হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

হাওরপাড়ের বিয়ের লোকাচার
হাওরপাড়ের বিয়ে অন্যান্য এলাকার বিয়ের মতো নয়। কারণ গত পর্বগুলোতে আলোচনা করেছি হাওরপাড়ের সংস্কৃতি অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। আর এমন হওয়ার কারণ হচ্ছে হাওরের মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি-কালচার, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুতে একটা স্বাতন্ত্র্য বহন করে। হাওরপাড়ের বিয়েগুলো হয় একটু অন্যরকম স্বাদের।

বিয়ে যখন পুরোপুরিভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন গ্রামের সকল মানুষকে ডেকে এনে তাদের বিয়ের ব্যাপারে জানানো ও আগাম দাওয়াত দেওয়ার একটা প্রচলন রয়েছে। যেটাকে বলা হয় পঞ্চায়েত/পাচাইত।

পাচাইত
পাচাইত হচ্ছে মিষ্টিমুখ করানো/ পানচিনি খাওয়ানো। আর তাদের বাড়ির বিয়ের খুশির খবর গ্রামের সকল মানুষকে বাড়িতে ডেকে এনে পান এবং চিনি একসাথে খাওয়ানো ও বিয়ের পরামর্শ করাকে পাচাইত বলে।

এ সময় গ্রামের সকল মানুষের সাথে, বিশেষ করে মুরব্বিদের সাথে কনের পিতা অথবা বরের পিতা শলাপরামর্শ করেন বিয়ের দিন-তারিখ কি করা যায়? কিভাবে মেহমানদারী করা যায়? কিভাবে গ্রামের মান-সম্মান রক্ষা করা যায়? বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। যথারীতি সকল প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয় কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেটাকে হাওরপাড়ের ভাষায় বলা হয় “চলন যাওয়া”।

চলন যাওয়া
হাওরাঞ্চলের মানুষ সাধারণত মধ্যরাতে কনের বাড়িতে যাওয়ার প্রচলন ছিল। যেটাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় চলন যাওয়া। হাওরপাড়ের বিয়েতে ঋতুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন বাহন ব্যবহার করা হতো। যেমন-
১. পালকি
২. রিকশা
৩. নৌকা।

পালকি, রিকশা কিংবা নৌকায় বরের সাথে সব সময় থাকতো তার কাছের বন্ধু-বান্ধবরা। বর যখন কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হত তখন রাস্তায় ঘটতো মজার মজার কিছু ঘটনা। স্থানীয় ছেলে অথবা অন্য মুরুব্বিরা বরকে রাস্তায় আটকাতো, বরের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের বায়না ধরত এবং তা আদায় করত। যেটিকে হাওরপাড়ের ভাষায় বলা হয় “খরহইত্যা”।

বরপক্ষও আগে থেকেই সে রকম প্রস্তুতি নিয়ে আসতো। বেশিরভাগই দেখা যেত বরের সাথে নিয়ে আসত বাতাসা এবং ছোট ছোট বিস্কুট ভর্তি ফাইলা (মাটির হাড়ি)। রাস্তায় যারা বরকে আটকাতো তাদেরকে খুশি করার জন্যই এই বাতাসা এবং বিস্কুট ভর্তি ফাইলা দেয়া হত। কখনো কখনো দুষ্টুমি করে বরপক্ষ কিছু ফাইলার (মাটির হাড়ি) ভেতর বরহির (ছাগল/ছাগি) লেদা (বিষ্টা) ভরে নিয়ে যেতেন। বাতাসা/বিস্কুটের হাড়ির সাথে দুই/একটা বরহির লেদাভর্তি ফাইলাও জুড়ে দেয়া হতো। কোথাও কোথাও আবার পরিমাণ মতো টাকা না দিলে রাস্তা ছাড়া হতো না বরের। রাস্তায় যেন এসব নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকত বরের নানা, দাদা অথবা বোনজামাই বা দুলাভাই।

বরপক্ষ কনের বাড়িতে পৌঁছানোর পর কনেপক্ষের মুরুব্বিরা না আসা পর্যন্ত বরকে ঘরে উঠানো হতো না।

উপরোক্ত তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী সদর নগর গ্রামের তফিজউদ্দিন-এর কাছ থেকে। তিনি টেলিভিশন নাট্য নির্মাতা ও নাট্যকার কিশোর মোশার বাবা।

এখানেই অনুষ্ঠানের আনন্দ শেষ নয়। কনের বাড়িতে কলাগাছ দিয়ে গেইট সাজিয়ে অপেক্ষমান তরুণ-তরুণীদের যতক্ষণ না পর্যন্ত অর্থ, মিষ্টি ও উপঢৌকন দিয়ে খুশি করা হতো, ততক্ষণ বরকে ঘরে তোলা হতো না।

কলাগাছের গেইটের সামনে চলতো নানান রকমের তর্কাতর্কি (উপভোগ্য ফূর্তি)। শুধু অর্থ দিয়ে কলাগাছের গেইট পার হওয়া যাবে না। এই কলা গাছের গেইট পার হতে হলে গেইটে দাঁড়ানো তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিতে হবে।
যেমনঃ
কনে পক্ষ-
আসেন তো দুলাভাই
বসেন তো চিয়ারে
বলেন তো শরবত বানাইতে 
কি কি লাগে?

এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বরের সাথে থাকা দুলাভাই অথবা বন্ধুরা আগে থেকে প্রস্তুত থাকত। তারাও মজা করে উত্তর দিত এভাবেঃ
গাছের একটা লেবু লাগে
এক গ্লাস পানি লাগে
দোকানের চিনি লাগে
একটা চামচ লাগে।

বরপক্ষ যখন কনেপক্ষের সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতো, কনেপক্ষের তরুণ-তরুণীরা আরও জটলা লাগানো প্রশ্নের তৈরি করত এবং সে প্রশ্নগুলো করত এভাবেঃ
চিড়া খাও মুড়ি খাও
আরও খাও দই,
পাল্কিত কইরা নিতে আইছো
মা না মুই?

এমন প্রশ্নে বরের সাথে থাকা কেউ বা রেগে যেত আবার কেউ বা মজা করে সে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে দিত এভাবেঃ
পান খাইলাম ফিরি
লং দিয়া বানাই বিড়ি
পাল্কিথ কইরা নিতাম আইছি আপনার স্ত্রী।

উপরোক্ত ছড়াগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে হাওর গবেষক (অপ্রকাশিত) খায়রুল আলম বাদল-এর কাছ থেকে।

এবার সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এবং গেইটে দর কষাকষির পর নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিয়ে বর তার নিজের আসনে এসে বসেন। বরের আসনে যে খাবার পরিবেশন করা হয় স্থানীয় ভাষায় বা হাওরপাড়ের ভাষায় সেটাকে বলা হদরভাতা।

হদরভাতা
বিয়েকে কেন্দ্র করে বর এবং কনেকে আলাদা আলাদা বৃহৎ দু’টি সুন্দর থালায় উৎকৃষ্টমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। এ খাবার খেয়ে থাকে বরের সাথে থাকা তার বন্ধুরা এবং কনের বান্ধবীরা। কোন কোন অঞ্চলে মুরুব্বিরা এসে যোগ দিতে দেখা যায় এই হদরভাতার থালায়।

থালায় সাজানো থাকে ২৪ প্রকারের খাবার। নানানরকম ভাজি। থালার মাঝখানে থাকে আস্ত খাসি অথবা সামর্থ্য অনুযায়ী মোরগ-মুরগি। যখন খাওয়া শুরু হয় তখন কিছুটা বিশৃংখলা দেখা দেয়। খাবার শেষে আবার সবাই আগের মত হয়ে যায়।

খাওয়া-দাওয়ার শুরুতে এবং খাওয়া চলাকালে ঘটতে থাকে আরো মজার খেলা। “জুতা চুরি”। এ সময় বরসহ অন্য মেহমানদের জুতা চুরি (লুকানো) করার চেষ্টা চলে। লুকানোর তালিকায় থাকে ছাতা, লাইটও। হাওরপাড়ের বিয়েতে এ ধরনের চুরি (লুকানো) যেন নিয়মের ভেতরে পড়ে গেছে। এছাড়াও বরের পক্ষ থেকে যারা দাওয়াতি মেহমান, তারা অনেক সময় ছোট চামচ, ছোট পাতিল, থালা, হাতপাখা চুরি করে নিয়ে আসত।

খাবার-দাবার শেষে কনের পক্ষ থেকে একজন এসে বরের পক্ষের লোকদের কাছে ক্ষমা চাইত এজন্য যে, তাদের আপ্যায়নে কোন প্রকার ঘাটতি থাকতে পারে, সেজন্য বরপক্ষ যেন ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।

সকল কার্যক্রম শেষে বর এবং কনেকে একসাথে দুধভাত খাওয়ানোর আগে রয়েছে আরো কিছু মজাদার “বিয়ে খেলা”। কনের কাছে যাওয়ার জন্য বরকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সেই অধিকার নিতে হয়। আর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে বরের সাথে থাকা তার বন্ধু এবং দুলাভাইয়েরা।

নিয়ম অনুযায়ী কনে পক্ষের লোকেরাই আগে প্রশ্নগুলো করে। যেমনঃ
আসসালামু আলাইকুম নেন
জামাই আইছে বিয়া করতে আপনেরা আইছুন কেন?

বরপক্ষ
ওয়ালাইকুম আসসালাম ওবা,
জামাই আইছে বিয়া করতে আমরা আইছি শুভা।

এগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী সদর বানিয়াহাটি গ্রামের হাবিবুর রহমান-এর কাছ থেকে। তিনি পনের বছর যাবত কিশোরগঞ্জ গণসাংস্কৃতিক দলের সাথে যুক্ত রয়েছেন।

কনেপক্ষ
পান খায় পান সুন্দরী
কথা কয় ঠারে,
পানের জন্ম তারিখ
কুন কুন বাড়ে?

বরপক্ষ
চালুন দিয়া আনুইন পানি
অজু কইরা লই
হেয়ার পরে সবার সামনে আমি
পানের জন্ম তারিখ কই।

এ বিয়ের ধাঁধাটি সংগ্রহ করা হয়েছে হাওর গবেষক (অপ্রকাশিত) খায়রুল আলম বাদল-এর কাছ থেকে।

সংগ্রহ সূত্র : নিকলী সদর নগর গ্রামের তফিজউদ্দিন, হাওর গবেষক (অপ্রকাশিত) খায়রুল আলম বাদল এবং নিকলী সদর বানিয়াহাটির হাবিবুর রহমান।
সহযোগিতা : কিশোর মোশা, কারার বদরুল মোমেন হিমেল, হানিফ রাজ, লিপটন, আল আমিন।

 

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!