হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনার সময় ১৫তম পর্বের ঠিক শেষের দিকে ষোড়শ শতাব্দীতে সৃ‌ষ্টি হওয়া কিছু গান সংগ্রহ করেছি বলেছিলাম। এমন কিছু গান দেওয়ার আগে লোকসঙ্গীত গবেষক প্রিন্স রফিক খানের কিছু কথা হুবহু তুলে ধরছি।

“লোকসঙ্গীত লোকসাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ সঙ্গীত বাংলাদেশের প্রাচীন এবং প্রধানতম সঙ্গীত। নিরক্ষর দরিদ্র ও শোষিত মানুষই লোকসঙ্গীতের জনক-ধারক-বাহক। বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক স্থানীয় সকল অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত লোককবির সহজ সরল ভাব স্বর-সুর হলো লোকসঙ্গীতের প্রাণ। মানুষের জাতিতাত্ত্বিক গোত্র ও গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ধর্মীয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গ্রন্থি উন্মোচন করছে লোকসাহিত্যের এই অন্যতম প্রাচীন শাখা লোকসঙ্গীত। এ সঙ্গীত মূলত বাউল, ভাটিয়ালি, বিরহ, বিচ্ছেদ, সাধন সঙ্গীত, নিগম সঙ্গীত, বৈষ্ণব সঙ্গীত, ইত্যাদি হতদরিদ্র নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের কাছে এ সঙ্গীতের আবেদন চিরায়ত। বাংলার লোকসমাজ থেকে সৃষ্টি সঙ্গীতই লোকসঙ্গীত। এ সঙ্গীতে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো জেলা কিশোরগঞ্জের মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর পালাকাব্যে উল্লেখ আছে, “বাঙ্গালীর গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গান” ছিল সেকালের প্রাচুর্য্যের পরিচয়। হাজার বছর ধরে কিশোরগঞ্জে গড়ে উঠেছে লোকসঙ্গীতের এক বিশাল ভাণ্ডার। ফলে এ অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের কথা কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছে “মৈয়মনসিংহ গীতিকা”র- মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, দস্যু, কেনারামের মতো বিখ্যাত পালাকাব্য।”

আজ থেকে ৪০০ বছর আগে হাওরপাড়ের গান কতটা সমৃদ্ধ ছিলো তারই একটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন গবেষক প্রিন্স রফিক খান। এমনই কিছু গান নিচে তুলে ধরলাম।

বাউল শরৎনাথের গান-

১। মন পাখী তুই আসল জংলী চিনেছি তোরে
তোরে এত করে বুঝাইলাম
রাধা-কৃষ্ণ বল্লে নারে।।

মন তুই হইতে যদি ময়না টিয়া
শান্তি দিতে নাম শুনাইয়া
তুই যে কাকের ছানা
না চিনিয়া পুষিয়াছি যত্ন করে।।

কত আঙুর বাদাম পুস্তের দানা
খাওয়াইলাম ইংরাজী খানা
একদিন গুড মর্নিং তুই আর বললে না
ভালবাসা আব্দার কর।।

স্বভাব দোষ না যায় তাতে
তার পরিচয় প্রমাণেতে
দুগ্বে অংগার শত ধৌতে
স্বমূর্তি ছাড়ে নারে।।

দীন শরৎ বলে মন কাগটি
এখন তুমি হওয়া খাঁটি
কা” ছেড়ে বল কৃষ্ণ নামটি
‘র’ কারে ডাক আকার ধরে।।

এ গানগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী উপজেলা মহরকোনা গ্রামের বাউলশিল্পী জাকির দেওয়ানের কাছ থেকে।

অষ্টগ্রামের আলাই মে-এর গান-

১। আমার বন্ধু রঙ্গিন সংগি লাউরে বাইন্দাছে টংগিরে
তবু শরীর না জুড়াইবা তাতেরে
ভমরা নিশিতে আইয়ো ফুল বনে
নিশিতে আইয়ো ফুল বনে ভমরা।।
আলাই মিয়া সাইবের বাণী ফুল তুলগা নানান জাতি।।
কতই রঙ্গের ফুটছে ফুলের কলিরে ভমরা নিশিতে আইয়ো ফুলবনে।
নয় দরজা কইরা বন্ধ লইও ফুলের গন্ধ
পদ্মা যেন ভাসে গংগার জলে রে ভমরা।।ঐ

