হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

শেখ মোবারক হোসাইন সাদী ।।

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি নিলক্ষা এই সম্পদ আজ বিলুপ্তির পথে। এর মধ্য থেকে যতটুকু সম্ভব সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি মাত্র। কালের কবলে হারিয়ে যাওয়া এই লোকছড়াগুলো হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে পাঠকদের মাঝে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে। বর্তমান সময়ে বিলুপ্তির পথে খেলার ছড়াগুলো অসমাপ্তভাবেই সংগ্রহ করা হচ্ছে। কিছু কিছু লোকছড়া সংগ্রহকালে দেখেছি বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়া বা আধুনিক শব্দ প্রয়োগ হয়েছে। যেমনঃ
কি ফুড?
সেন্টার ফুড।

কথককে প্রশ্ন করতেই উত্তরে বলেন আমরা যখন কোন ছড়া ভুলে যাই তখন নিজে থেকে বানিয়ে বলার চেষ্টা করি।

আমার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ও পাঠকবৃন্দ বলেছেন হাওরপাড়ের প্রেম নিয়ে লেখার জন্য। তাদের উদ্দেশে বলছি, হাওরপাড়ের প্রেম থাকছে আমার অপেক্ষমান পর্বে। এই প্রেমের সাথে যুক্ত আছে হাওরপাড়ের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কৃষিকাজ এবং উন্নয়ন। অতিখরা অথবা অতিবন্যার ছোঁয়া লাগে হাওরপাড়ের প্রেমে। এক করুণ বিচ্ছেদ নিয়ে থাকছে হাওরপাড়ের প্রেমের কথা।

তবে আমার এই পর্বে থাকছে হাওরপাড়ের খেলা ও খেলার ছড়াগুলো, যেটাকে বলা হয় লোকছড়া।

একে ঋতু
এ খেলায় ছয় থেকে সাতজন ছেলে অংশগ্রহণ করে থাকে। হাত ফুটানোর মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে একজন কাকুর হবে যাকে বলা হয় চোর। আর যে চোর হবে সে ডগ আসন করে মাটিতে দাঁড়াবে। তার ওপর দিয়ে একের পর এক যেতে থাকবে। দুটো হাত ব্যতীত তার (কাকুর/চোর) শরীরের কোন অংশ যদি লেগে যায় বা স্পর্শ করে তাহলে সে আবার চোর (ডগ আসনে দাঁড়ানো) হবে এবং তার ওপর দিয়ে বাকিরা আবার যাবে। তবে যাওয়ার সময় কিছু কথা বা ছি দিতে থাকবে। যেটাকে বলা হয় লোকছড়া। এই ছড়াগুলো বলতে হবে এক নিঃশ্বাসে তিনবার করে। যদি এক নিঃশ্বাসে তিনবার না বলতে পারে তাহলে সে আবার কাকুর হবে। যেমনঃ
১। ‌একে ঋতু (একবার)
২। দুয়ে ডাবল টু (দুইবার)
৩। তিনে ঘোড়া চলে (তিনবার)
৪। চারে চাচ্চুম মাচ্চুম চুমচুম। (বাকি সবগুলো ছড়া তিনবার করে)
৫। পাঁচে পয়সা
৬। ছয়ে ছিলুক পাঠি
৭। সাতে স্বাধীনতা
৮। আডে আসেন্ত দুলাভাই বসেন্ত চিয়ারে আপা কি করে
৯। নাংগল
১০। দশে দাদু রিকশা চালাইছে, দাদু কলা এনেছে, আহা খুব মজা লেগেছে
১১। এগারোতে দাড়ি কামায় নদীর পানি টল মল, আমার একটা টেং আছে গাছে উইট্টা ডেং ডেং/
এগারোতে আমতলা কাজ করি বসুন্তলা বিয়া করি, বউ না দিলে গুসা করি, তালের পিঠা নাস্তা করি
১২। তুক্কু বারো টেং তুইলা কারো।

বার নাম্বার ছি দেওয়ার পর সবাই এক পা তুলে মোরগ লড়াইয়ের মত দাঁড়াবে। এভাবে যার পা আগে মাটিতে পড়ে যাবে সে হবে আবার কাকুর। চক্রাকারে অনেকক্ষণ চলতে থাকে খেলা। হাওরপাড়ের ভাষায় এই খেলার নাম একে ঋতু।

একে ঋতু খেলাটি সংগ্রহ করা হয়েছে নিকলী উপজেলার জারইতলা ইউনিয়ন কামালপুর গ্রামের মোঃ হারুন মিয়ার কাছ থেকে। তিনি বর্তমানে নিকলী মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ সরকারি কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

