু সময় থাকত, তারা যত্ন নিয়ে নৌকার কাঠ মেরামত করত, পুরনো ছইয়া বদলে নতুন বাঁশ-বেতের ছাউনি দিত, মাস্তুলের ফাটা দণ্ড পাল্টে দিত—সবই আগামী বর্ষার প্রস্তুতি হিসেবে।
তবুও তাদের মন থাকত ব্যাকুল এক অপেক্ষায়—আবার কখন নামবে আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি, কখন ফুলে-ফেঁপে উঠবে হাওরের বুক, আর তারা আবার বৈঠা হাতে জলরাশির বুকে ছুটে যাবে গন্তব্যের পথে। বর্ষার সেই কর্মচাঞ্চল্য, যাত্রীর হাসি, ঢেউয়ের সঙ্গীত—সবই যেন থেকে যেত তাদের মনে এক মিষ্টি স্মৃতির মতো, পরবর্তী মৌসুমের প্রতিশ্রুতির মতো।

গস্তি নৌকার পরিবেশবান্ধব দিক
হাতে বাওয়া নৌকার অন্যতম সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিখুঁত পরিবেশবান্ধবতা। এই নৌকায় কোনো ধরনের জ্বালানি—তেল, গ্যাস বা ডিজেল—ব্যবহার করা হতো না। মাঝির হাতের জোর আর বৈঠার ছন্দেই চলত সমগ্র যাত্রা। ফলে এতে কার্বন নিঃসরণ ছিল শূন্য, যা আধুনিক যুগের জলবায়ু সংকট মোকাবিলায়ও এক অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে।
ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের মতো এর কোনো শব্দদূষণ ছিল না; হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে চলার সময় শুধু শোনা যেত দাঁড়ের সঙ্গে পানির মৃদু ছন্দ—“ছপ… ছপ…”—যেন হাওরের নিজস্ব সঙ্গীত। এই নৌকা ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের শান্ত সহাবস্থানের এক জীবন্ত প্রতীক।
নির্মাণের দিক থেকেও হাতে বাওয়া নৌকা ছিল একেবারেই প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব। স্থানীয়ভাবে পাওয়া শক্ত কাঠ, বাঁশ, বেত, পাট ও নারকেলের তন্তু দিয়েই তৈরি হতো এই নৌকা। তলদেশ দিয়ে পানি ঢোকা রোধ করতে ব্যবহার করা হতো ঘন, কালো রঙের তরল আলকাতরা—যা কাঠকে টেকসই রাখত এবং দীর্ঘদিন ভাসমান থাকতে সাহায্য করত। ব্যবহৃত প্রতিটি উপাদান ছিল সহজলভ্য, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং প্রকৃতিতে সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত। ফলে নৌকার কোনো অংশই পরিবেশে স্থায়ী ক্ষতি করত না; বরং প্রকৃতির সাথেই তার সহাবস্থান ছিল স্বাভাবিক ও সুরেলা।
তাছাড়া, নৌকার কাঠামো এমনভাবে তৈরি হতো যাতে এটি বছরের পর বছর ব্যবহার করা যায়—কেবল সময়মতো কিছু মেরামত, পাটাতন বদল আর ছইয়ার বাঁশ পাল্টে দিলেই আবার নতুনের মতো চলত। এক অর্থে এটি ছিল টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার এক নিখুঁত দৃষ্টান্ত, যা কোনো কার্বন ফুটপ্রিন্ট না রেখেই দীর্ঘদিন সেবা দিতে পারত।
পরিবেশবিদদের মতে, হাতে বাওয়া এই নৌকাগুলো শুধু পরিবেশবান্ধবই নয়, বরং স্থানীয় অর্থনীতি, কারিগরি ঐতিহ্য ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীকও বটে। কারণ এতে কোনো বাহ্যিক জ্বালানি বা যান্ত্রিক যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হতো না; মাঝিদের দক্ষতা, প্রাকৃতিক উপাদান আর মানবশক্তির সমন্বয়েই তৈরি হতো এই সম্পূর্ণ স্বনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা—যা সত্যিকার অর্থেই ছিল “সবুজ চলাচলের” প্রাচীনতম ও প্রামাণ্য উদাহরণ।
