স্বপ্ন তোমার মরে নাই

bangbandhu sheikh mujibur rahman

এস এম মুকুল ।।

বিশ্ব নন্দিত নেতা ফিদেল কেস্ত্র’র বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করা সেই উক্তিটি দিয়েই লেখাটির শুরু হোক। তিনি বলেছিলেন- “I have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and in courage, this man is the Himalayas”. ভারতের একজন বিচারপতি বঙ্গবন্ধুর ৭০-এর নির্বাচনী ভাষণ ও ৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে বলেছিলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন আর লেলিনের বিপ্লবী চেতনার মূর্ত প্রতীক। তাই বিশ্ব স্মরণীয নেতা লেলিন, মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, চার্চিল, ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন এবং জন কেনেডির মতো রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধু। কারণ তিনি বিশ্বের বুকে বিরল ব্যতিক্রম ইতিহাসের জন্মদাতা। বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ হিসেবে। লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে মুকুটহীন সম্রাট বলে যতার্থই আখ্যা দিয়েছিলো। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু- বাঙালি জাতির জনক এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা। গ্রাম বাংলায় একটি কথা এখনো প্রচলিত আছে- এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন তিনটি জিনিস চিরসত্য হয়ে থাকবে। এক. ইংরেজের শাসন, দুই. পাকিস্তানের শোষণ আর তিন. শেখ মুজিবের ভাষণ। হ্যাঁ, অতি কথা সত্য। ইংরেজের শাসন ক্ষমতা, পাকিস্তানিদের শোষণ লোলুপতা বাঙালিরা কখনো ভুলবে না। আর এই সব ইতিহাসকে পদদলিত করেছে- বিশ্বনন্দিত তেজোদীপ্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। স্বাধীন বাংলার সূত্রপাত হয়েছিলো মূলত এই ভাষণকে কেন্দ্র করেই। এত শৈল্পিক নিপুণতা, শব্দ-বাক্যের কারুকার্য, বোমারু তেজষ্ক্রীয়তা, জয়ের উদ্দীপনা যোগানো, সর্বোপরি মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে লড়াইয়ের দিকনির্দেশনা পৃথিবীর আর কোনো ভাষণ, বক্তৃতা, বিবৃতিতে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
bangbandhu sheikh mujibur rahman
সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি আর্টিকেলে লেখেন, ‘১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে উঠলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালি কর্মকর্তারাও তার আঁচ পেতে থাকে। ভেতরে ভেতরে আলোচনা চলতে থাকে। মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হল। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম’। বিএনপি বরাবরই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দিনটি নিয়ে উদাসীন হলেও দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান স্বীকার করেছিলেন দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা। ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এই লেখায় জিয়াউর রহমান নিজেই লেখেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল তার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। ওই লেখায় জিয়া নিজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির জনক’ বলে উল্লেখ করেন।

‘আমি প্রতিহিংসা-প্রতিশোধে বিশ্বাসী নই। আমি রবীন্দ্রনাথের মানসে গড়া এক কোমল হৃদয়ের বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ শিখিয়েছেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখো। আমি সে বিশ্বাস ও ভালোবাসা দিয়ে সব হৃদয়কে জয় করতে শিখেছি। আমি আমার মানুষকে ভালোবাসি।’ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মুখেই কেবল এমন কথা মানায়। যার উদারতা অসংকোচে আঘাত হানে সকল সংকোচতায়। তাঁর বেদনার ভার যত; তার চেয়ে বেশি তাঁর স্বপ্নের ভার। তিনি সেই মানুষ যিনি বুঝেছিলেন বাঙালি জাতির সাঁইকি। তাই তিনি স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্ন একেঁ দিতে পেরেছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃদয়ে। বাঙালিদের মনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন আশার আগুন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বলতে তাঁর কিছুই ছিলো না। দিন রাত অবিরাম বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলনই ছিলো তার আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-সাধনার সঙ্গী। রাজনৈতিক জীবনে তিনি কতবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, কত বছর জেলে কাটিয়েছেন সে হিসেব শুধু আফসোসই বাড়াবে। একটি বাংলাদেশের জন্য; স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য জেল-জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়ন এমনকি মৃত্যুর মতো বিষাদময় পরিস্থিতির জন্য তিনি যেন প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকতেন। মুক্তিকামী বাঙালিদের জন্য যা কিছু করণীয় তার সবই যেন তাকে করতেই হবে। তাই শাসকদের কঠোর রীত অপশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারির মাঝেও তাঁর কৌশলী নেতৃত্ব বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে, থাকবে।

