হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনাকালে গত পর্বে বলেছিলাম “আইড়” নিয়ে। কিছুটা ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। তার পাশাপাশি চারণকবি ও কবিতার কথা ইঙ্গিত দিয়েছি। আজ একটু বাড়িয়ে বলতে চাই। হাওরপাড়ে- স্বশিক্ষিত হাওরপাড়ের এ সফল চারণকবিরা এলাকার কিছু প্রধান প্রধান কাহিনীকে কেন্দ্র করে বা এলাকার ঘটে যাওয়া বাস্তব কোনো কাহিনী নিয়ে গীতিকবিতা রচনা করতেন। এ ধরনের কবিতা কবি নিজেই কাগজের চার ভাঁজের ৮ পৃষ্ঠায় চাপিয়ে হাটে, মাঠে, ঘাটে এমনকি রেলগাড়িতে ছন্দে-ছন্দে বা সুরে-সুরে পাঠ করতেন এবং তা বিক্রি করতেন। এ ধরনের কবিতার মূল উপজীব্য বিষয় হতো প্রেম, পরকিয়া। এমন একটি চারণকবিতা আমার কাছে ছিল; নাম “লাংগের হাতে স্বামি খুন” কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি।

এখন যখন গবেষণা করছি, তখন আমাকে খুব পীড়া দেয়। আমার কানে এখনো বাজে কবির সেই সুরেলা কণ্ঠ। আমি রেলগাড়িতে দেখেছি মানুষ এগুলো মন্ত্রের মতো শুনতেন কেউ কেউ কিনে নিতেন।

খোকন বয়াতীর সঙ্গে আলাপচারিতায় লেখক

বাজিতপুর পৌরসভার একজন সাবেক চেয়ারম্যানের প্রেমকাহিনী নিয়েও এ ধরনের গীতকবিতা কিশোরগঞ্জে রচিত ও বিক্রিত হওয়ার ঘটনা রয়েছে।(১) নব্বই দশকে চাঞ্চল্যকর শারমিন রিমা হত্যা এবং হত্যাকারী রিমার স্বামী মনিরের ফাঁসির কাহিনী নিয়ে কিশোরগঞ্জে রচিত হয়েছে এ ধরনের গীত।(১) সদর উপজেলার বারপাড়া গ্রামের চারণকবি জামাল উদ্দিন এ ধরনের গীতিকবিতার একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন।(১)

খোকন বয়াতী এবং মামুন আহমেদের (ঠাকুরগাঁও) সঙ্গে আলাপচারিতায় লেখক

কিন্তু বর্তমান সময়ে এমন কবি ও কবিতার দেখা মেলা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি এ চারণকবি ও কবিতার সন্ধান করছিলাম বহুদিন যাবৎ।

ওগো জগৎপতি ওমিনতি করি তব পায়,
ওকুলে ও দিয়াছি পাড়ি কূল কিনারা নাই-
একি ভাংগা তরী।

একি ভাংগা তরী দিছি পাড়ি প্রভুর নাম লইয়া,
ঐকুলে ডুবাইওনা, নিও পার করিয়া,
ও মাবুদ মৌলা।

ও মাবুদ মৌলা তোমার খেলা বুঝা বড় দায়,
তুমি কাউকে ভাসাও সাগরেতে কাউকে নাও ডাঙ্গায়-
তোমার হুকুমেতে।

তোমার হুকুমেতে এই জগতে কত কিছু গটে,
তোমারি নাম লইয়া মৌলা রহিলাম পার ঘাটেতে-
নিও পার করিয়া।

নিও পার করিয়া দয়া দিয়া তাকিয়ে সদায়,
মুসলমানের আল্লাহ তুমি হিন্দুরও গুসাই
তুমি দয়াময়।

তুমি দয়াময় সদাসয় তুমি করলা দান
এই মিনতি লিখতে গিয়ে সখি।

লিখতে গিয়ে সখি কবি ফজলু মিয়া যায়
লিখিয়া পিরিতেরও সেল,
পিরিত কইরা কাটিয়া আইলো পিরিতের ও জেল,
জিলা রংপুরেতে।

জিলা রংপুরেতে, বসত করে মিয়া পাড়া গ্রাম,
সেই গ্রামেতে বসত করে আব্দুল মজিদ নাম,
তাহার দুইটি ছেলে।

তাহার দুইটি ছেলে তাহার ছেলে আছে
কোনো অভাব নাই, মেয়ে বুদ্ধি মতি।
মেয়ে বুদ্বিমতি দনয়তি রূপের ও বাহার
আদর করে নাম ডাকিত আছিয়া বেগম,
দিল স্কুলেতে।

