হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি আজ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে প্রযুক্তি এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে আমাদের হাওরের সংস্কৃতি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে সংস্কৃতির ধারা। দূর থেকে হাওরের গ্রামগুলো দেখতে শত বছর আগের মতই রয়েছে। কিন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটাই উন্নত হয়েছে, এখন আর নৌকায় করে বরযাত্রী বিয়ে বাড়িতে যায় না। কলা গাছ ও রঙ্গিন কাগজ দিয়ে কনের বাড়িতে বরের জন্য গেইট বানাতে এখন শুধুই স্বপ্নের মত মনে হয়। নারকেল না নেওয়ার জন্যে (বরপক্ষ হতে) বিয়ে ভাঙ্গতে, এমনকি বিয়ের আসর থেকে (বিয়ে না করে) বরকে চলে যাওয়ার কথাও শুনেছি অনেক। আর এটা ছিল হাওরপাড়ের বিয়ের সংস্কৃতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ।

এ পর্বে আলোচনা করব হাওরপাড়ের বিয়ের কিছু গীতের কথা, যেটাকে শুদ্ধজনরা বলে থাকেন মেয়েলী গীত।

হাওরাঞ্চলে বিয়ের বাহন হিসেবে বহুল ব্যবহৃত বাহন নৌকা

মেয়েলী গীত

বিয়ের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়দের (নারীদের) একদিন আগেই নাইয়র (দাওয়াত/আমন্ত্রণ) আনার চমৎকার একটা নিয়ম প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। বিয়ে বাড়ি গম গম (হৈচৈ) করত তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধাদের আগমনে এবং সমবেত কণ্ঠে শোনা যেত বিয়ের গীত (মেয়েলী গীত)। বিভিন্ন পর্বে তারা বিভিন্ন রকমের গীত পরিবেশন করত। এ মেয়েলী গীত ছাড়া বিয়ের আমেজ যেন অসম্পূর্ণই রয়ে যেত। তবে অঞ্চলভেদে এ মেয়েলী গীতের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় গীত পরিবেশনের নিয়ম ওঠে গেছে।

বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে কিছু গীত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। তবে কিছু কিছু গীত অসম্পূর্ণভাবেই সংগ্রহ করেছি। তার কারণ হিসাবে জানাতে চাই, এখন বিয়ে বাড়িতে গীত পরিবেশনের রেওয়াজ উঠে যাওয়ায় দিনকে দিন গীত ভুলে যাচ্ছে হাওরপাড়ের মহিলারা।

জারইতলার রুজিনা আক্তার ও তার দলের সাথে লেখক

যেকোনো অনুষ্ঠানেরই একটা ধারাবাহিকতা থাকে। হাওরপাড়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এমনটি লক্ষ করা যায়। সেটা গীত পরিবেশনের সময় আরো বেশি।

হাওরপাড়ের সব অঞ্চলেই যে গীত প্রথম পরিবেশন করা হয় তার নাম হলুদ গীত। বর অথবা কনে উভয় বাড়িতেই হলুদের জন্য একই গীত দিয়ে শুরু করা হয়। এখানে শুধু কনের বাড়িতে হলে আব্যেদুলায় ও বরের বাড়িতে হলে আব্যেদলা শব্দটি উচ্চারণ করা হয়। মেয়েলী গীতের প্রথম যে গীতটি গাওয়া হয় সেটি সংগ্রহ করা হয়েছে জারইতলা ইউনিয়ন কামালপুর গ্রামের রুজিনা আক্তার ও তার দলের কাছ থেকে। গীতটি নিম্নরূপ :
অলদি তোমার জনম কিনুস্থানে।।
আমার জনম আটি মাটির তলে।।
অলদি তুমি লাগো কোনু কানে।।
আমি লাআগী আব্যেদুলার গায়ে।।

মেন্দি তোমার জনম কিনুস্থানে।।
আমার জনম আটি ডাইলে ডাইলে।।
মেন্দি তুমি লাগো কোনু কানে।।
আমি লাআগি আব্যেদুলার হাতে।।

