বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল শুধু নদী ও বন্যার গল্পে সীমাবদ্ধ নয়; এখানে লুকিয়ে আছে শত বছরের জীবিকা ও সংগ্রামের অনন্য ইতিহাস। একসময় গোবরের লাকড়ি, খরস্রোতা নদীতে জেলেপেশা, কিংবা মৌসুমি কৃষিকাজ—এসবের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনযাত্রা। আধুনিকতার ঢেউয়ে অনেক পেশাই আজ বিলুপ্তপ্রায়। সেই হারানো ঐতিহ্য ও টিকে থাকা সংগ্রামের গল্প নিয়ে শুরু হচ্ছে নিকলীকেন্দ্রিক প্রথম অনলাইন সংবাদমাধ্যম “আমাদের নিকলী ডটকম”-এর ধারাবাহিক ফিচার প্রতিবেদন—“হাওরাঞ্চলের ব্যতিক্রমী জীবিকা”। আজ থাকছে “লুড়া টুহানি”
মোহাম্মদ তোফায়েল আহছান ।।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা একটি অনন্য ভৌগোলিক অঞ্চল। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে হাওরাঞ্চলের জমি মূলত একফসলি। অগ্রহায়ণ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ধান উৎপাদনই এই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির প্রধান ভরসা। বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ধান কাটা, যা জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলে। এ সময় কৃষক পরিবারগুলোতে যেমন উৎসবের আমেজ, তেমনি ঋণ পরিশোধ, লোকসান ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে বিষাদের ছায়াও দেখা দেয়। এই কৃষি মৌসুমে দরিদ্র পরিবারের কিশোর-কিশোরীরা একটি বিশেষ কার্যক্রমে যুক্ত হয়—ধান কুড়ানি। যদিও এটি প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পেশা হিসেবে স্বীকৃত নয়, তবে বাস্তবতায় এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
হাওরাঞ্চলের কৃষকের জীবন: দারিদ্র্য ও টিকে থাকার সংগ্রাম
হাওরাঞ্চলের কৃষিনির্ভর জীবন একদিকে যেমন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরা, তেমনই অন্যদিকে তা দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তায় ঘেরা। কৃষকরা তাদের ফসল ফলানোর জন্য প্রায়শই কৃষিঋণ অথবা স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। এই ঋণের বোঝা তাদের কাঁধে এতটাই ভারী হয়ে থাকে যে, ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় তা শোধ করার তীব্র চাপ। অনেক সময় দেখা যায়, ফসল বিক্রি করেও তাদের ঋণের উচ্চ সুদ মেটানো সম্ভব হয় না, যার ফলে আরও গভীর ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন।

হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জীবন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে রোগ-বালাই, অসময়ের বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। সামান্য ক্ষতিতেও তাদের সারা মৌসুমের পরিশ্রম ও বিনিয়োগ মুহূর্তেই পণ্ড হয়ে যায়। যখন রোগ-বালাই, অকাল বন্যা বা শিলাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তখন তাদের হাতে ঋণের বোঝা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এই চরম অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির কারণে দারিদ্র্য হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, হাওরাঞ্চলে সবার নিজস্ব চাষযোগ্য জমি নেই। অনেক পরিবার সম্পূর্ণ ভূমিহীন। তাদের নিজস্ব কোনো ভিটেমাটিও নেই। ফলে তারা অন্যের জমিতে বা উঠানে ছোট ঘর তুলে কোনোমতে জীবনযাপন করেন। জীবিকার তাগিদে এই ভূমিহীন পরিবারগুলোর অনেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য বড় শহরে চলে যান। সেখানে তারা বিভিন্ন ধরনের দিনমজুরির কাজ করেন। তবে, ধান কাটার মৌসুমে অনেকেই আবার গ্রামে ফিরে আসেন। কারণ তখন অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে বাড়তি কিছু আয় করার সুযোগ থাকে।
হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জীবন মূলত অনিশ্চয়তা, ঋণের বোঝা এবং দারিদ্র্যের এক চক্রাকার আবর্তে আটকে আছে। প্রকৃতির প্রতিকূলতা এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাদের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত আরও কঠিন করে তোলে।
কিশোর-কিশোরীদের ধান কুড়ানি: এক অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশা
কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে ধান কাটার মৌসুমে হাওরের দরিদ্র পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি বিশেষ কাজ তৈরি হয়—ধান কুড়ানি। ভোরে তারা ছোট ছোট বস্তা বা থলি কাঁধে নিয়ে ক্ষেতে যায়। যেসব ক্ষেতে ধান কাটা হয়, তার পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা খুঁজে বেড়ায় অদেখা বা পড়ে থাকা গোছা। জমির মালিকরাও এ ধান ফেলে আসায় কোনো দাবি তোলেন না।