জারইতলা ইউনিয়ন কামালপুর গ্রামের মোঃ হারুন মিয়ার সাথে লেখক

ইচিং বিচিং
ইচিং বিচিং খেলাটি অনেকভাবে খেলে থাকে। অঞ্চলভেদে এ খেলার ধরন ভিন্ন রকমের হয়।

হাওরের কোনো কোনো অঞ্চলে ইচিং বিচিং খেলাকে আবার নুনতা খেলা বলেও ডেকে থাকে। তবে নুনতা খেলা নিয়ে আমার একটি বিশেষ পর্ব অপেক্ষমান। নিকলী সদর ইউনিয়নের ছেলেমেয়েরা এই খেলাটি খেলে দু’জন কাকুর-এর মাধ্যমে। এই খেলায় ৪ থেকে ৫ জন অংশগ্রহণ করে থাকে। দু’জন কাকুর পা মিলিয়ে একজনের পায়ের সাথে অন্যজনের পা স্পর্শ করে ছড়িয়ে বসে। অন্যরা তার ওপর নেচে নেচে ছড়া কাটে।

ইচিং বিচিং-এর এরকম খেলা নিকলী এলাকায় খেলে থাকে

কিন্তু মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নে এ খেলার ভিন্নতা দেখতে পাই; যদিও ছড়াগুলি একই। এখানেও দু’জন কাকুর হয়। এ খেলায় অংশগ্রহণ করে চার থেকে পাঁচজন। দু’জন কাকুর তার একটা পায়ের উপর অন্য পা আবার তার একটার উপর অন্য পা, আবার তার হাতের উপর হাত, আবার তার হাতের উপর হাত রেখে উঁচু করে। অন্যরা উঁচু স্থান দিয়ে লাফ দেয় এবং ছড়া কাটে। ছড়া গুলো এমন:-

ইচিং বিচিং

ইচিং বিচিং
শুভ কাঠি
মামা আইছে ঘাইম্যা
দর ছাতি নাইম্যা
ছাতির উপর কুকুরা
বোয়াল মাছের মুকুরা
এলো পেৎ জেলো পেৎ।

নেওগো তোমার সোনার হাত (টেনে সুর করে)
সোনার হাতের লাঠি
ডেগের চাইলে কাটি
ডেগ ডুগ বুইড়া মাথা ইন্দুর।

[শব্দার্থ : ঘাইম্যা=ঘেমে/ক্লান্ত হয়ে। নাইম্যা=নেমে/দ্রুত এসে। কুকুরা=ছাতার অগ্রভাগ। মুকুরা=বোয়াল মাছের মাথা। এলো পেৎ জেলো পেৎ= তড়িঘড়ি করা/তাড়াহুড়া করা। ডেগ= পাতিল।]

ইচিং বিচিং-এর এরকম খেলা সাধারণত মিঠামইন এলাকায় খেলে থাকে

প্রশ্ন-উত্তর খেলা
এই খেলা সাধারণত ৫ থেকে ৬ জন করে দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে খেলা খেলে থাকে। একদল প্রশ্ন করবে অন্য দল উত্তর দিবে। প্রশ্ন করা ও উত্তর দেওয়া শেষ হলে শুরু হয় দম ফেলানোর কাজ, মানে ছি দেওয়া। ছন্দে ছন্দে যে প্রশ্নগুলো করা হয় এবং যার উত্তর দেওয়া হয় সেটি নিম্নরূপ:
এলোমেলো ছিল ছালে
কী ছিল?
-লেবু ছিল
কী লেবু?
-বাত্তি লেবু
কী বাত্তি?
-মোম বাতি
কী মোম?
-সাদা মোম
কী সাদা?
-দুধ সাদা
কী দুধ?
-ফেনা দুধ
কী ফেনা?
-সাবানের ফেনা
কী সাবান?
-বল সাবান
কি বল?
-ফুট বল
কী ফুট?
-সেন্টার ফুট
কী সেন্টার?
-টিভির সেন্টার
কি টিভি?
-বড় টিভি
কি বড়?
-আল্লাহ্ বড়
কী আল্লা?
-সুবাহান আল্লাহ।

এই ছড়ার মাধ্যমে আমরা ধর্মীয় আবহ খুঁজে পাই। হাওরপাড়ের ছেলেমেয়েরা খেলার মাধ্যমে যে ইসলামচর্চা করত, তারই একটা উদাহরণ এই প্রশ্ন-উত্তর খেলায় মেলে।