মর্ম:- গলা থেকে মাথা পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এবং বুক থেকে নিচ পর্যন্ত ফেরেস্তারা তৈরি করেছেন। মানবদেহে নয়টি ছিদ্র আছে। এর মধ্যে সাতটি সৃষ্টিকর্তার তৈরি, বাকি দুইটি ফেরেস্তাদের তৈরি।।

২। বন্ধুয়া কইরা পাগলিনী গো সজনি।।
আমার বাড়ির উপর দিয়া বন্দে যাইরে
মোহন বাঁশি বাজাইয়া সই সই গো।।
ডাক দিলেনা কয়না কথা নোয়াইয়া যায়রে মাথা
সদায় বন্দে আইসা যাওয়া করে-লো সজনি।।
ঐ অভাগীনির ভাংগা ঘরে প্রাণ বন্ধুয়া বিরাজ করে সই সইহ গো।।
নীলুয়া বাতাসে বন্দে মুচকি মুচকি আসলো সজনি।। ঐ
আইন্দারও হুসকুনির মাইঝে এনা ফেনা জট লাইগাছে সই সই গো।।
সেই ফেনা তুলিয়া বরণ দিও সজনি।। ঐ

৩। কলসী লইয়া নামলো জলে ঢেউ খেলা খেলি
কলসী লইয়া নামলো জলে।
বস্ত্র নিলো চিক্কণ কালা কলসী নিলো স্রোতে
ও প্রাণ সজনি আর জলে ঢেউ দিওনা।
বস্ত্র তয়া কলসী লয়া নামলো গংগার জলে।। ঐ
কলসী বুরাইয়া রাধে তইলো কদম তলে।।
কদম ফুল ঝরিয়া পড়ে কলসীর মাঝারে গো প্রাণ সজনী।
ঐ জলে ঢেউ দিওনা ঢেউ দিওনা।। ঐ

এ গানগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী পুরাতন বাজার আসাব উদ্দিন পাগলার কাছ থেকে।

নিকলীর চন্দ্রনাথ গোসাঁইয়ের গান-

লাইগাছে আনন্দের বাজার নিরানন্দ নাইরে
আর প্রেমবাজারে বিকিকিনি করবে আয়।।
অষ্টগেরাম মালের অফিস মাসে মাসে আসেরে
জিনিস ওজন কইরা সে মাল যতনে ওঠাও।
জাজেতে মাল আসেনা নাও গাড়ি কিছুই লাগেনা।।
দমের সনে আনাগোনা দমের সনে আনাগোনা
ভেবে দুই কুল ভাইসা যায়।। ঐ
লাইগাছে আনন্দের বাজার লাইগাছে আনন্দের বাজার
নিরানন্দ নাইরে আর।।ঐ
ভেবে ইশান বলে গারোয়ালী হইলো পাড়
এ জিনিস কিনে চাইর রং এক হইলো হরির সনে যুগ মিলায়ে।।
তবে দেওয়া শুদ্ধ হবে ধরগা কিশোরীর পায়।। ঐ

মো: আবদুস ছাত্তার (রিটন চিশতী)-এর সাথে লেখক শেখ মোবারক হোসাইন সাদী

এ গানটি সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী পূর্বগ্রামের মো: আবদুস ছাত্তার রিটন চিশতীর কাছ থেকে। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে আরো কিছু গান।

বন্ধুরে দিবানিশি ঝুরিয়া মরি তুই বন্ধু লাগিয়া
রাইতে দিনে চাইয়া থাকি পন্থ নিরখিয়া।
বন্ধুরে সহিতে না পারি দুঃখ সদায় জ্বলে হিয়া
স্বপনে দেখি বন্ধু না পাইনু জাগিয়া।
বন্ধুরে সৈয়দ শাহানুরে কয় উদাসিনী হইয়া
কি দোষে পরাণের বন্ধু না চাওরে ফিরিয়া।

