হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

বৃষ্টির জন্য লোকাচার
বৃষ্টি ঈশ্বর প্রদত্ত এক তৃষ্ণীয় নিয়ামক। আমাদের দেশে যে বারটি মাস বিরাজমান তার মধ্যে চৈত্র খরতাপ মাস হিসেবে জানা। তখন গরমের প্রচণ্ড তাপ, খাল-বিল চৌচির, গাছপালা, নদী-নালা ও ফসলের মাঠ যেন চেয়ে থাকে আকাশ পানে। এই বুঝি আকাশের বুক ভেদ করে বৃষ্টি নেমে এলো নিচে।

প্রকৃতি যেমন তার তাপ সহ্য করতে না পেরে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে ঠিক মানুষও তার বাইরে নয়। মানুষ বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।

লাউ চোর/ লাউ চুরি/ লাউ ভাঙ্গা
লাউ বাংলাদেশ বা তার বাইরেও যারা বসবাস করেন সবাই জানেন বা চিনেন। তবে অঞ্চলভেদে এর নাম ভিন্নও হতে পারে। কোনো কোনো অঞ্চলে লাউকে কদু বলেও ডাকতে শোনা যায়। তবে লাউ নামটিই বেশি প্রসিদ্ধ।

চৈত্র মাসে যখন খুব বেশি খরা দেখা দিত, তখন গ্রামের রাখাল ছেলেরা রাতের আঁধারে এলাকার সব লাউ চুরি করে তেমাথায় ভাঙ্গত। তার কারণ হিসেবে জানা যায়, চৈত্র মাসে লাউ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি শুষে নেয় এবং মাটিতে রসের অভাব হয়। ফলে মাটিতে ফাটল ধরে। তাই রাতের আঁধারে গ্রামের রাখাল ছেলেরা এলাকার সব লাউ চুরি করে ভেঙ্গে ফেলত। এটা ছিল বৃষ্টির জন্য হাওরপাড়ের রাখাল ছেলেদের লোকাচার।

এমন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। তারা আরো একটি লোকাচার পালন করত, নাম মাঘির ডাক (বাঘায়া)। এ মাঘির ডাক (বাঘায়া) পালন করত মাঘ মাসে। মাঘির ডাক নিয়ে বিস্তারিত থাকবে আমার অপেক্ষমান পর্বে।

সোনা বানুর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহকালীন লেখক

ব্যাঙের বিয়ে
আলোচনা করছিলাম হাওরপাড়ের মেয়েদের বিভিন্ন লোকাচার ও তাদের স্বাধীনতার কথা। বৃষ্টির জন্য অনেক লোকাচারের মধ্যে ব্যাঙের বিয়ে অন্যতম।

হাওরপাড়ের ছেলেমেয়েরা ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বিশেষ লোকাচার পালন করতো। একটি নির্দিষ্ট স্থানে চার কোণায় চারটি কলাগাছ লাগিয়ে রঙিন কাগজ মুড়ে ব্যাঙ বিয়ের ঘর তৈরি করত। সেই ঘরের মধ্যবর্তী স্থানে গর্ত খুঁড়ে গর্তটি পানি দিয়ে পূর্ণ করে সেই গর্তে একটি ব্যাঙ বেঁধে রাখত। তারপর ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি চাল মাগতে বের হতো। বাড়ির বউ-ঝি’রা মাগনকারী ছেলেমেয়েদের শরীরে পানি ছিটিয়ে চাল দিত। সেই চাল এনে ছেলেমেয়েরা আঁখের গুড় মিশিয়ে এক প্রকারের সিন্নি পাকাতো। নিজেরা খেতো, অন্যদেরও খাওয়াতো। বৃষ্টির জন্য এ রকম ব্যাঙ বিয়ের লোকাচার আজ তেমন একটা দেখা যায় না। ব্যাঙের বিয়ে উপলক্ষে চাল মাগার সময় হাওরপাড়ের ছেলেমেয়েরা সমস্বরে গীত পরিবেশন করত। দামপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা সোনা বানুর (১০৫) কাছ থেকে ব্যাঙের বিয়ের যে গীত সংগ্রহ করা হয়েছে তা নিম্নরূপঃ…

“ব্যাঙের ঝিয়ের বিয়া
ষোল্ল মোরগ দিয়া
ও ব্যাঙ ম্যাঘ দ্যাছনা ক্যারে।
আম পাতা দে, জাম পাতা দে দিলাম ছানি
তেও পড়ে ম্যাঘের হানি।
ও ব্যাঙ ম্যাঘ দ্যাছনা ক্যারে

ব্যাঙাজীর বিয়া বিয়া
পাতলা মাতাত দিয়া
আলের ফলা চাঙ্গো থুইলা
গিরস কান্দে বন্দে বইয়া
ও ব্যাঙ ম্যাঘ দ্যাছনা ক্যারে।।