দিল স্কুলেতে আনন্দেতে লিখাপড়া করে
কিন্তু কিছুদিনও পরে তাহার পিতা গেল মরে
আছে সেই গ্রামেতে।

আছে সেই গ্রামেতে, পাই জানিতে রেজিম আলী নাম
তারার ছেলে রজব মিয়া নিজে জানলাম,
পড়ে স্কুলেতে।

পড়ে স্কুলেতে যায় বলিয়া সবাই
আদর করে আছিয়া আর রজব মিয়া
এক স্কুলে পড়ে তারা দুইও জনে।

তারা দুইও জনে, একই সাথে স্কুলেতে যায়
ছোট ছোট ভালবাসা দুই জনাই এসব ছেরে দিয়া।

এসব ছেড়ে দিয়া লিখিয়া শুনেন পাঠকগণ
ক্লাস টেনেতে পড়ে বিবি আছিয়া যখন
যৌবনে মারিল উঁকি বুকেতে তাহার,
তাহার রূপের কথা।

তার রূপের কথা, ভদ্রশ্রোতা কবিতা প্রকাশি
আকাশের চন্দ্র যেমন দরশ পরল কষি।

শাড়ি বেনা রশি সেই যে কষি
ব্লাউজ পরেছে কালো, মাথায় সিঁথা।

মাথায় সিঁথা ঠোঁটে আলতা, কালো চুলের বেনি
স্কুলেতে যায় গো যেমন পরিস্তানের রানী,
মুখে মুচকি হাসি।

মুখে মুচকি হাসি দিবা নিশি সাফল্যে বেড়ায় বেড়ায় জানিনা
সেই পরশ মনি কোন রশিকে পাই, হায়রে কাল যৌবনি।

হাইরে কাল যৌবনি, টেকিয়াছে বিবি আছিয়ারঅ
লেখা পরা রইনা মনে পরান কেমন বিবি আছিয়ারঅ।

বিবি আছিয়ায় বলছে হায় কী করে এখন, বিপলেতে যাইবে
বুঝি আমার এ জিবন যদি থাকত পিতা।

যদি থাকত পিতা দিতো বিয়া আদর ও করিয়া
মনের আশা পুরাইতাম দাম্পতিরে নিয়া
সখি এই ভাবে মনে।

সখি এই ভাবে মনে, স্বামি বিনে নাহি মোরে গতি,
রজকে বানাইব আমার জিবনের সাথি
একদিন রজব মিয়া।

একদিন রজব মিয়া, আছিয়া স্কুলেতে যায়
রাস্তাতে বসিল দুইজন গাছেরও তলায়, তখন আছিয়ায়।

তখন আছিয়ায় দেখে চাইয়া সেই গাছেরও ডালে,
দুটো পাখি বসে আছে কেমনে জোড়া মিলে,
মিলে করছে কোলাকোলি।

করছে কোলাকোলি পাখি দুটি মুখে ঠোঁট লাগাইয়া
রজবকে দেখাইল, তখন হাতে দরিয়া রজব পাখি দেখে।

রজব পাখি দেখে, আছিয়াকে বলতে চে যাইয়া
তারা স্বামি স্ত্রী।

তারা স্বামি স্ত্রী, ডালে বসে খেলছে প্রেমের খেলা
কত দেশে যাইবো তারা আকাশেতে উড়িয়া, শুনে আছিয়ায়।

শুনে আছিয়ায়, বলে যায় তারে গলে ধরে,
পাখির মতো ভালবাসি আমি যে তোমারে, তুমি স্বামি।

তুমি আমার স্বামী, হইলাম আমি চরণের দাসি,
জিবনও যৌবনও দিলাম তুমি আমার শষি, শুনে কয় রজবে।

শুনে কয় রজবে, যাইগো কইয়া একি শুনতে পাই,
এ দেশেরই বড় গুণ্ডা তোমার দুটো ভাই, যদি জানতে পারে।

যদি জানতে পারে, মারবে ধরে পরানও যাবে মাই।
একা বাপের ছেলে গো আমি লাঠির নাইগো জোর, শুনে আছিয়ায়।

শুনে আছিয়ায়, বলে যায় চিন্তা কর নাই,
আমি থাকতে কে নিবে তোমারই জিবন, তুমি যদি পার।

তুমি যদি পার, উকিল ধর অতি তারাতারি
আমারও ভাইদের কাছেতে যাও বিয়ের প্রস্তাব করি, শুনে কয় রজবে।