স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখা অভিজ্ঞতার গল্প
মোহাইমিন আহসান (ছদ্মনাম)। বয়স ৫০। শুনি গস্তি নৌকা ভ্রমণ নিয়ে তার গল্প (স্মৃতিকথাটি পুনঃলেখন করা)।
রক্ষণশীল পরিবারে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল গস্তি নৌকা। বর্ষা এলেই যেন ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ত—কারণ, তখনই শুরু হতো হাওরপাড়ের মানুষের ভ্রমণ মৌসুম। স্কুলের লম্বা ছুটি মানেই পারিবারিক ভ্রমণের পরিকল্পনা। কোথায় যাব, কার নৌকা নেব, কতদিন থাকবো—এসব নিয়ে আগেভাগেই চলত ব্যস্ততা।
আমাদের পরিবারের ভ্রমণ মানেই গস্তি নৌকা। কখনো স্বল্প দূরত্বে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি, কখনোবা দূরবর্তী গ্রামের দিকে—ভ্রমণ ছোট হোক বা বড়, বাহন ছিল একটাই। বর্ষার সময় হাওরের চারদিক তখন পানিতে থইথই করত। নদী, খাল, বিল, জলাশয়—সব মিলেমিশে তৈরি হতো এক অনন্ত জলরাশি। তখন শুধু নদীপথে নয়, সোজা জলপথে যেদিক দিয়ে খুশি, নৌকা চলত সেই দিকেই। গন্তব্য ঠিক থাকত, কিন্তু পথ বদলাত বারবার—প্রকৃতির খেয়ালেই।
নৌকার সামনের ফাঁকা অংশটা ছিল আমাদের ছোটদের রাজ্য। সেখানে বসে আমরা তুলতাম গাঙকলা (সবুজ, কলার মতো দেখতে এক জলজ ফল), কিংবা ছিঁড়ে আনতাম রঙিন শাপলা-শালুক। কখনো পানির ওপর ভাসমান কচুরিপানার ঢেউয়ের ফাঁকে হাত ডুবিয়ে মাছ ধরার অভিনয় করতাম। এইসব ছিল আমাদের খেলা, আনন্দ, আর বিস্ময়ের জগৎ। ধীরে ধীরে নৌকা ভেসে যেত গন্তব্যের দিকে, আর সূর্য ঢলে পড়ত পশ্চিম আকাশে। দিনের শেষে ফিরে আসতাম ঘরে—মন ভরে, চোখ ভরে, জল-হাওয়া মাখা স্মৃতি নিয়ে।
দীর্ঘ ভ্রমণগুলো ছিল আরও রোমাঞ্চকর। তখন যাত্রার প্রস্তুতিই ছিল এক উৎসব। আগের দিন থেকেই বাড়ির উঠানে শুরু হতো রান্নার তোড়জোড়। আম্মা, আপারা আর বাড়ির বড় নারীরা মিলে রাতভর তৈরি করতেন হরেক পদের খাবার—ভাত, সবজি, মাছ, মাংস, ভর্তা, এমনকি নানা রকম পিঠা। কলসি ভর্তি সুপেয় পানি। এসব খাবার বাঁশের ঝুড়ি ও হাঁড়িতে গুছিয়ে রাখা হতো নৌকার ভেতরে।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মাঝিরা ডাক দিতেন—“সবাই উঠেন, সময় হইছে।” ফজরের নামাজ শেষ করে পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে উঠতাম নৌকায়। বৈঠা চালিয়ে মাঝিরা যখন গানের ছন্দে যাত্রা শুরু করতেন, তখন হাওরের বাতাসে মিশে যেত সেই অদ্ভুত শান্তির সুর—যা আজও কানে বাজে।