১. ও নবীজী তোমার দয়ার অতুল গুণেতে পাপীরে তরাইয়া নিবানি
আমার মত এমন পাপী এ জগতে আর আছেনি।।
ও নবীজী হাশরের হুলস্থুলে নফ্সী নফ্সী সবে বলে
উম্মতি উম্মতি বলি ফুকারিবায় নি।
শফিউল উম্মতি হইয়া আমারে বাচাইবায়নি।।
ও নবীজী ফুলসেরাতের পুলে পার, কেশের মত ক্ষুরের ধার
অন্ধকার ঘোর রজনী, দয়া করি হাতে ধরি পার করি নিবায় নি।
আমায় দয়া করি সঙ্গে নিবায় নি।
ইয়াসিন তোমার ভক্ত দাসেরে চরণে রাখিবায় নি।।
পাপীরে তরাইয়া নিবায় নি।

২. আরো ও বরণী গাঙ্গের নাইয়া
সোনা বন্ধে নাও বাইয়া যায় রঙ্গিলা গান গাইয়া।।
ময়ূর পংখী রঙ্গিলা নাও ছুঁইয়া আবের ছাউনি
হাত দুলাইয়া রঙ্গে নাচ বরণী গাঙ্গের পানি।।
আমি গান শুনিয়া প্রাণ বিকাইলামরে ওরে জল ভরিতে আইয়া
সোনা বন্ধে নাও বাইয়া যায় রঙ্গিলা গাণ গাইয়া।।
কুক্ষণে জল ভরিতে আইয়া কলঙ্ক হইল জাতে
হীরার কলসী ভাসাইয়া নিল বরণী গাঙ্গের স্রোতে গো-।।
আমার ঘরে যাইতে মন চলে নারে ওরে প্রাণ বন্ধুরে রাখিয়া
সোনা বন্দে নাও বাইয়া যায় রঙ্গিলা গান গাইয়া।।

৩. আমরার বাড়ির বাইজানে তোমরার বাড়ির বু-জানে
লাগাইছে হিরিতি- আইতে যাইতে ডাইক্যা আমায় দেয় একখান ছিডি
বাইজান আমার ডাইক্যা কয় বুজান আমায় ডাইক্যা কয় ছিডি
ঠিকমতে পৌছাইবি, আনা গোনা ঠিক রাখিলে দিব একখান ঘড়ি।।
কপাল আমার হইল মন্দ কিছুই বুঝলাম না
দেয়া-নেয়া করলাম ছিডি কিছুই হাইলাম না।
বাইজান বুজান হাঁকি দিয়া গেল আমায় ছাড়ি।।

এ গানগুলি সংগ্রহ করা হয়েছে নেত্রকোনার মরমি কবি ও বাউল গোলাম মৌলার কাছ থেকে।

আসতো যদি প্রাণের বন্ধু দুঃখ রইতো না।।
আইলো না আইলো না, আমারে দেখিতে বন্ধু আইলো না।
আষাঢ় গেল শ্রাবণ গেল, আইলোরে ফাগুন।
ধুকিয়া ধকিয়া জ্বলে তুই বন্ধুর আগুন।

একটা মোবাইলে গানটি শুনতে পাই। গানটি শুনে আমার ভালো লাগল; খুঁজতে শুরু করলাম গানটি কার। জানতে পারলাম কটিয়াদি উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের বাউল তাহের সরকারের গাওয়া গান। কথা হয় তাহের বাউলের সাথে। তিনি জানান, এটা বারমাসী গান। আগ্রহ জাগলো এ গান সংগ্রহ করার জন্য। সাংবাদিক খাইরুল মোমেন স্বপনের মাধ্যমে জানতে পারলাম এমন বারমাসী কিছু গান আছে আমার পীরভাই বাউলশিল্পী জাকির দেওয়ানের কাছে। কথা বলতেই রাজি হন জাকির দেওয়ান। তার পাণ্ডুলিপি আমাকে দেন এবং সেই পাণ্ডুলিপি থেকে বারমাসী গানসহ আরো কিছু দুর্লভ গান আমার ব্যক্তিগত পাণ্ডুলিপিতে সংগ্রহ করি।

বারমাসী গান কি? এবং তার প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করব ১৭তম পর্বে। নিচে সংগৃহীত গানটি দেওয়া হলো।