শুনে কয় রজবে, কিবা হবে দুই জনেরও বিয়া
আছিয়া কয় দেশ ছাড়িয়া যাব তোমায় নিয়া, পরে রজব মিয়া।

পরে রজব মিয়া, গত গিয়া ঘটকও পাঠাইল,
আছিয়ারও ভাই সকলে শুনে গোসসা হল, বলে উকিলেরে।

বলে উকিলেরে, সিক মারে অপমান করিয়া
তার মত ছেলের কাছে নাহি দিব বিয়া…

পরে আছিয়ারে স্কুলেতে নাহি দিল আর
লেখাপড়া বন্ধ করল তখন তাহার, কান্দে আছিয়ায়।

কান্দে আছিয়ায়, বাতা পারনির লেতে,
রজবকে না পাইলে আমি গলে দিব ফাঁসি, কবি আজিজ মিয়া।

কবি আজিজ মিয়া, যায় শিখিয়া শুনেন পাঠকগণ
এই ভাবেতে কিছু দিন গত হয়, যখন একটি রাত্রি কালো।

একটি রাত্রি কালো, আসে পেলে আছিয়া সুন্দরী
রজব কে বলে গো, তখন এসো তারাতারি।

এসো তারাতারি, সয়না দেরি সময় বয়া যায়
তোমায় নিয়া বিককা করে খাব এই দুনিয়ায়, পরে রজব মিয়া।

পরে রজব মিয়া, পাগল হয়ে কিভা করে গেল
আছিয়ারে নিয়া পরে ঘরের বাহির হল, গেল চন্দন পাড়া।

গেল চন্দন পাড়া, নাহি জানি তাহার খালার বাড়ি
গোপনেতে রইলো এক সপ্তাহ ধরি, রাত্রি পোহাইল।

রাত্রি পোহাইল, জানতে পারলো নিজের ভাইয়ে
আছিয়াদি চলে গেল রজবের সনে, এই ভাই সকলে।

এই ভাই সকলে, উঠল জ্বলে আগুনেরই মতো
থানাতে এজাহার করে গোপনে তখন, পরে বাড়ি বাড়ায়।

পরে বাড়ি বাড়ায়, চলে যায় আসারই দরিতে
জামানতের কেহ দিশাহারা রজবেরই নামে, ছারি এসব কথা।

ছারি এসব কথা, ভদ্র স্রোতা শুনেন দিয়া মন
রজব মিয়াকে কে বা করে দরে যাই বর্নন
আছিয়াতে নিয়া পরে কাজির বাসায় গেল,
মেয়ের কথায় কাজি সাহেব বিবাহ করাইলো, পরে এইবা দেখে।

পরে এইবা দেখে, গোপনেতে কিছুই বায়না গেল
কাজিরও হাতে রজব দরা পইরা গেল, করে গাড়ি ভাড়ায়।

পরে গাড়ি ভাড়ায়, চালান দিল রজবকে ধরিয়া
হাজতখানায় বা কে গো তারে আদরও করিয়া, পরে আছিয়ায়।

পরে আছিয়ায়, উকিল ধরে দরখাস্ত করিল
রজবেরই জামিনেতে বাড়ি পিরে আইল, কত চেষ্টা করে।

কত চেষ্টা করে, ভাই সকলে বিবি আছিয়ায়
আছিয়াকে বাধা করতে নাহি পারিল, চলে মোকদ্দমা।

চলে মোকদ্দমা, কাতির জমায় মিথ্যা উকিলেতে
মিথ্যা মামলা লাগাই দিয়া বাড়ি চলে যায়, মামলার তারিখ আইলো।

মামলার তারিখ আইলো, বাদীগণও সাক্ষীগণও নিয়া
সাক্ষীগণে মিথ্যা সাক্ষী দিল চাকান্দি লইয়া, করল চালাকি।

করল চালাকি, দিল কাজি আছিয়ারও বিয়া
তিন হাজারো টাকা দিল প্রেমের সবই সকল, উকিল ঘুষ কাইয়া।

উকিল ঘুষ কাইয়া, যায় চলিয়া বাদিরও পক্ষেতে
মামলা কানি নষ্ট হল উকিলের দোষে, হাকিম সাক্ষী লইয়া।

হাকিম সাক্ষী লইয়া, আইনে হইলো রজব মিয়ার ফল
ডাকাতির মামলায় দিল তাহারে ১২ বছরের জেল, শুনে আছিয়ায়।

শুনে আছিয়ায়, হায়রে হায় কী কারদার মারিল
হাকিমেরও সামনে ভাই তুলিয়া ধরিল, হইলো জবান নষ্ট।