দীর্ঘ ভ্রমণে কখনো দিনের আলো ফুরিয়ে রাত নেমে আসত হাওরের বুকের মাঝখানে। তখন মাঝিরা কোনো নিরাপদ ঘাটে নৌকা ভিড়াতেন। গ্রামের কোনো পরিবারের নিরাপদ আশ্রয়ে রাত কাটানো হতো। ছইয়ার নিচে জ্বলে উঠত কুপি বা লণ্ঠনের আলো; বাইরে শোনা যেত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মনে অজানা শিহরণ। পরদিন ভোরে আবার চলত নতুন পথের যাত্রা।
কখনো ভ্রমণ হতো সাত থেকে দশ দিনেরও বেশি। কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছানোর পর শুরু হতো অতিথিপরায়ণতা, আত্মীয়তার আদানপ্রদান আর শিশুদের নির্ভার খেলাধুলা। পুরো ভ্রমণের সময় গস্তি নৌকার মাঝিমাল্লারা আমাদের সঙ্গে থাকতেন। তারা ছিলেন আমাদের যাত্রাসঙ্গী, রক্ষক এবং অনেক সময় গল্পকারও। রাতে ঘাটে তাঁরা নৌকায় ঘুমাতেন, দিনে লোকালয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতেন আবার যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পাশে থাকতেন।
এইসব ভ্রমণ আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে গভীর স্মৃতির মতো। সেই নৌকার বৈঠার ছন্দ, ছইয়ার নিচের হাসি-আনন্দ, আর হাওরের বাতাসে দুলতে থাকা শিশুমনের উত্তেজনা—সবই আজ অতীত। সময় বদলেছে, জীবন যান্ত্রিক হয়েছে, আর সেই গস্তি নৌকায় দলবেঁধে যাত্রা এখন কেবল গল্পের মতো শোনা যায়। তবু মনে হয়, যদি একদিন ফিরে যাওয়া যেত সেই সোনালি দিনে—যখন জল, আকাশ আর নৌকা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত আমাদের শৈশবের আনন্দে।

মাঝির স্মৃতিকথা: গস্তি নৌকার দিনগুলো
কিশোরগঞ্জের নিকলী সদরের প্রবীণ মাঝি লুৎফর রহমান। শোনালেন সেইসব দিনের কথা; তাঁর পুনঃলেখন করা স্মৃতিকথা শুনি।
আমাদের এলাকায় একসময় ডিঙি নৌকার চল ছিল সবচেয়ে বেশি। ছোট নদী বা খাল পারাপার, হাটে-বাজারে যাওয়া কিংবা গ্রামান্তরের যাতায়াত—সবই হতো এই ডিঙি নৌকায়। কারো কারো বাড়িতে থাকতো ছোট কোসা নৌকা, যা পারিবারিক ছোটখাটো কাজে ব্যবহৃত হতো—জাল ফেলা, বাজার করা বা শিশুদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু আমি ছিলাম সৌভাগ্যবান, কারণ আমার নিজের ছিল একটি গস্তি নৌকা—বড়, সুন্দর, ছইওয়ালা, আরামদায়ক এক বাহন, যা ছিল এলাকার সবার থেকে আলাদা।
আমার বাড়ি খালের একেবারে পাড়ে, তাই নৌকাটা রাখতাম ঘাটেই। নৌকাটাকে মোটা লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা থাকতো, যাতে স্রোতে ভেসে না যায়। মাঝে মাঝে তালাও মেরে রাখতাম নিরাপত্তার জন্য। গ্রামের কোনো পরিবার বেড়াতে যেতে চাইলে আগেই এসে জানিয়ে যেত—“ভাই, অমুক দিন আমরা ওমুক জায়গায় যাবো, নৌকা লাগবে।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম। আমার সঙ্গে ছিল দুইজন সহকারী মাল্লা—দুজনই অভিজ্ঞ, পরিশ্রমী, আর খুবই আন্তরিক মানুষ। আমরা মিলে নৌকা পরিষ্কার করতাম—ছইয়ার পর্দা ধুয়ে ঝুলিয়ে দিতাম, মেঝেতে পরিচ্ছন্ন শীতলপাটি বিছাতাম। সব কিছু ঝকঝকে করে রাখতাম, যেন যাত্রীদের কোনো অসুবিধা না হয়।
