মুক্তিপণ না পেয়ে ইরাকে বাংলাদেশিকে নির্যাতনের পর হত্যা!


আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকে অপহরণের পর দেড় সপ্তাহ রোমহর্ষক নির্যাতন চালিয়ে আবদুল হালিম (৩৩) নামের এক বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে অপহরণকারী চক্র। অপহরণকারী চক্রটিও বাংলাদেশের।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় ওই চক্রের দেশীয় দুই সদস্যকে আটকের পর মোমিনুল নামের অপহৃত আরেক বাংলাদেশিকে ইরাকে ছেড়ে দেয় চক্রটি। হালিমের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন মুক্তি পাওয়া মোমিনুল।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ইরাক প্রবাসী ফেনীর ছাগলনাইয়ার আবদুল হালিম ও টাঙ্গাইলের কালিহাতির মোমিনুল নামের দুই বাংলাদেশিকে গত ২ নভেম্বর এই দেশেরই একটি চক্র অপহরণ করে।

গত ১০ নভেম্বর হালিম ও মোমিনুলের স্বজনেরা মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গেলে চক্রের দুই সদস্যকে পুলিশ আটক করে। পরে পুলিশের তৎপরতায় মোমিনুল সোমবার ভোরে অপহরণকারী চক্রের হাত থেকে ইরাকে মুক্তি পান।

হালিমকে তিন দিন আগে অপহরণকারীরা মেরে ফেলেছে বলে হালিমের স্বজন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশকে জানিয়েছেন মুক্তি পাওয়া মোমিনুল।

জানা গেছে, দেড় বছর আগে দরিদ্র পরিবারের স্বজনদের মুখে হাসি ফোটাতে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের নুর আহম্মদের ছেলে আবদুল হালিম একটি এজেন্সির মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের বাগদাদ শহরে যান। প্রবাস জীবনের দুই বছরে ভিসা ও টিকেটের টাকাও পাঠাতে পারেননি হালিম।

এর মধ্যে ২ নভেম্বর বিকেল ৪টায় একটি ইন্টারনেট নম্বর থেকে বৃদ্ধা মা হোসনে আরা বেগমের (৬৫) মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে প্রবাসী আবদুল হালিম আহাজারি করে বলেন, ‘মা এখানের লোকগুলো আমাকে ধরে এনে মারধর করে ঝুলিয়ে রেখেছে। তাদেরকে ছয় লাখ টাকা না দিলে আমাকে মেরে ফেলবে।’

ওই সময় হালিমের ভাইসহ অন্য স্বজনেরাও অপহৃত হালিম ও অপহরণকারী দলের সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। একইভাবে পরদিন ৩ ও ৭ নভেম্বর রাত ১০টায় আবারো ফোন করে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা আবদুল হালিমকে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলায়।

ওই সময় তাকে বাঁচানোর আকুতি প্রকাশ করে বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও তাদের টাকার ব্যবস্থা কথা বলেন হালিম। কথা বলার একপর্যায়ে হালিমকে মারধর শুরু করে তা তার স্বজনদের শুনায় তারা। পরদিন দুই লাখ টাকা যোগাড় করেছে বলায় তাকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামানো হয়।

এরই মধ্যে সাগর আহমেদ, ০০৯৬৪৭৫০০৮৯৭১৬৪ নম্বর থেকে হালিমের চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় নির্যাতনের বেশ কিছু ছবি পাঠানো হয় স্বজনদের কাছে। হালিমের নির্যাতনের ছবি দেখে দিশেহারা মা-বাবা ও ভাই বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা যোগাড় করে।

হালিমের ভাই ওবায়দুর নুর মানিক অপহরণকারীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ট্রেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া রেল স্ট্রেশনে নামেন। তখন অপহরণকারীদের একজন মানিকের সঙ্গে কথা বলে তিনি কোথায় আছে জানতে চায়।

মানিক টাকা নিয়ে আখাউড়ায় রয়েছেন জানিয়ে অপহৃত ভাই হালিমের সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু বার বার কথা বলার আগ্রহের পরও কথা বলতে না পারায় কৌশলে টাকা নিয়ে গভীর রাতে ট্রেনে চড়ে ফেনী চলে আসেন মানিক। ইরাকে থাকা হালিমের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করেন হালিমের স্বজনেরা।

এদিকে, গত ১০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার অপর ইরাক প্রবাসী মোমিনুলের স্বজনেরা টাঙ্গাইল থেকে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান। ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানা পুলিশকে জানানো হয়।

খবর পেয়ে ওই থানার এএসআই মো. আবু আহম্মদ সুজন চক্রটিকে ধরতে তৎপর হন। অপহৃত দুইজনের স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগের ভিত্তিতে দুই পক্ষ ব্রাহ্মণবাড়িয়া যায়। সেখানে যাওয়ার পর অপহরণকারীদের নির্দেশনা মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নন্দনপুর নামার পর নদী পার হয়ে ওপারে যেতে বলে চক্রটি। তাদের গতিবিধি পুলিশ নজরে রাখে।

এসময় ওই জেলার বিজয়নগর থানার নন্দকোলা গ্রামের গোলাম নবীর ছেলে এক সময়ের প্রবাসী হাবিল (৩৭) ও তার ভগ্নিপতি সদর থানার শিমরাইকান্দি গ্রামের হাফিজ আহম্মদের ছেলে সুমন (৩১) মুক্তিপণের টাকা নিতে আসে।

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে হাবিল পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে সুমন। সুমনের দেয়া তথ্য মতে হাবিলের স্ত্রীকে পুলিশ আটক করলে হাবিল পুলিশের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে।

অপহৃতদের স্বজন ও পুলিশের যোগাযোগের ভিত্তিতে ইরাকে আটক মোমিনুলকে ছেড়ে দেয়। হালিমকেও ছেড়ে দিয়েছে বলে জানায় ওই চক্রটি।

তবে বর্তমানে হালিমের ভাগ্যে কী ঘটেছে এ ব্যাপারে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হালিমের স্বজনেরা নিশ্চিত হতে পারেননি। পুলিশ মুক্তি পাওয়া মোমিনুলের সঙ্গে কথা বলেছে। মোমিনুল পুলিশকে জানিয়েছেন, হালিমকে মেরে ফেলা হয়েছে।

এদিকে এ খবর শোনার পর থেকে অপহৃত হালিমের বৃদ্ধ বাবা-মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। স্ত্রী ও স্বজনদের আহাজারিতে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। হালিমের পাঁচ বছর বয়সী একমাত্র ছেলেও অনেকটা নির্বাক।

হালিমের বাবা নুর আহম্মদ কান্না জড়িত কণ্ঠে তার ছেলেকে জীবিত কিংবা মৃত ফেরত আনতে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সদয় দৃষ্টি কামনা করেছেন।

এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন হালিমের ভাই আবদুল মতিন ও ওবায়দুর নুর মানিক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার এএসআই আবু আহম্মদ সুজন জানান, হাবিলের ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে আরও অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা শুনেছি।

তিনি বলেন, ইরাকে অপহৃত মোমিনুল ছাড়া পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। হালিমকে অপহরণকারীরা মেরে ফেলেছে বলে মুক্তি পাওয়া মোমিনুল তাকে জানান।

সূত্র : ইরাকে মুক্তিপণের জন্য বাংলাদেশিকে রোমহর্ষক নির্যাতনের পর হত্যা!  [পরিবর্তন, ১৫ নভেম্বর ২০১৭]

Similar Posts

error: Content is protected !!