হইলো জবান নষ্ট, কপাল মন্দ বিবি আছিয়ার
স্বামী চ্যুতি হইল হায়রে মরনেরও আকার, হাকিম নিজে এসে।

হাকিম নিজে এসে, আছিয়ারে তুলিল টানিয়া
অতি যতন করিল নিজের বাসায় নিয়া, পরে চেতন হইলো।

পরে চেতন হইলো, ভাল হইলো আছিয়া
যখন স্বামী স্বামী বইলা বিবি জুরিল কান্দন, হাকিম তাহার পরে।…

নিকলী, মিঠামইন, ইটনা, অষ্টগ্রাম, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, বানিয়াচং, আজমিরিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও টাংগুয়ার হাওরে ঘুরে চিন্তার সীমাবদ্ধতায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি হাওরের জীবন-যাপন ও জীবিকা। খুঁজে বেরিয়েছি বাঙালির হাজার বছরের নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি।

তার এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে হাওরপাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প, আনন্দ-বেদনা ও জীবন-যাপনের বর্ণিল উৎসব আয়োজন। বাউল গান, সারিগান, দেহতত্ত্ব, শরিয়তি, মারফতি, মুর্শিদি, মরমী, লোকগীতি, ভাটিয়ালী, পালাগান, ঘেটু গানসহ বিভিন্নধর্মী গানের বিশাল সম্ভার এই হাওরাঞ্চলে। ভাষার মধ্যেও যে বৈচিত্র্য আছে তার স্বাদও আলাদা।

জাকির দেওয়ানের সঙ্গে লেখক

আজ ষোড়শ শতাব্দীতে সৃষ্টি হওয়া কিছু গান নিয়ে আলোচনা করব; যা আজও লোকমুখে শোনা যায়। এমনই একজন মরমী কবি ফকির শীতালং শাহ গান সংগ্রহ করেছি।

সিলেট জেলার পূর্ব দিকে চারঘাট পরগনার বারকুরী গ্রামে ১২৯৬ বাংলা সনের ১৭ অগ্রহায়ণ শীতালং শাহ ইন্তেকাল করেন।(২) দীর্ঘদিন সাধনার পর তিনি ফকিরী লাভ করেছিলেন।(২) শীতালং শাহ-এর কিছু গান নিচে দেওয়া হলো:

১। বায়ান্ন বাজার তিপ্তান্ন গলি
আদমের অজুদে
কৌশল করিয়া পয়দা
করিছে মাবুদে।
আদম অজুদে শির
আসমান সমান
কলবে আল্লাহ আরশ
দম, সদায় যোগান।
কলবের মাঝে আছে
সোনার সিংহাসন
আজিমুস শানের সদা
এথায় গমাগম
দমে আইসে দমে যায়
অপূর্ব কথন
সব কথার ভেদ পায় সে
যার মুর্শিদ সুজন।
সুজন মুর্শিদের কাছে আছে
বেপারের পুঞ্জি
খলিতে ঘরের তালা
হা হু হয় কুঞ্জি।
শীতালং ফকির কয়
দুনিয়া মহাস্থান
মুশকিল তরাণী হইলো
মউতে ঈমান।

২। সুরাংগে রুবাব বাজে
পরম বর নামাতে,
বরবরতে বরবং বাজে
ববুরজে রহমতে।
শীতালং ফকিরে কয়
বৃক্ষ জপে রব্বানা
প্রেমভাবে বৃক্ষতবা
আশিক দেওয়ানা।

৩। ভাই নাম জপ রে
দমের জিকির
তসবিহ তহমিদ জঁপো
তাহলিল তাকবির।
তসবিহ জঁপিতে হয়
বেশি মোনাসিব
আউয়ালে আখেরে যবে
বুলন্দ নজিব।
তসবিহ তহবিহ যেই
করিবে জিকির
ইসলামের নূর আসি
হইবো হাজির।
তসবিহ তহমিদ জঁপো
হইবে কামিল
আচানক বল্লা তার
না হইবে নাজিল।
তসবিহ জঁপো পাক জানি
মাবুদ আল্লা সাঁই
তাহমিদ ছিফত যত
আল্লা বিনে নাই।
তসবিহ তাহমিদ যত-
জঁপিলে সকল,
বেহেশতে হইবে কত
মুল্লুক দখল
তহলিল জঁপ হে জানি
দিলে অনুক্ষণ
লা-শরিক পাক জাত
প্রভু নিরঞ্জন।
নবীর তরিকে জঁপো
তহলিল জিকির,
দেখিলে গোলাপী রং
মোস্তাফা নবীর।
তহলিল জঁপিলে হয়
আল্লার রহমত,
নূর মনোহর আসি
হইবে কুরবত।
তসবিহ জঁপ হে বড়
জানি নিরঞ্জন,
আল্লার সমান নাই
এ ত্রি-ভুবন।
তকবির জঁপিলে হবে
রূপের কুরবত-
খলক সয়ালে তারে
করিবে ইজ্জত।
হরদমেতে করে যেই
দমের জিকির-
হুজুরী কুরবতে হয়
রৌশন জমির
শীতালং ফকির মাংগে
রাব্বের বিদিত,
প্রেমের সহিতে আমার
না খুলিল চিত।