আমাদের দলে একজন ছিল অত্যন্ত হাসিখুশি স্বভাবের মানুষ। সারাক্ষণ গল্প করতো, গান গাইতো, পুরনো দিনের নৌভ্রমণের কাহিনি শোনাতো। তার উপস্থিতিতেই যেন পুরো যাত্রার প্রাণ খুঁজে পেত। দীর্ঘ সময় পানিতে কাটালেও কখনো বিরক্তি আসতো না—বরং আনন্দই ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে।
যাত্রীরা সাধারণত ছিলেন শিক্ষিত ও ভদ্রলোক শ্রেণির মানুষ—বিবাহযাত্রা, পারিবারিক ভ্রমণ বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে আমাদের নৌকা ভাড়া করতেন। তাঁরা আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত সম্মান ও যত্নের সঙ্গে আচরণ করতেন। নিজেদের জন্য রান্না করা খাবারও ভাগ করে দিতেন। তাদের আচরণে কখনো মনে হতো না আমরা শুধু মাঝি; বরং যাত্রাপথের এক অঙ্গ হয়ে যেতাম আমরা।
শিশুরা বিশেষভাবে মজার ছিল। তারা কখনো কখনো আমাদের বৈঠা টানার চেষ্টা করতো, হাসির ঝড়ে ভরিয়ে দিত নৌকা। কেউ কেউ সামনের খোলা অংশে বসে শাপলা, শালুক, গাঙকলাসহ জলজ ফুল তুলত, আর আমরা দেখতাম যাতে কেউ পানিতে পড়ে না যায়। এক কথায়, নিরাপত্তা ও আনন্দের মেলবন্ধন ছিল আমাদের এই নৌভ্রমণে।
তবে সব যাত্রা যে সহজ ছিল তা নয়। দীর্ঘ পথের যাত্রা ছিল কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। কখনো কখনো রাতের বেলা কোনো নির্জন ঘাটে “জিরাতি” নিতে হতো—অর্থাৎ নিরাপদ জায়গায় নৌকা থামিয়ে রাত কাটানো। এতে ঝুঁকিও ছিল, তাই সবসময় সতর্ক থাকতে হতো। কখনো অনুকূলে বাতাস এলে পাল তুলে যাত্রা হালকা করতাম, আবার কখনো বৈঠা হাতে নিতে হতো পূর্ণ শক্তিতে। ঢেউয়ের মুখে নৌকা সামলানো ছিল রোমাঞ্চকর ও ভয়ংকর দুটোই।
এসব জ্ঞান আমরা পেয়েছিলাম পুরনো প্রজন্মের কাছ থেকে—নৌচালনার মৌখিক ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার উত্তরাধিকার হিসেবে। চাঁদনি রাত বা পরিষ্কার আকাশের দিনগুলোতেই দূরযাত্রা নির্ধারণ করা হতো, কারণ আমরা দিকনির্দেশ করতাম আকাশের তারা ও চাঁদের অবস্থান দেখে। অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেললে স্থানীয়দের সাহায্যে আবার দিক ঠিক করতাম। তখনকার মানুষও ছিলেন সহযোগিতাপরায়ণ, আন্তরিক, অতিথিপরায়ণ।
কালের স্রোতে আজ সেই দিনগুলো শুধু স্মৃতি। গস্তি নৌকা হারিয়ে গেছে, পালতোলা নৌকাও এখন দুর্লভ। ইঞ্জিনের শব্দ আর যান্ত্রিকতার দখলে হারিয়ে গেছে বৈঠার সুর। আমাদের বয়সও এখন অনেক হয়েছে; ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাই। পরের প্রজন্ম আর এই পেশায় আগ্রহী নয়—তারা শহরমুখী হয়েছে, কেউ শিক্ষক, কেউ চাকুরে, কেউ বিদেশে।
তবু আজও যখন হাওরের ধারে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের শব্দ শুনি, মনে পড়ে সেই দিনগুলো—যখন গস্তি নৌকার ছইয়ার নিচে, বৈঠার ছন্দে, গান আর গল্পের মেলবন্ধনে ভেসে যেত জীবন।
ঐতিহ্যের পতন: সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া নৌকা