বঙ্গবন্ধুর অসীম স্মরণ শক্তি ছিল। একবার কাউকে দেখলে কোনোদিন তাকে ভুলতে পারতেন না। বহু বছর পরে দেখা হলেও চিনে নিতেন সহজে। কর্মীদের পরিবারের সদস্যের মতো মনে করতেন। নাম ধরে ডাকতেন। স্নেহের পরশ মাখা হাত বুলিয়ে কথা বলতেন কর্মীদের সাথে। তিনি ছিলেন দুঃখি মানুষের নেতা। বাঙালির চিরকালের সেই কাঙ্খিত নেতাকে শেষ করে দিয়েছে এই জাতির কতিপয় বিপথগামী। তাতে কি? নেতা নেই- আর তার স্বপ্ন, আদর্শ, চেতনা। এই চেতনার স্রোতে শত বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে বাঙালিরা। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

পৃথিবীকে সভ্যতার আলোকবর্তিকায় নিয়ে যাবার মতো এমন মহান নেতার আবির্ভাব হয়েছে যারা জাতির আশা-আকাঙক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে মুক্তির ছক এঁকেছেন জাতির মননে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা কয়েক যুগ কারারুদ্ধ থেকেও তিনিই ছিলেন সেখানকার সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্যতম আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। লিংকন, গান্ধী, লুথারের মতো অবিসংবাদিত আদর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধু আজীবন  নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস রাজনীতির চর্চা করিয়াছেন।

তাঁকে নিয়ে কি লিখব? কি বিষয়ে লিখব? কোন উপাধিতে ভূষিত করব তাঁকে? যে উপাধি-ই যুক্ত করি তাঁর নামের সাথে- নাম নয় বরং উপাধিই যেন ধন্য তার নামে! সকল আলোকিত বর্ণমালা তাঁর অমর কীর্তির কাছে ক্ষীণ হয়ে আসে। ব্যক্তিত্ব, বোধ, অসীম সাহস, অশেষ ত্যাগ, অকৃত্রিম দেশপ্রেম, মন্যুষত্ব আর চিরচেনা বাঙালিয়ানা সত্তার কাছে সব যেন হার মানে। তাই কোনো দলমতের আদর্শের অনুসারী না হলেও আমি তাঁর আদর্শের অনুসারী পথিক। একটি কথা না বললেই নয়- জীবনে যতবার, যতখানে, যতভাবে দেখেছি তার মুখ; আমি বিস্মিত, বাকরুদ্ধ হয়েছি এই ভেবে যে কী করে একজন মানুষ এত ক্ষমতাধর হয়েও এত সাধারণ হতে পারেন! অথবা এত সাধারণ হয়েও অসাধারণ ক্ষমতার উৎস হতে পারেন। কোন মায়াজালের মোহে একটা জীবনের শ্রেষ্ট সময়গুলো জেলে আর রাজপথের মিছিলে মিটিংয়ে কাটাতে পারেন। কতটা নির্লোভ চিত্তের অধিকারী হলে শাসকের দিকে অঙুলি নির্দেশ তুলে বাঙালি জাতির জন্য মৃত্যু ঝুঁকিকে সাথে করে ঘুরতে পারেন। তিনি কি না করতে পারতেন! পাক শাসকদের সাথে হাত মিলালে কত বিলাসী জীবন তিনি উপভোগ করতেন! অথচ সব মোহ এড়িয়ে একটি বাংলাদেশের জন্য, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জন্য এমন কি আছে যা তিনি করেননি! জেল-জুলুম, মৃত্যুঝুঁকির মুখে অকুতোভয় সেনানী তিনি। একজন মানুষ কতটা মহানুভব হলে তার বুকে মুখে লালন করেন পদ্মা মেঘনা যমুনার স্রোতধারা? তাঁর সুরতে যেন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন মানচিত্র। এসবই তাঁর বেলায় সম্ভব। কারণ তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। একবার মরেন দুইবার মরেন না…।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি। তিনি সোনার বাংলার রূপকার। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে শূন্য থেকে তিনি আবার দেশকে গড়ে তোলা শুরু করেন। উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের জন্য তিনি ৩ বছর সময় নেন। কিন্তু গঠনমূলক কাজে যে ধরনের নিষ্ঠাবান কর্মী, পরিশ্রমী, দূরদর্শী ও দক্ষ মানুষ দরকার তা পাওয়া খুব কঠিন হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতার পরে দেখা গেলো তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। সমাজতন্ত্রের কথা বলেছিলেন সেই সমাজতন্ত্র হবে শোষিত মানুষের এই অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু তার জন্য ওই অঙ্গীকার রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল না। পথ ছিল না খোলা, অঙ্গীকারের অভাব ছিল। বরঞ্চ এটাই অনিবার্য ছিল যে, তিনি এমনকি সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ থেকেও সরে যাবেন, প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না, রাষ্ট্রপতি হবেন এবং আয়োজন করবেন একদলীয় ব্যবস্থার।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতির চির কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে বহুমুখী কার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু পদে পদে বাধাগ্রস্তও হন। তারপর শুরু করেন স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার দ্বিতীয় মিশন। তাই তিনি উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি উৎখাত ও আত্মশুদ্ধির নির্দেশনা দেন জাতিকে। শিক্ষিত সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন- ‘শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটা কথা- আমরা শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক? আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। আপনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন- আমি এই যে দুর্নীতির কথা বললাম, এসব কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক দুর্নীতিবাজ? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং কারা করে? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? এই আমরা যারা ৫ ভাগ শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে। আত্মশুদ্ধি করতে হবে। গরিব কৃষত শ্রমিক আপনাদের মাইনে দেয়। আমরা গাড়ি চড়ি এই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ইজ্জত করে কথা বলুন; ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’