কাঙ্গেনা তোমার জনম কিনুস্থানে।।
আমার জনম বাইন্নারো দোকানে।।
কাঙ্গেনা তুমি লাগো কোনু কানে।।
আমি লাগি আব্যেদুলার হাতে।।

শব্দার্থঃ- অলদি=হলুদ। কিনুস্থানে=কোন স্থানে। আটি মাটি=নরম মাটি। কানে=কাজে, স্থানে। আব্যেদুলা=অবিবাহিত পুরুষ। মেন্দি=মেহেদী। কাঙ্গেনা=রুপার আঙটি। বাইন্না=স্বর্ণ শিল্পী।

মজলিশপুরের রেজি আক্তার ও তার দলের সাথে লেখক

এই হলুদ গীত শেষে ধারাবাহিকভাবে আরো অনেক গীত পরিবেশিত হয়। সংগৃহীত গীতিগুলো দেওয়ার চেষ্টা করব। এ গীতগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী উপজেলা কারপাশা ইউনিয়নের মজলিশপুর গ্রামের মোছাঃ রেজি আক্তার (৪৫)-এর কাছ থেকে। গীতের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তারই মাতা বানেছা বেগম (৮৫)।
আমি ক্যামনে যামু ক্যামনে যামু গো-শ্যাম বন্দেরে তইয়্যা
বন্দের কথা স্মরণ অইলো গো
সই গো হৃদয় যায় জ্বলিয়া।।

শাশুড়ী দিছে গালি গো সই বাপ ও বান্দা খাওরি গো আমি।।
ননদি যে দিছে গালি গো
সই আমি কোলের ছাইল্লা খাওরি গো সই আমি কোলের ছাইল্লা খাওরি,
শাড়ি থইয়্যা বস্ত্র লইয়া গো নামলাম আমি গঙ্গার জলে
শাড়ি নিল চিক্কন কালা গো সই গো কলসি লি সোতে
কেমনে যামু আমি শাম বন্দেরে থইয়্যা।
শাশুড়ি কইও গিয়া গো আমি
জলে দিলাম জাম্পু
গেসেই জলে দিলাম জাম্পু
ননদিরে কইও গিয়া গেসেই আমি জলে দিলাম জাম্পু।

বিয়ের গীত পরিবেশন করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় না কোন বাদ্যযন্ত্রের। নিজস্ব উপস্থাপনার এই ধরনের গীতে আলাদা ও স্বাতন্ত্র্য সুর। অঞ্চলভেদে গীতের লিরিকে তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রীতিনীতি এবং কৃষ্টি কালচার প্রভাবক হিসেবে কাজ করত মেয়েলি গীত।

ভাঙেলারে চতুর্দিকে গো সই
কুঞ্জনাতে বেড়াই তারই মাঝে
লেইক্কা তইছে
জমিদারের বেটা গো-
চলো গো সখি নিঝুম দেশে যাই।
চল গো সখি চলগো সকলে রাত্র
নিশা কালে আমরা আসি চান্দের সাথে।
এইছা ফুলে করে গইরব
গাইডে গাইডে গো ফুল মুনিষী
নিধনে পড়লে রাখি জ্ঞাতিকুল
চল গো সখি নিঝুম দেশে চল
শাপলা ফুলে করে গইরব
উত্তম জালে গো ভাসি রাত্রি নিশি
চান্দের আসে আসি চল গো সখি নিঝুম দেশে যাই।
আগেরে আছলে অলদি
আসি মাডির তলে
অকন কেন আইছ বেলুয়ারের সঙ্গে
বেলুয়ারের মনকনে কালি চমকান
চমক উঠে না জানি আল্লা নছিবে
কেমন দুলা জুডে আগের
আছলা আসি ডালে ডালে..

সংগ্রহ সূত্র : রুজিনা আক্তার ও তার দল, (নিকলী, জারইতলা, কামালপুর)
              মোছাঃ রেজি আক্তার ও তার দল, (নিকলী, কারপাশা, মজলিশপুর)।

সহযোগিতা : কারার বদরুল মোমেন হিমেল, হানিফ রাজ, মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন, মোঃ লিপটন।

 

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!