সময় বদলেছে, বদলে গেছে মানুষের জীবনধারা, যাতায়াতের ধরন, আর তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী গস্তি নৌকার অস্তিত্ব। এককালে হাওরের ঢেউয়ে দুলত সারি সারি ছইয়াঅলা নৌকা, যেগুলো শুধু বাহন ছিল না—ছিল জীবন, সংস্কৃতি আর সমাজের এক অনন্য প্রতীক। আজ সেই দৃশ্য যেন ইতিহাসের পাতায় বন্দি।
বর্তমানে হাওরের বুক জুড়ে ছুটে চলে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, স্পিডবোট কিংবা ফাইবার নির্মিত আধুনিক নৌকা। এদের গতি বেশি, যাত্রাসময় কম, আর খরচও তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। যেখানে আগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠা চালাতে হতো, সেখানে এখন অনেক কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। ফলে হাতে বাওয়া নৌকার প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমেই হারিয়ে গেছে।
একসময় বর্ষার সকালে হাওরের পাড়ে বসে দেখা যেত, মাঝিমাল্লারা নৌকা ঘষে চকচকে করছেন, ছইয়ার ভেতরে ঝোলানো থাকত লণ্ঠন, পাটাতনে বসানো থাকত মাদুর বা কাপড়। এখন সেই দৃশ্যও হারিয়ে গেছে—নৌকা ঘাটে শোনা যায় শুধু ট্রলারের ইঞ্জিনের গর্জন, আর হাওরের নীরবতা ভাঙে যান্ত্রিক শব্দে।
যান্ত্রিক নৌকার এই প্রসার গস্তি নৌকার মাঝিমাল্লাদের জীবনে এনেছে গভীর পরিবর্তন। অনেকে পেশা বদলে ট্রলারের চালক হয়েছেন, কেউ বা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন জলপথের কাজ। যেসব কারিগর একসময় নৌকার কাঠ কেটে, বেত বেঁধে, ছইয়া বানিয়ে শিল্পের মতো করে তৈরি করতেন একটি গস্তি নৌকা—তাঁরাও আজ প্রায় বিলুপ্ত। তরুণ প্রজন্ম আর এই পেশায় আগ্রহ দেখায় না; কেউ বলে এতে আয় নেই, কেউ বলে এতে ভবিষ্যৎ নেই।
গস্তি নৌকার নির্মাণশৈলীও এখন হারিয়েছে অজানার অন্ধকারে। কাঠের মান, বাঁশের ব্যবহার, পাটাতনের ভারসাম্য রক্ষা, ছইয়ার গড়ন—সবই ছিল একধরনের ঐতিহ্যবাহী কারিগরি দক্ষতার নিদর্শন। অথচ এখন এসব জানে না নতুন প্রজন্মের কেউই। একসময় যে কারিগররা নৌকার তলদেশে দাঁড়িয়ে সুরে সুর মিলিয়ে তৈরি করতেন জীবনবাহী সেই বাহন, আজ তাঁদের কেউ কৃষিকাজে, কেউ দিনমজুরির খাটুনিতে যুক্ত হয়েছেন।
একসময় যেসব গ্রাম বা হাটে গস্তি নৌকা দেখা যেত—সেখানে এখন কেবল পুরনো কাঠের কিছু অংশ পড়ে থাকে কোনো গৃহস্থের উঠানে, স্মৃতি হয়ে। কেউ কেউ এগুলোকে ঘরের ছাউনি বা শেড তৈরিতে ব্যবহার করে, কেউবা রেখে দেয় স্মারক হিসেবে।
তবুও, হাওরের বয়স্ক মানুষদের চোখে এখনো সেই গস্তি নৌকার স্মৃতি ঝলমল করে। তারা বলেন—“সেই নৌকায় ছিল মন, ছিল মায়া; এখনকার ট্রলারে শুধু শব্দ আছে, নেই প্রাণ।” সময়ের স্রোতে এগিয়ে গেলেও, গস্তি নৌকার ছইয়ার নিচে যাপিত সেই শান্ত, ধীর, আর মানবিক জীবন যেন এখনো রয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের গভীরে—এক হারিয়ে যাওয়া যুগের নীরব সাক্ষী হয়ে।
ঐতিহ্য রক্ষায় করণীয়