বন্দী ঘরে থাকি কন্যা হায়রে, হইয়া উদাসী
কুমারের বিরহভাবে গায় বারমাসী।
প্রথমে ফাল্গুন মাস বসন্তের-অ রীত
দখিন পবন বেগে দূরে গেল শীত।
নবীন পবনে শোভা ধরে তরু দল
নূতন পল্লবে বৃক্ষ করে ঝলমল।
ফুটিল বিবিধ ফুল পুষ্প উপবন
তরুর শোভায় আহা জুড়ায় নয়ন।
কুকিল শাখায় করে সুমধুর গান
পুষ্পে বিরাজিত অলি করে মধুপান।
অলির গুনগুন রবে দগধে অন্তর
বিরহিনীর দুঃখ দিয়া গুঞ্জরে ভ্রমর।
নূতন পবনে ফল ফুটে উপবনে
বসন্ত সমীরে মধু ভুঞ্জে অলিগনে।
নয়া জামাই নয়া কানাই প্রতি ঘরে ঘর
নূতন যুবতী পতি কৌতুক থরে থর।
আহারে থাকিলে নাথ কেন এত দুখ
প্রিয়ের কৌতুকে দূরে যাইত অসুখ।
আমি একাকিনী থাকি হয়ে অভাগিনী
প্রিয় বিনা ঝুরিয়ে মরি দিবস যামিনী।
গেল রে বসন্তকাল কান্ত না আসিল
ফুলবালা কত জ্বালা আর সহিবে বল।

আসিল চৈত্র মাস বসন্তের শেষ
ফুলের সুবাসে মোহ হইলেক দেশ।
মিষ্ট মিষ্ট সমীরণে জুড়ায় শরীর
ভুবন উজ্জ্বল হইল শোভায় শশীর।
ধরিল বৃক্ষেতে ফল বিবিধ বরণ
লতায় জুড়িয়া বৃক্ষ হইয়াছে শোভন।
যদ্যপি আসিত নাথ সদৃশ্য লতার
জড়িয়া ধরিয়া শোভা করিতাম বাহার।
একে একে করি শেষ হয় কাল ক্ষয়
অভাগিনী দুঃখ শেষ কেন নাহি হয়।
দারুণ চৈত্রল ভানু দহে কলেবর
যৌবন জ্বালায় তনু দহে নিরন্তর।
সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলে সন্তাপ না যায়
ভক্ষিব গরল বিষ হায় হায়।
আইল বৈশাখ সর্ব পুষ্পময়
বহিরে গ্রীষ্মের বাও তাপিল হৃদয়।
ক্রমে ক্রমে রবিতাপ হইছ প্রবল
সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিলে না লাগে শীতল।
আহারে অভাগী চিত্ত জ্বলিছে দ্বিগুণে
রবির উত্তাপে আর প্রিয়ের অদর্শনে।
বন্ধু যদি রইত তাপ করিত শীতল
আহারে না সহে আর বিরহ বিকল।
ফুটে ফুল কুল পাইয়া নবীন জল
বিরহিনীর তনু ভঙ্গ জীবন বিফল।
সহিতে বিরহজ্বালা নাহি পারি আর
না পুরিল আশা মর সরণ হইল সার।

