স্বাধীনতার পর সারা দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ কিন্তু ভাটি বাংলা-হাওর এলাকায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে আমাদের জাতীয় ধান উৎপাদন বৃদ্ধি হারের দুই গুণ অর্থাৎ প্রায় ছয় গুণ। এটা সম্ভব হয়েছে স্বাধীনতাত্তোর সহজ ও সুলভে সেচ পাম্প, পাওয়ার টিলার, অফশী বীজ, সার, কীটনাশক প্রদানের মাধ্যমে এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার দৃপ্ত অঙ্গীকারের ফলে বিশাল-বিরাট হাওরগুলো চাষাধীনে আসার ফল। বর্তমানেও বলা হচ্ছে, আমাদের দুর্দিনে, জনসংখ্যা বিস্ফোরণে খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার উৎস ভূমি হবে আমাদের হাওর ও উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল। দেশের এ দুটি অঞ্চলে, হাওর জলাশয়-উপকূলীয় ভূমির ব্যবহার সম্ভাব্যতা, উৎপাদনশীলতার অংশবিশেষ মাত্র আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি। হাওরাঞ্চল, এর জীববৈচিত্র, মিঠাপানি দেশের সম্পদ, খোদার নিয়ামত। এ নিয়ামতের সৎব্যবহারের উপর শোকরজারি নির্ভর করে।
হাওর ভাটি বাংলা হচ্ছে এমনই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র, যেখানে ৩৭৩টি হাওরে রয়েছে ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি যা থেকে বছরে একটি ফসল আবাদ করে উৎপাদন হয়- ৫.২৩ মিলিয়ন টন ধান। বছরের বাকী ছ’ মাস প্রায় অব্যবহৃত থেকে এ বিশাল সম্ভাবনার সুফল থেকে জাতি বঞ্চিত হচ্ছে। এ সময়টা হাওর থাকে মিঠা পানিতে ভরপুর। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, হাওরের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও বড় সমস্যা কি? আমি বলব, ’পানি’। এ পানি বর্তমান অবস্থায় হাওরবাসির জন্য ‘আপদ’ হিসাবে বিবেচিত হলেও একে ’সম্পদ’ এ অতি সহজেই রূপান্তর করা সম্ভব। উপকূল বা পাহাড়ের উপর যত নজর ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, হাওর তত উপেক্ষিত রয়েছে। অনাবৃত রয়েছে এর ধন ধান, মাছ, গো সম্পদের রূপালী সোনায় ভরা, সোনার খনি হাওর।
হাওরের অফুরন্ত সম্ভাবনা এখনো অব্যবহৃত রয়েছে বলে ওখানে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশী। এ জন্যে হাওরের কৃষিকে সাজাতে হবে নতুন আঙ্গিকে, নতুন পরিকল্পণায়। শুধু ধান চাষ নির্ভরতা কমিয়ে এনে কৃষি বহুমূখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে মানুষের আয় বাড়বে, পাবে পুষ্টি। কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিষ্টেম, সমন্বিত বালাই দমন ও শস্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করে সারা বছর ব্যাপী সক্ষম স্বাচ্চন্দময় জীবন পাবে। হাওরে ধান রোপন ও কর্তনের সহজে চলা ও চালনা উপোযোগী যন্ত্র দিতে হবে। বিদ্যুত বা বিকল্প জ্বালানীর ব্যবস্থা করতে হবে। বহুমূখী ব্যবহারের জন্য উচুঁ ভিটা, কাটা ধান আনা নেয়ার জন্য হাল্কা কিন্তু টেকসই পরিবহণ এবং বাজার ব্যবস্থাপণা গড়ে তুলতে হবে। দাদনের ছোবল থেকে রক্ষায় ‘হাওর উন্নয়ন ব্যাংক’, হাওর কৃষি গবেষণা এবং হাওর মাৎস্য গবেষণ ইসস্টিটিউট স্থাপন বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাওর নিয়ে অধ্যয়ন/ গবেষণার সুযোগ থাকতে পারে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, প্রকুর গুলো খনন করে দেন, হাওরের ৮০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
হাওরের প্রাণ, পানি। পানিকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকা আবর্তিত হয়। এ পানি মাছের খনি, এ খনি থেকে মহা মূল্যবান “মনি ও মানি” আহরণ করা সম্ভব। আমার স্বপ্ন, জল, জলা ও চাষ ভূমি সুরক্ষায় হাওরে পরিকল্পিতভাবে সুবিধাজনক স্থানে ‘গ্রাম সৃজন’ করা হবে। নদী, বা পুকুর খননের মাটি দিয়ে তৈরী স্বপ্নের এ গ্রামে থাকবে আধুনিক সকল সুবিধাসহ বহু স্তর বিশিষ্ট বিল্ডিং । গ্রামের মধ্যে বা চারিপার্শ্বে থাকবে অনেক অনেক পুকুর। সারা বছর এ পুকুরে বিভিন্ন স্তরে মাছ, মুক্তা চাষ হবে, পাড়ে থাকবে বিভিন্ন জাতের ফল গাছ, শাক সব্জি, গরু-ছাগল, হাঁস মুরগী এবং পরিণত করা হবে পর্যটন বিনোদনের ’জলপুরী’; আয় ও খাদ্য উৎপাদন হবে অকল্পণীয় । শুষ্ক মৌসুমে ‘ডুবা সড়ক’ এবং বর্ষায় ‘নাও’ বা কোথাও কোথাও থাকবে ’আভুরা সড়ক’ এর যোগাযোগ ব্যবস্থা। হাওর থেকে উল্টো স্রোত, অন্যত্র অভিবাসন রুখে দিয়ে সারা বছর ব্যাপী কর্মক্ষম, স্বাচ্ছন্দময়, সক্ষম উন্নত জীবন যাপনের এটি হবে অন্যতম উপায়।
সরকার হাওর উন্নয়নে বিশ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পণায় ১৭টি বিষয়ে ১৫৩ টি প্রকল্পে মোট বাজেট বরাদ্দ ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। পাঁচ, দশ ও বিশ বছর (২০১২-২০৩২) মেয়াধী তিন কিস্তিতে তা বাস্থবায়ন হবে। মহাপরিকল্পণায় Agricultural development for Food Security-এর আওতায় মোট প্রকল্প সংখ্যা হচ্ছে ২০টি; বরাদ্দ ২ হাজার ৩৮ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা মাত্র। হাওরের এ মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নে হাওর বোর্ডকে শক্তিশালী, নিজস্ব জনবল বাড়ানো, অবিলম্বে কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দ প্রদাণ করতে হবে। মহা পরিকল্পণা এবং আমার স্বপ্ন ‘গ্রাম সৃজন’ বাস্তবায়ণ হলে হাওরের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে; বর্তমান খাদ্য ভান্ডার হাওর আরো মজবুত, পুষ্টিকর , সমৃদ্ধ খাদ্যের উন্নত ও স্থায়ী উৎসে পরিরণত হবে হাওর ভাটি বাংলা।
সংগ্রহ : কিশোরগঞ্জ ডটকম