ধানের গোছা কুড়ানোর পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের ধান সংগ্রহের আরেকটি উপায় ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ধানকাটার পর ক্ষেত থেকে কয়েকটি আটি একসাথে বেঁধে বোঝা তৈরি করে সেগুলো মাথায় বা কাঁধে বয়ে নিয়ে গৃহস্থের আঙিনায় বা ধান মাড়াইয়ের খলায় পৌঁছে দিতেন শ্রমিকরা, যাদের স্থানীয়ভাবে ‘দাওয়াল’ বলা হয়। দাওয়ালদের হাঁটার পথে বোঝার ঝাঁকুনিতে অনেক ধান আটি থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। কিশোর-কিশোরীরা সেগুলোও সুযোগমতো কুড়িয়ে নিয়ে নিজেদের বস্তা বা থলেতে ভরে বাড়ি ফিরত।
এভাবে দিন শেষে প্রত্যেকে গড়ে ২ থেকে ৪ কেজি ধান সংগ্রহ করতে পারতো। পুরো মৌসুমে একজন কিশোর/ কিশোরী প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত ধান ঘরে তুলতে পারতো। পরিবারের একাধিক সদস্য এ কাজে যুক্ত থাকলে সংগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়ে। এসব শস্য মজুত করে অনেক পরিবার দীর্ঘদিনের খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে।
ইঁদুরের গর্তে লুকানো ধান: ধান সংগ্রহের আরেক ভিন্ন উপায়
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে কৃষিকাজ বহু পুরনো। ধান কুড়ানো, যা একসময় অভাবী মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি প্রধান উপায় ছিল, তা শুধু কৃষকদের ঝরে পড়া ধান সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ধান কুড়ানোর আরও একটি কৌশল ছিল, যা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমের পরিচায়ক। এটি হলো ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ।
বর্ষা শেষ হয়ে যখন ধান পাকতে শুরু করত, তখন ইঁদুরেরা সক্রিয় হয়ে উঠত। তারা জমির আইল ঘেঁষে নিজেদের বাসা তৈরি করত এবং অত্যন্ত সুকৌশলে ধানের গোছা কেটে গর্তের ভেতর ঢুকিয়ে রাখত। কৃষকেরা যখন ফসল কেটে নিয়ে যেতেন, তখন ধানক্ষেত অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যেত। এই সময়টাকেই কাজে লাগাত কিশোর-কিশোরীরা। তারা তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বের করত। তারপর, বিশেষ কায়দায় মাটি খুঁড়ে গর্তের ভেতর থেকে ইঁদুরের জমিয়ে রাখা ধানের গোছা বের করে আনত।

এই কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য হলেও এটি ছিল বেশ ফলপ্রসূ। কারণ, একটি গর্ত থেকে প্রায়শই ভালো পরিমাণের ধান পাওয়া যেত। যদিও মাঝে মাঝে তারা এই কাজে বড়দের সাহায্য নিত, তবে বেশির ভাগ সময়ই তারা নিজেরা এই কাজটি করত। ইঁদুরের এই গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করার এই পদ্ধতিটি তাদের জন্য ধান কুড়ানোর একটি অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছিল। এই পদ্ধতি কেবল পরিশ্রমের নয়, বরং গ্রামীণ জীবনে টিকে থাকার এক বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
পরিবারের অর্থনীতিতে অবদান
হাওরাঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা এক নিরন্তর সংগ্রাম। এসব পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা, বিশেষ করে পুরুষরা, দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। তাদের এই উপার্জন দিয়ে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো কোনোমতে পূরণ হয়। কিন্তু পরিবারের কিশোর-কিশোরীরাও এই অর্থনৈতিক সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক আয়, যা সাধারণত কৃষিভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে আসে, পরিবারের অর্থনৈতিক বোঝা কিছুটা হালকা করে।

অনেক সময় পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ধান কাটা, মাড়াই করা, বা ক্ষেত থেকে কুড়িয়ে ধান সংগ্রহ করার মতো কাজ করে। তাদের এই প্রচেষ্টা পরিবারের খাদ্য খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। অনেক ক্ষেত্রে, তাদের সংগ্রহ করা এই ধানই পরিবারের প্রধান খাদ্য উৎস হয়ে দাঁড়ায়। এটি শুধু তাদের খাবারের সংস্থান করে না, বরং পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও সাহায্য করে।
গ্রামীণ হতদরিদ্র পরিবারগুলোতে এই ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক আয় একটি নিয়মিত চিত্র। এটি প্রমাণ করে যে, দারিদ্র্য মানুষকে টিকে থাকার জন্য যেকোনো উপায় খুঁজে বের করতে বাধ্য করে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য, শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত, নিজেদের অবস্থান থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া, যেখানে দারিদ্র্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়।
তাদের এই সংগ্রাম শুধু দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য নয়, বরং উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্নের জন্যও। দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় এই অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত থাকার কারণে তাদের শিক্ষা ও সুস্থ শৈশব থেকে বঞ্চিত হতে হয়। তাই তাদের এই শ্রমকে কেবল অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে না দেখে, বরং দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা উচিত।
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট
সময়ের সঙ্গে হাওরাঞ্চলের জীবনমানে এসেছে অনেক পরিবর্তন। একই সাথে বদলে গেছে ধান কাটার ধরনও। একসময় যেখানে দাওয়ালেরা ধানের আটি বহন করার পথে শিষ ছিটকে পড়ত, আজ সেখানে প্রযুক্তি জায়গা করে নিয়েছে। অনেক কৃষক এখন ক্ষেতেই মাড়াই মেশিন ব্যবহার করে সরাসরি গোছা থেকে ধান আলাদা করে নিচ্ছেন। ফলে আর আগের মতো ধান পড়ে থাকার সুযোগ থাকছে না। এর ফলেই কিশোর-কিশোরীদের কুড়িয়ে নেওয়ার সেই কাজ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। বলা যায়, সময়ের স্রোতে একসময়ের এই জীবিকার উপায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বৈশাখ মাসকে কেন্দ্র করে কিশোর-কিশোরীদের ধান কুড়ানি কাজটি কোনো স্বীকৃত পেশা বা অর্থনৈতিক খাতের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। অথচ বাস্তবতায় এটি হাওরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক টিকে থাকার ক্ষেত্রে বড় সহায়ক শক্তি ছিল। তাই এ মৌসুমকেন্দ্রিক অপ্রাতিষ্ঠানিক আয়কে শুধু প্রথাগত কৃষিকাজের উপপণ্য হিসেবে না দেখে বরং একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
লেখক: মোহাম্মদ তোফায়েল আহছান, সংবাদমাধ্যম কর্মী