গ্রীষ্মের বটয়ে শেষ জৈষ্ঠল সুলক্ষণ
আম্র দুগ্বো গৃহ গৃহে সুধার সিঞ্চন।
আমোদ আহলাদে যত কুল রসবতী
বঞ্চেন প্রিয়ের সঙ্গে মনোরঙ্গে অনি।
একে আম্র রস আর বন্ধুয়ারি মিলন
মধুর কৌতুক করে রসিক রতন।
আমি অভাগিনী হায় প্রিয় বিয়োগিনী
শতেক সুখেতে আমি সহস্র দুঃখিনী।
সুমধুর ফল আম দুগ্ধ ক্ষীর ননী
আমোদেতে প্রিয় সঙ্গে ভুঙ্গে রসধনী।
বিরহিনী দুঃখী আমি থাকি একাসর
না আসিল নাথ আর কারে করি ভর।
আসিল আষাঢ় মাস বরিষার রীত
গগন গর্জনে অঙ্গ অধিক কম্পিক।
রসবতী গন সুখে কোলে বন্ধুয়ার
মেঘের গর্জনে তাদের ভয় নাহি আর।
আমি অভাগিনী একা বঞ্চি খালি বাসে
না আসে না আসে নিদ্রা গর্জন তরাসে।
যদ্যপি থাকিত বন্ধু ধরিয়া গলায়
মিশিয়া সুখের নিদ্রা যাইতাম হায়।
বর্ষার বিক্রমে আহা দহে কলেবর
বাইছালি খেলায় সবে প্রতি ঘরে ঘর।
চাতক আহলাদে উড়ে মোর আশা না পুরিল
কেন এ দুখিনী কান্ত এবে না আসিল।
বর্ষার দ্বিতীয় মাস বটয়ে শ্রাবণ
জল কড়কে জল করে বরিষণ।
তাহাতে দারুণ ভয় চমকে চপলা
ভয়েতে কম্পিত চিত্ত বিরহী অবলা।
একে খালি ঘর আর নিশার আধার
ভয়েতে বিদরে প্রাণ এ নব বালার।
যদ্যপি থাকিত নাথ ধরিত জড়িয়া
সান্তাইত অবলারে মুখে মুখ দিয়া।
এইত শ্রাবণে আহা বর্ষে অবিরল
জোয়ারের ধাপে তনু করে টলমল।
প্রিয় পর দেশে আমি একা থাকি ঘরে
শুইয়া ছটফট করি নিদ্রা নাহি ধরে।
যদি সে রইতো বন্ধু মুখে দিত মুখ
প্রিয়ের পরশে দূরে যাইত অসুখ।
আসিল শরৎকাল ভাদ্রল প্রবীণ
রবি শশীর মুখ দেখা ঘটেনা কঠিন।
জলদে গগন ঢাকিয়া বর্ষে অবিরল
জোয়ারের জলে আবার ভূমি টলমল।
নিচেতে জোয়ারের জল উপরে বর্ষার
জলের তরঙ্গের অঙ্গ কাঁপে অবলার।
যদি সে রইত বন্ধু কোলেতে লইয়া
সান্তাইত অবলারে বুকে হস্ত দিয়া।
যদি কান্ত রইত মোর হেরি তার মুখ
লতার মলনের মত বিদুরিত দুখ।
শরতের শেষ মাস আশ্বিন নিকর
রবির উত্তাপ কিছু হয় খরতর।
জলেতে কুমুদ কাহ্লা ফুটেছে ললিত
কৃষিতে ধরিছে শোভা মোহন শোভিত।
হংস দল জল মধ্যে খেলিয়া বেড়ায়
সুশীতল সমীরনে শরীর জুড়ায়।
এমন সময়ে মোর প্রিয় ঘরে নাই।
প্রেমের অনলে অঙ্গ জ্বলিয়া হইল ছাই।
ফুটিছে নূতন কুমুদ জ্বলে বিরাজময়
হেরিয়া তাহার শোভা দগ্ধে হৃদয়।
বন্ধু যদি রইত ঘরে কুমুদ যেমন
শোভিত হয়ত পুরী এই লয় মন।