এই পর্ব শেষ হওয়ার পরই দুই দল থেকে দু’জন প্রস্তুত হবে। একজন দৌড় দিবে আরেকজন তার পেছনে দম নিয়ে দৌড় দিবে অর্থাৎ ছি। আর ছিগুলো হতো বিভিন্ন ছড়ার মাধ্যমে, যেটাকে আমরা এতক্ষণ বলে এসেছি লোকছড়া। নিচে প্রশ্ন-উত্তর খেলার কিছু দম বা ছি দেওয়া হল:
ছিইইইইইইইইইইইইই…
যাই হোক, ছি-এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের একজনকে ছুতে পারলে নিচের ছড়াগুলো বা প্রশ্ন-উত্তরগুলো আবার দেওয়া হতো।
ভাইরে ভাই?
-কি রে ভাই
-পইক ধরছি
কি পইক?

আতার লাতা
কার মাথা?
-ছইড়া দাড়া ছইড়া দাড়া
-ছড়ছি ছড়ছি
-আরো ছড়।

ইচিং বিচিং ও প্রশ্ন-উত্তর খেলা দু’টি সংগ্রহ করা হয়েছে মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের আশুপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর কন্যা আদ্রিতা অরোরা নিতই-এর কাছ থেকে। সে মিঠামইন তমিজা খাতুন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।

কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের আশুপুর গ্রামের ইদ্রিস আলীর কন্যা আদ্রিতা অরোরা নিতই-এর সাথে লেখক

কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের মোঃ জিল্লুর রহমানের ৭ বছরের শিশুকন্যার কাছ থেকে ইচিং বিচিং-এর আরেকটি দুর্দান্ত ছড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। যেমন:
ইচিং বিচিং
দার্গা মাছে লড়ে ছড়ে
কাক্কু আইছা ডাক মারে
আসেন কাক্কু বাইত যাই
বইসের দুধ দে ভাত খাই,
চেন চুন বুরুৎ।

এই ইচিং বিচিং খেলার বিভিন্ন রকমের ছড়া পাঠ করতে শোনা যায় বিভিন্ন অঞ্চলে। তেমনই একটা আমার নিজের জানা ছড়া ছিল। সেটা আমি নিচে আমার মতো করে উপস্থাপন করছি।
ইচিং বিচিং চিচিং চা
প্রজাপতি উড়ে যা
এক লাঠি চন্দন কাটি
চন্দন বলে খা খা…

খেড়ের লাছ
বৈশাখ মাসে হাওরাঞ্চলের একমাত্র বোরো ধান উঠানো শেষে ধানের খড় বাড়িতে একত্রে করে থাকেন হাওরপাড়ের কৃষকেরা। এই খড় সংগ্রহ করা হতো বৈশাখ মাসের শেষের দিকে। খড় সংগ্রহ করার জন্য একই বাড়িতে প্রয়োজনবোধে ১০০ থেকে ৫০০ লোক এসে জড়ো হতো খড় একত্রিত করতে। হাওরপাড়ের ভাষায় যেটাকে বলা হয় “লাছ”।

অনেক সময় বৈশাখ মাসের শেষদিকে অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে কোনো এক সময়ের মধ্যে ধান কাটা, মাড়াই (চুঁচুড়া) ও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করার জন্য কারির (গোলা=ধান সংরক্ষণের স্থান) মধ্যে রাখা হয়।

বেগাইড়া (স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত) মানুষদের নিয়ে এসে খড়গুলোকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে উঁচু করে স্তূপ করে রাখা হয়। অঞ্চলভেদে ও স্থানভেদে এলাচের আকৃতি গোল লম্বা স্কয়ার বা বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। অল্প একটু জায়গায় এ “লাছ” তৈরি করা হয়।

লাছ দেওয়ার সময় একটা উৎসবমুখর পরিবেশ গড়ে ওঠে হাওরাঞ্চলে। কোনো কোনো এলাকায় মাইক বাজাতে দেখা যায়। যারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে খড় সংগ্রহ করে স্তূপাকৃতি করছেন তাদেরকে প্রথমত খাওয়ানো হয় পুলিপিঠা, কোথাও কোথাও চৈ পিঠা। কোনো কোনো অঞ্চলে এই চৈ পিঠাকে আবার বলা হয় মেরা পিঠা। এই পিঠার সাথে লাল মরিচ আর চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা অন্যরকম স্বাদ নিয়ে আসে।

