গণপ্রস্রাব বন্ধ করতে নিকলীর চা দোকানি খোকনের শিল্পকর্ম!

বিশেষ প্রতিনিধি ।।

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা নিকলী বাজারের ঐতিহ্যবাহি আমতলায় খোকন বর্মন (৩৫) নামে এক চা দোকানির ভিন্ন মাত্রার শিল্পকর্ম গণপ্রস্রাব বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রশংসিত বৃক্ষচিত্র দেখতে ভিড় করছে নানা পেশার মানুষ।

জানা যায়, খালের মুখে দখিনা বাতাস আর হাতের কাছে সকল সুবিধার কারণে নিকলী পুরান বাজারের শ্যামসুন্দর সাহার আমতলাটি এক সময় হয়ে ওঠে উপজেলার প্রথিতযশা রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজসেবকদের মিলনস্থান। সর্বদাই ছিমছাম পরিপাটি। পরিচ্ছন্নতার কোনো কমতি ছিলো না। কালের আবর্তে সেইসব গুণিজনদের কেউ নিয়েছে চিরবিদায়। কেউ হারিয়েছে সতীর্থ। ভাঙ্গা হাটে ছাগল আর কাকের ভিড়ের মতোই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আমতলাটি হয়ে উঠে অলিখিত গণপ্রস্রাবখানা। দুর্গন্ধ, ময়লা-আবর্জনায় রূপ নেয় ভাগারের।

আমতলাতে যাওয়ার বর্তমান পথমুখের টংঘরে চা দোকানি লুলু বর্মণ মাসপাঁচেক আগে প্রবাসি হন। লুলুর বড়ভাই স্বর্ণকার খোকন বর্মনের ব্যবসাও পুঁজি সমস্যায় ন্যূব্জ। স্বর্ণকারের পেশা ছেড়ে বন্ধ চা দোকানটি সচল করেন তিনি। পেছনের আমতলায় পাখিপ্রেমিক খোকন গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি দিয়ে গড়ে তোলেন পাখিদের অভয়াশ্রম। নানা প্রজাতির পাখির কলরবে মুখরিত হয়ে উঠে আমতলা।

কিন্তু প্রস্রাবের কটু গন্ধ আর আবর্জনায় মশার উৎপাত। বন্ধ করতে উপায় খুঁজতে থাকেন খোকন। আমতলায় যাবার পথটি বন্ধ করলে পাহারাদার আর ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে তা মাত্র দুয়েক দিন স্থায়ী হয়। কাজের ফাঁকে নতুন পথ খুঁজতে ভাবনায় বসেন। চোখে পড়ে পুরানো গাছের বাকল, ডালে নানারকম আদল। স্থানীয় বাজার থেকে কিনেন রঙ-তুলি। প্রাকৃতিক অবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে নামমাত্র রঙে ফুটিয়ে তোলেন কল্পনার আদলকে।

সহযোগিতা নেন দৈনিক মানবজমিনের নিকলী প্রতিনিধি ও আঁকিয়ে খাইরুল মোমেন স্বপনের। পুরনো আম গাছগুলির ভাঙ্গা ডালের কোথাও ভয়াবহ দানব, কোনো ডালের পরগাছার শেকড় সাপসদৃশ অদ্ভুত প্রাণি জিহ্বা বের করে নেমে আসছে নীচে। কোনো গাছের খোঁড়লের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সাধু মনীষি। একে একে রূপ নেয় কয়েকটি বৃক্ষকর্ম।

প্রস্রাব করতে গিয়ে গাছে হঠাৎ ভুতুরে মুখ, বসতে গিয়ে ভয়ঙ্কর কিছুর নেমে আসতে দেখে ভয়ে উঠে আসে প্রস্রাবকারি। আবার কেউ কেউ অর্ধেক প্রস্রাব করামাত্র গাছের ভেতর থেকে মণীষির চেয়ে থাকায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নষ্ট করছে পরিধেয় কাপড়। পরেরবার গেলেও প্রস্রাবের উদ্দেশ্যে কেউ যাচ্ছেন না। গেলেও পেতে রাখা বাঁশের মাচায় বসে চা খেতে খেতে অবসরের আড্ডায় মেতে উঠছেন লোকজন। আলোচ্য হয়ে উঠছে আমতলার ঐতিহ্য আর খোকনের প্রশংসিত উদ্যোগ।

খোকন বর্মণ এই প্রতিনিধিকে বলেন, ঐতিহ্য হারানো আমতলাটি নিয়ে সমবেদনা উপলব্ধি করতাম। গাছগুলোর বাকল আর খোঁড়লের ক্ষুব্ধ আদল একদিন আমার চোখে পড়ে। আমি শুধু সেই ভয়ঙ্কর বিষয়টি মানুষের সামনে স্পষ্ট করার উদ্যোগ নিই। স্বপন ভাইয়ের সহযোগিতায় আমার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। খোকন আনো জানান, তার আর্থিক সামর্থ্য কম। এ কাজে তার প্রয়োজনও কম। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো ভালো কিছু করে দেখাতে পারতাম।

প্রবাস ফেরত জাফরাবাদ গ্রামের নবী হোসেন বলেন, প্রায় ১০ বছর বিদেশে থেকে আসলাম। এসেও বাজারের লোকজনের প্রস্রাবখানা বলেই দেখেছি। বসে চা খাওয়া তো দূরে কথা, নাক-মুখ বন্ধ করে দুয়েক মিনিট দাঁড়ানো ছিলো নরক যন্ত্রণারই মতো। মাশাল্লাহ, এখন এখানে সুন্দর পরিবেশে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে চা খেতে সাচ্ছন্দ বোধ করি।

নিকলী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কারার শাহরিয়ার আহম্মেদ তুলিপ জানান, সদিচ্ছায় অনেক অসুন্দরকেও সুন্দর করা সম্ভব। আমি খোকনের বৃক্ষচিত্রের কথা শুনতে পাচ্ছি। তার নান্দনিক উদ্যোগে আমতলাটি তার ঐতিহ্য ফিরে পাওয়ায় খোকনকে সদর ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

Similar Posts

error: Content is protected !!