৪। প্রেম বাজারে প্রেমের ঘরে
মজিয়া হইলাম আপমান
আঁড় নয়নে চাইয়া নিলায় প্রাণ।
শাশুড়ী ননদীর জ্বালা
না যায় সহন
মিষ্টি মধুর বচন,
যেখানে সেখানে যাই
মুখেতে তোমার বাখান।
মনে লয় ছাড়িতাম দেশ
এইতো- জ্বালায়
আমি বোন দেনমশেতে বুঝি,
পারে সেই মাড়মান।
যোগীরূপে ভ্রমণ করি
করি অণ্বেষণ
আমার কৈলায় বিড়ম্বন
কি দোষে পাইয়া মোরে
কৈলায় এত অপমান।
কুল-শীল-জাতি গেল
ইজ্জত বেকার
আশা নাহি বাঁচিবারে
আকুলিনী করিয়া মোরে
মজাইলায় কুলমান।
শীতালং ফকিরে বলে গেল কুলমান
আমার আংখি কর দান
কৃপা করি অধীনেরে
বাতাইয়া দেও সন্ধান

৫। ওবা দয়াল আল্লাজী
ছিরাত সংকত মোরে
তরাই নিরায় নি?
আল্লাজী
করিয়াছি বউত গুনাহ
তোমার বেরাজী,
শয়তানের ধোঁকায় পরি
দায়ে ঠকছি আজি।
আল্লাজী
শয়তানের ফেরেবে রইলাম
দুনিয়ার কামে মজি,
চুলের হকোম পুলাদের ধায়,
কেমনে পারতাম আজি।
আল্লাজী-
দুনিয়া দুনিয়া করিয়া মৈলাম
কুবাই দুনিয়া আজি।
বিপাকে পড়িয়া ডাকি
তরাই লও আজি।
আল্লাজী-
গফুর রহীম তুই
রহিমঅ রহমান,
না অইছে না অইবো কেউ
তোমার সমান।
আল্লাজী, আল্লাজী-
ভবের মায়ায় মজি
কইলাম রং ঢং
বিপাকে ঠেকিয়ে কান্দে
ফকির শীতালং।

৬। মন রে-
বেলা বেল সাঞ্জা হইল
ভুলিয়া রইলায় কারে দেখি
সংগের সংগীরা সবে
দিয়া যায়রে ফাঁকি।
মন রে…
হুঁশ গেল বুদ্ধি রে গেল
চউখের গেল জ্যোতি
কারে লইয়া করবায় তুমি
এই ভবের বসতি
মন রে…
আকল ফুহাম গেল
তনাইর গেল বল
কও দেখি পাগল মনা
আর কিবা সম্বল?
মন রে…
ভবে আইলায় বেপারেতে
লইয়া পরান ধন,
সব খুয়াইলাম ভবের পিছে
তখন কি লইয়া গমন?
মন রে…
হুঁশ বুদ্ধি লাগাইয়া
দুনিয়াদারি কাজে
কি ধন লইয়া বসত করতায়
কয়বরের মাঝে?
মন রে…
স্ত্রী-পুত্র ভাই-বন্ধু
কেউ না যাবে সংগে-
বিপাকে ঠেকিয়া কান্দে
ফকির শীতালংগে।

উপরোক্ত গান এবং তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলীর জাকির দেওয়ানের কাছ থেকে।

 

সহযোগিতায় : মামুন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও), মোঃ জুনাঈদ হাসান রাজু।

সংগ্রহসূত্র : কিচ্ছা পালাকার খোকন বয়াতী (কিশোরগঞ্জ), নিকলীর জাকির দেওয়ান।

তথ্যসূত্র : ১। লোকায়ত কিশোরগঞ্জ, জাহাঙ্গীর আলম জাহান। ২। জালালাবাদের কথা, বাংলা একাডেমি।  

 

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!