অবিশ্বাস্য, বিস্ময়কর! এমন অপ্রিয় সত্য কথা অসংকোচে অকপটে কোনো রাষ্ট্রনায়ক বলতে পারেন! তিনি পেরেছিলেন, কারণ তিনি জাতির পিতা। পিতা যেমন সন্তানদের শুধরে দিয়ে পথনির্দেশ করেন এর ব্যতিক্রম কিছু তা নয়। একজন রাষ্ট্রনায়কের এমন অভিভাবকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির উদাহরণ আর আছে কি? একটি জাতির অভিভাবকত্বে দায় না থাকলে এভাবে অকপটে আত্মশুদ্ধির কথা কেউ বলতে পারে না। জাতির জনক ও স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বলেই এটা সম্ভব হয়েছিলো। কেননা তার শক্তি, দুর্বলতা, সাফল্য ও ব্যর্থতার মূল উৎসই ছিল দেশের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা। তিনি মানুষকে ভালোবেসেছিলেন বলেই কোটি জনতার বুকে আসন নিতে পেরেছিলেন। দেশ ও জাতির প্রতি তার এ ভালোবাসা, তার কর্তব্যের প্রেরণা জুগিয়েছে দীর্ঘকালব্যাপী।

২৬ মার্চ ১৯৭৫ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণটি ছিলো সোনার বাংলা গড়ার দিকনির্দেশনা। সেই ভাষণে তিনি বলেন- আমরা যখন ক্ষমতায় এলাম, দেশের ভার নিলাম, তখন দেশের রাস্তাঘাট যে অবস্থায় পেলাম- তা রিপেয়ার করার চেষ্টা করলাম। সেনাবাহিনী নাই, প্রায় ধআবংস হয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনীর রাজারবাগ জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। সেই অবস্থা থেকে কি করি নাই। আমরা জাতীয় সরকার গঠন করলাম। এ কোটি লোককে ঘরবাড়ি দিয়েছি। রাষ্ট্রের লোকদের খাওয়ানোর জন্য বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়েছে। পোর্টগুলো সচল করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে ২২ কোটি মণ খাবার এনে বাংলার গ্রামে গ্রামে দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে হয়েছে। বন্যা হলো। মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেল, হাজার হাজার লোক না খেয়ে মরে গেল। দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে আনলাম। পাঁচ হাজার সাতশ লঙ্গর খানা খুললাম মানুষকে বাঁচাবার জন্য।’ একজন রাষ্ট্র স্থপতির এত ব্যাখ্যা করে বলার ঘটনা পৃথিবীতে দুর্লভ।

সেই ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন- পাকিস্তানীরা আমার সম্পদ এক পয়সাও দিলো না। আমার বৈদেশিক মুদ্রার কোনো অংশ আমাকে দিলো না। আমার গোল্ড রিজার্ভের অংশ আমাকে দিলো না। একখানা জাহাজ, একখানা প্লেনও আমাকে দিলো না। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পদ এক পয়সাও দিলো না। বরং যাবার বেলায় পোর্ট ধ্বংস করলো, রাস্তা ধ্বংস করলো। শেষ পর্যন্ত কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে তারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। তিনি আরো বলেন- ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত নাই। আমি ভিক্ষুক জাতির নেতা হতে চাই না। আমি চাই বাংলাদেশের কৃষক ভাইদের কাছে, যারা সত্যিকারের কাজ করে। যারা প্যান্ট পরা-কাপড় পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই- জমিতে যেতে হবে। ডাবল ফসল করুন। তাহলে কারো কাছে ভিক্ষুকের মতো হাত পাততে হবে না। কি চমৎকারভাবে অকপটে শিক্ষিত মানুষদের তিনি বলেছেন- আপনাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই। আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয়, সংসার চালায় গরীব কৃষক। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওরাই মালিক। বাঙালি জাতির সাঁইকি বুঝতে পেরেই তিনি অকপটে এসব কথা বলতে পারতেন অভিভাবকের দায় কাঁধে নিয়ে। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ এটাই ছিলো জনসম্মুখে বঙ্গবন্ধু দেয়া শেষ ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণে ছিলো স্বাধীনতার ডাক আর ২৬ মার্চ শেষ ভাষণে ছিলো- সোনার বাংলা গড়ার ডাক।

