সাইফুল হক মোল্লা দুলু, কিশোরগঞ্জ ।।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ_ প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের স্মৃতিবিজড়িত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক রথখলা ময়দান। নেতাজী সুভাষ বসু, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মণি সিংহ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময় এ ময়দানে দাঁড়িয়ে বজ্রকণ্ঠে উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেছেন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ এ রথখলা ময়দান আজ এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভূমিখোরদের দখলে। স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও রথখলা ময়দান সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর রাখেন না।
জেলা শহরের মধ্যখানে নরসুন্দা নদী বিধৌত রথখলা ময়দান। একে কেন্দ্র করেই এলাকার নাম হয় রথখলা। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ময়দানের পূর্বপাশে মানসী সিনেমা হল-সংলগ্ন এলাকার প্রায় ২০ শতক জায়গা দখল করে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। উত্তর ও পশ্চিম দিকের প্রায় ১০ শতাংশ ভূমির অবস্থাও বেহাল। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে কমিউনিটি পুলিশের কার্যালয় তৈরি করা হয়েছে। চারপাশের প্রায় এক একর ভূমি এরই মধ্যে দখল হয়ে গেছে। মাঠের পাশে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হয়েছে। ভেতরে প্রাইভেটকার রেখে মাঠকে অস্থায়ী গ্যারেজে পরিণত করা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, দিন দিন দখলদারদের কবলে পড়ে মাঠটি ছোট হয়ে আসছে। ঐতিহ্যবাহী এ মাঠ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রশাসন ও রাজনীতিবিদরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
তারা আরও জানান, এই মাঠে ‘৭০-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের ডাকে একাধিক সমাবেশ হয়। আজকের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে এই রথখলা ময়দানেই পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
পরিবেশ রক্ষা মঞ্চের (পরম) সভাপতি অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ সাদী বলেন, রথখলা মাঠ এ জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি প্রধানতম অংশ। এ ময়দানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নেতাজী সুভাষ বসু সভা করেছেন। পরে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এ মাঠে বক্তব্য রেখেছেন। স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তি সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে এই রথখলা এক বিশাল অবদান রেখেছে। এই মাঠটি আজ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি জেলা প্রশাসনসহ সব মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কিশোরগঞ্জ ছড়াকার সংসদের সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম জাহান বলেন, রথখলা মাঠটি সবসময় সভা-সমাবেশের জন্য ব্যবহার হয়েছে। হঠাৎ কার প্ররোচনায় এ মাঠে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।
কিশোরগঞ্জ সম্মিলিত নাগরিক ফোরামের সভাপতি এনায়েত করিম অমি ইতিহাসের অংশ এ মাঠটি যথাযথ সংরক্ষণসহ একটি স্থায়ী মঞ্চ তৈরির দাবি জানান। পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ বলেন, প্রশাসন মাঠটি উদ্ধার করে দিতে পারলে পৌরসভার পক্ষ থেকে একটি স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হবে। ঐতিহ্যকে রক্ষা করা পৌরসভার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ময়দানের বিষয়টি ভালোভাবে তিনি জ্ঞাত নন। জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখার মাধ্যমে তিনি খোঁজখবর নেবেন। পরে রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
সূত্র : কিশোরগঞ্জের রথখলা ময়দান ভূমিদস্যুদের দখলে (সমকাল, ২৪ মে ২০১৭)