গস্তি নৌকা আজ ইতিহাসের অংশ—হাওরের ঢেউয়ের বুক চিরে চলা সেই “রাজসিক” বাহন এখন শুধুই স্মৃতি; কিন্তু এটি নিছক অতীতের কোনো নিদর্শন নয়। এটি বাংলাদেশের জলজ সংস্কৃতি, গ্রামীণ কারুশিল্প ও স্থানীয় প্রকৌশল জ্ঞানের এক অনন্য ঐতিহ্য। এই নৌকায় নিহিত রয়েছে শতাব্দীর অভিজ্ঞতা, কারিগরদের নৈপুণ্য এবং হাওরপাড়ের মানুষের জীবনদর্শন।
গস্তি নৌকার কাঠামো, ছইয়ার বাঁশ-চালা, দাঁড়ের ভারসাম্য, কিংবা মাস্তুলে পাল বাঁধার কৌশল—এসবই গ্রামীণ সমাজের প্রকৃতিনির্ভর জ্ঞান-ঐতিহ্যের জীবন্ত দলিল। আজকের প্রজন্মের কাছে এটি হয়তো কেবল লোকগাঁথা, কিন্তু বাস্তবে এটি আমাদের কারিগরি ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
তাই প্রয়োজন এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করার। স্থানীয় পর্যায়ে হাওর জাদুঘর, সংস্কৃতি কেন্দ্র বা পর্যটন তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করে গস্তি নৌকাসহ অন্যান্য হারিয়ে যাওয়া নৌকার প্রতিমূর্তি বা মডেল সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শুধু একটি বাহন নয়, বরং হাওরপাড়ের জীবনযাত্রা, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রাচীন কারিগরির ইতিহাসও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
এছাড়া, গস্তি নৌকা তৈরির ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনই প্রয়োজন কারিগরদের প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান। হাতে বাওয়া নৌকা নির্মাণকে যদি স্থানীয় পর্যায়ে ইকো-ট্যুরিজম (Eco-Tourism) বা পরিবেশবান্ধব পর্যটনের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে এটি একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, অন্যদিকে টেকসই পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।
গস্তি নৌকার ঐতিহ্য তাই কেবল অতীতের গর্ব নয়—এটি হতে পারে ভবিষ্যতের সবুজ প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও স্থানীয় উদ্যোক্তা বিকাশের অন্যতম অনুপ্রেরণা। সময় এসেছে এই ঐতিহ্যকে ভুলে না গিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত ও প্রাসঙ্গিক করে তোলার।
উপসংহার
নৌকা ছিল, আছে এবং থাকবে—তবে তার ধরন, গতি ও ব্যবহার বদলে গেছে সময়ের সঙ্গে। গস্তি নৌকা আজ হাওরের জলে নয়, মানুষের স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায়। এক সময়ের আভিজাত্য, পর্দা, গানের সুর, ঢেউয়ের ছন্দ—সবই মিলেমিশে এখন ইতিহাস।
তবুও নদী ও নৌকার গল্প বাংলাদেশকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো কোনো এক বর্ষার দিনে, নিকলী হাওরের ঢেউয়ের ওপর দিয়ে আবারও কোনো নতুন প্রজন্মের চোখে ভেসে উঠবে সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির ছইয়া—স্মৃতির গস্তি নৌকা, হাওরপাড়ের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী।
লেখক: সংবাদমাধ্যম কর্মী