তবে অঞ্চলভেদে ব্যাঙের বিয়ের গীতের কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তেমনি একটি গীত নিম্নে দেওয়া হলোঃ

ব্যাঙা ব্যাঙীর বিয়া বিয়া
পাতলা মাতাত দিয়া
ব্যাঙ গ্যাছে আডো
ব্যাঙি গ্যাছে গোপাডো
এমন মেঘ নাইমা বইছে
মনাটিয়া গাঁয়ের জমিন
লাই গো জমিন দিও ভাসাইয়া
উগার তলে কুনি ব্যাঙ
লড়ে চড়ে দুই টেং
ব্যাঙে ঝাইরে বান্ধে কোপা
ব্যাঙা ব্যাঙীর বিয়া বিয়া।।

সোনা বানুর সাথে লেখক এবং কারার বদরুল মোমেন হিমেল

নিকলী উপজেলার হাওরের মাঝখানে ছিল কেশবপুর নামের একটি গ্রাম। তারা এখন নিকলী থানার সোয়াইজনী নদীর তীরবর্তী “চিটাগাং আফিসে” বসবাস করেন। জানা যায়, ৯/১০ বছর আগে কেশবপুর গ্রামটি বিলুপ্ত হয়। এ বিলুপ্ত গ্রাম কেশবপুরে জনৈক মহিলা গ্রামে গ্রামে মাছের তেল বিক্রি করত এবং মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য এক প্রকার ছড়া পাঠ করত। এ ছড়াটিও বৃষ্টির জন্যই নেচে নেচে পাঠ করত বলে জানান নিকলী নগরের টেলিভিশন নাট্যকার ও নির্মাতা – কিশোর মোশা’র বড় বোন জেসমিন আরা। তার মতে ছড়াটি এমনঃ
আন্ডা আন্ডা কুসুম আন্ডা
ভাতদে খাই, সানুন দে খাই
আমডা আন্ডা মারতাম যাই,

একটা আন্ডা ফাইলামরে
চালো গুইঞ্জা দিলামরে

চাল কুমারী চাল কুমারী
বেড়াত দরছে লাও
এক বেডা খাইয়া যা
সাত ফাইলা জাও
সাত ফাইলা জাও খাইয়া
কমর অইছে মুডা

কমর বালি কোমর বালি
কি কর বসিয়া
তোমার ফুতে মাইর খা দরবারে বসিয়া
কালা কচু দলা কচু কোন কচুর জাত
বুইরা বুন্নি শনিবাইরা রাইত

আন্তা হুতু মারে হুতু, ধরে হুতু চরে হুতু…. (আওলা নাচে পাঁদের শব্দ)

টুনটু‌নি ভাই পা‌খি
এই খেলায় সাধারণত ৫/৬ জন অংশগ্রহণ করত। প্রথমে হাত ফু‌টিয়ে একজন কাক নির্বাচন করত। কাক বসে দুই হাত দুই দিকে পা‌খির ডানার মতো মেলে রাখত, বা‌কিরা তার হাতের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে যেত। যাওয়ার সময় ছড়াটা এক লাইন করে বলত। সবার এক লাইন বলা শেষ হলে আবার ‌‌দ্বিতীয় লাইনে যেত। এভাবে সবার বলা শেষ হলে আবার একজন একজন করে এক দমে ছড়াটা বলত। তখন য‌দি কেউ দম ছেড়ে দিত তাহলে সে আবার কাক হত। আবার ক‌াকের হাতের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে যাওয়ার সময় য‌‌দি কারো পা লাগত তাহলে সে কাক হতো।

টুনটুনির খেলার ছড়াটি সংগ্রহ করা হয়েছে : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র পরাগ বর্মনের কাছ থেকে। ছড়াটি নিম্নরূপ :
টুনটু‌নি ভাই পা‌খি
নাচ ত দে‌খি
না বাবা নাচব না
পড়ে গেলে বাচব না
বড় আপুর বিয়ে 
কস্কু সাবান দিয়ে
কস্কু সাবান ভালো না
বড় আপুর ‌‌‌‌বিয়ে হলো না

এ ধরনের খেলা এখন বিলুপ্তপ্রায়।

সংগ্রহ সূত্র : নিকলী উপজেলা দামপাড়া গ্রামের সোনা বানু
নিকলী উপজেলা নগরের টেলিভিশন নাট্যকার ও নির্মাতা- কিশোর মোশা’র বড় বোন জেসমিন আরা
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র পরাগ বর্মন (নিকলী)

সহযোগিতা : কারার বদরুল মোমেন হিমেল, আব্দুল্লাহ আল সাঈদ

 

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!