আসিল কার্তিক মাস হেমন্তের রীত
উত্তরাল বায়ুবেগে লাগিতেছে শীত।
অল্পে অল্পে বাড়ে শীত না সহে হিয়ায়
প্রিয় বিনা এ জ্বালায় বুক ফেটে যায়।
লোক কয় এই মাসে নহে তাপ শীত
তবু কেন এই অভাগীর লাগে এত শীত।
হেরিয়া কার্তিক শোভা বুক ফেটে যায়
চাহিতেছি পথপান আশায় আশায়।
আমোদ আহ্লাদে যত রসবতীণ
প্রিয়সহ বিরাজ করে আপন ভবন।
যদ্যপি আসিত নাথ এমন সময়ে
শীত হইতে বাঁচিতাম মিলিয়া হৃদয়ে।
আগ্রণ মাসেতে আহা শীতের তাড়নে
পশু-পক্ষী বঞ্চে সুখে নিজ প্রিয় সনে।
মুখে মুখ দিয়া দূর করে জাড়া শীত
আমি অভাগিনী আহা তাহাতে বঞ্চিত।
যদি কান্ত রইত ঘরে মিলিত বুকেতে
বিরহিনীর তনু অঙ্গ না করিত শীতে।
একেত অবলা তাতে বিরহের জ্বালা
ভাবিতে ভাবিতে হায় শরীর কইলাম কালা।
নূতন নবীন অন্ন প্রতি ঘরে ঘর
যুবক যুবতী খায় প্রফুল্ল অন্তর।
তাতে দুগ্ধ ক্ষীর ননী কত শোভা পায়
রসবতীগণ সুখে প্রিয় সনে খায়।
আমি অভাগিনী আহা তাহাতে বঞ্চিত
না আসিল নাথ এবে কি করা উচিত।
আসিল দারুণ শীত পৌষের যে মাসে
পশুপাখি বাসা লয় শীতের তরাসে।
থর থর কাঁপে অঙ্গ বিষম জাড়ায়
বিষধর সর্প শীতে প্রবেশে গাড়ায়।
যায় ঘরে আছে বন্ধু প্রিয় মনোহরা
বুকে বুকে মিশি শীত দূর করে তারা।
সহিতে না পারি শীত আমি যে অভাগী
কাটাবী খাইয়া হব বন্ধু বধভাগী।
শীতের ধাপে কাঁপে অঙ্গ কেবা নিবারিবে
এমন দুঃখের জ্বালা কেবা রে সহিবে।
জাড়ার তাড়ায় মরি না মানে কম্বল
প্রিয় বিনা এ অভাগীর কি আছে সম্বল।
মুখে মুখ দিয়া বন্ধু নিবারিত দুখ
ধরিত এমন শোভা যেন শারী শুক।
সতত তাপিনী আহা দহে কলেবর
একেলা পড়িয়া থাকি কে লইত খবর।
এ সুখ যামিনী বঞ্চি যেন চাতকিনী
মাথায় মারিয়া হাত থাকি একাকিনী।
হইল বছর প্রায় আমি একাসর
প্রিয় বিনা আহা আহা দগধে অন্তর।
মাঘের শীতেতে হায় কাঁপে বসুমতী
শীতে থর থরি তনু ঠক ঠক গতি।
ঘরে যদি রইত কান্ত শীতে দিত তাড়া
মরি হায় হায় আর নাহি সহে জাড়া।
দারুণ মাঘের শীতে বাঘও কম্পিত
রাজাই কম্বলে আর নাহি মানে শীত।
নাথের কোলেতে শোভে যেসব যুবতী
রাজাই কম্বল হইতে বেশি তার পতি।
পতির বুকেতে মিশি করিলে শয়ন
আর কি শীতের তাতে হয় আগমন।
আহা আহা অভাগী একা এ ঘোর জাড়ায়
প্রিয় বিনা মরি আমি কি করি উপায়।

সহযোগিতায় :

১। খাইরুল মোমেন স্বপন।
২। কারার বদরুল মোমেন হিমেল।
৩। মোঃ জুনাঈদ হাসান রাজু।
৪। ডি.আই. জনি।

সংগ্রহ সূত্র :

১। মরমী কবি ও বাউলশিল্পী : গোলাম মৌলা (নেত্রকোনা)
২। বাউলশিল্পী : জাকির দেওয়ান (নিকলী)
৩। আসাব উদ্দীন পাগল (নিকলী)
৪। মো: আবদুস ছাত্তার রিটন চিশতী (নিকলী)

তথ্যসূত্র :

১। লোকসংগীত : সম্পাদক মুহাম্মদ নূরুল হুদা, মৈয়মনসিং অঞ্চল-কিশোরগঞ্জ জেলার লোকসংগীত-প্রিন্স রফিক খাঁন। (৬.১)২১০ পৃষ্ঠা। বাংলাদেশ এসিয়াটিক সোসাইটি।
২। বাংলাদেশের লোকজ সংগীত- কেন্দুয়া অঞ্চল, সম্পাদনা- শামসুজ্জামান খাঁন। বাংলা একাডেমী।
৩। জালালাবাদের কথা- দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। বাংলা একাডেমী।
৪। বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি, গ্রন্থমালা, হবিগঞ্জ।
৫। বারমাসী গান- নন্দ লাল শর্মা।

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!