১৯৯৭২, ১৭ জানুয়ারি  বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের পর দেশ গড়ার নতুন প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিলো তার প্রধান লক্ষ্য।  তাই প্রথমে সুশিক্ষিত জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কালাকানুন আইন বাতিল করে নতুন আইন জারি করেন। শিক্ষা সংস্কারের জন্য ড. কুদরত-ই খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যুগান্তকারী পদপে নেয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ ও ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিকদের জমি এবং নতুন চর বিনামূল্যে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। গ্রামবাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিল্প বিকাশ ও কৃষি উৎপাদনের জন্য পল্লীবিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রায়নের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে তিনি বলেন- ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জনসংখ্যা প্রতিরোধ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামে সমবায় খামার প্রতিষ্ঠা করা হবে। ৬৫ হাজার গ্রামে সমবায় খামারে অধীনে জমির মালিক একভাগ, শ্রমিক একভাগ এবং সার সেচ ইত্যাদির খরচ বহন করার জন্য সরকার একভাগ ফসল পাবে। এভাবে ভূমিহীন কৃষকেরা জমির মালিক হবেন’। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠবে। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। গ্রামগুলো স্বনির্ভর হলে মানুষ শহরমুখি হবেনা। শহরে মানুষের চাপ কমবে। কি অসাধারন চিন্তা ছিলো তাঁর। ভাবা যায়, কোথায় দাঁড়াতো আজকের বাংলাদেশ।

ইতিহাসের মূল লক্ষ্য স্বাধীন সমাজ ও জাতি গঠন। ভাগ্যক্রমে বাঙালি সমাজে এমন এক ক্ষণজন্মার আবির্ভাব হলো- যার কর্ম-চেতনা আর বোধ সেই সমাজ ও জাতিকে নবজন্মে রূপান্তর ঘটালো। বঙ্গবন্ধু সেই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ যার ব্যক্তিত্বে ও সত্তায় লালিত হয়েছে সবুজের বুকে উদীয়মান লাল সূর্যের পতাকা। তাঁর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, দীর্ঘকায় দেহ সৌষ্ঠব্য, মাটির মায়া মাখানো সতেজ ভরাট মুখ যেন উদীয়মান সূর্যের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কণ্ঠস্বর বিস্ময়কর। ভাষণ বক্তৃতা যেন জ্বালাময়ী কবিতা। দেশের বাইরে গিয়েও তিনি বাঙালির পরিচয়ে বাঙালি মানুষের অধিকারের ন্যায্য হিস্যার প্রসঙ্গ টেনেছেন অকপটে, অসংকোচে, নির্ভয়ে, বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কন্ঠে। সত্য বলার দ্ব্যর্থহীন ভাষাজ্ঞান ও স্পর্ধা যেন শুধু তাকেই মানায়।

লেখাটি শেষ করব পার্শ্ববর্তী দেশের একটি নজির টেনে। বাংলাদেশের জনৈক উন্নয়নকর্মী সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলেন। সেখানকার স্থানীয়দের সহায়তায় নদীর ওপারে ভারতের একটি গ্রামে বেড়াতে গেলে তাকে বারান্দায় পিরিতে বসতে দেয়া হয়। ঘরের ভেতরে টানানো ছবি দেখে বাংলাদেশী এই কর্মী যেই বললেন- ‘ও, এটা মহাত্মা গান্ধীর ছবি’। ওমনি গৃহকর্তী অসন্তোষের সুরে বললেন- ‘না না, এভাবে বলবেন না। বলুন গান্ধীজি!’ গান্ধীজি বলতে হয়!! পার্শ্ববর্তী দেশের স্থপতির প্রতি সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাবোধ থেকে আমরা কি শিখলাম? বিবেক কি বলে?

এস এম মুকুল : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
writetomukul36@gmail.com

Similar Posts

error: Content is protected !!