এই খড়কুটোর “লাছ” দেওয়া শেষ হলে হাওরাঞ্চলের মানুষ সম্পূর্ণভাবে কর্মমুক্ত হয়ে পড়ে। তখনই তারা জড়িয়ে যায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। বড়রা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করে আর ছোটরা তাদের খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারণ তখন তাদের আর কোন কাজ থাকে না।

হাওরপাড়ের খেলার কিছু লোকছড়া নিচে দেওয়া হল:
১। আপেল শক্ত
বেদেনার রক্ত
আঙ্গুর ঝড় ঝড়
হেল অ হেল অ
টি হেল অ

২। উড়িদা বুড়ি বায়
কুত্তাদা আল বায়
কুত্তা গেছে লেইট্টা
দূর শালা বেইট্টা।
ছটপট পোলাপুরি
আল মারাইতে যায়
খুডার মধ্যে টাক্কর খাইয়া
নাকফুল পইরা যায়।

৩। আম পড়ে টাপুস টুপুস
রস পড়ে চুইয়া
ইসমাইলে পাগল অইছে
লাকিরে লইয়া।
লাকির ভিতর পাখির বাসা
লাকি করে ভালবাসা।

এই লোকছড়াগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের মারিয়া আক্তারের কাছ থেকে। সে নতুন কুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে হাওরপাড়ের জলখেলা।

কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের মারিয়া আক্তারের সাথে লেখক

জলখেলা
এই খেলা সাধারণত পানির মধ্যে খেলে থাকে বর্ষার সময়ে। হাওরপাড়ের ছেলেমেয়েরা যখন পানিতে গোসল করে তখনও থাকে তাদের নানারকম ছড়া। এই ছড়ার মাধ্যমে তারা গোসল করে আবার খেলেও থাকে। শুদ্ধজনের মতে এমন খেলাকে “জলখেলা” বলা হলেও হাওরপাড়ের ভাষায় এ খেলার নাম “বলাই” খেলা। এই খেলার কিছু লোকছড়া নিচে দেওয়া হল:
১। ওট্টি কি?
-ঔড়া
সারাদিন দৌড়া।

২। ওট্টি কি?
-বলায়
ডুব দিয়া পলাই।

৩। ছাগল দাড়ি রে ভাই
ছাগল দাড়ি
কিরে ভাই লক্ষী দাড়ি
তর ছাগলে হাইছে ধান
হায়া বাইন্দা আন
কি দ্যা?
রশি দ্যা
রশি কই তে
গাছের আগাত তে
গাছ কহন
গাংগের তরিৎ
তরা বাড়িত কার বিয়া?
ইয়া নানির বিয়া
কি দিয়া?
গা ছাগল দিয়া?

৪। সবুজ দাদা তুমার মুখে কি?
-লাল টক টক সুবারি
এই ছেড়ি তোর মা কই?
-পুকুর পাড়ে
নানব কেডা?
-মইরম খালা
হাইব কেডা?
-দুলা ভাই শালা

৫। বউ গো বউ ওঠে
চোখের পানি মোছে
তোমার জাতে কি?
-কমলা
হাউনা ক্যারে?
-চুক্কা লাগে
ফালাই দেও?
-মায়া লাগে
তুমি কাকে চাও?…

যাকে কাক্কুর বা চোর বানাতে হবে তার নাম উল্লেখ করতে হবে।

কালের সাথে সাথে ছড়াগুলোর কিছু এলোমেলো ঘটেছে। এক খেলার ছড়া ব্যবহার করা হচ্ছে অন্য খেলায়। তাই সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না এই ছড়াগুলো কোন খেলায় ব্যবহার করা হতো। এমন কিছু এলোমেলো ছড়া নিচে দেওয়া হল:
১। লিতা গো লিতা
চুলের ফিতা
কানের দুল
রক্ত জবার ফুল।
ওই বাড়ির সেলিনা
তার সাথে মিলিনা না
তার সাথে আড়ি
যাব না তাদের বাড়ি।
তাদের বাড়ি দুতলা
কাক ডাকে ইশারায়।

২। আম্মু তোমার পায়ে পড়ি
পুতুল নিয়ে খেলা করি,
পুতুলের মাতাত কুকরা চুল
এনে দিবো গোলাপ ফুল।
গোলাপ ফুলের গন্ধে‌
জামাই আইব আনন্দে।

৩। ঈতল গাছের বিদল লতা
মাথা আছুরি।
সাত ভাইয়ের সাবান দিয়ে গোসল করি।

গরো গেছলাম খাইতাম
চিপাত গেছলাম কানতাম।
চিপায় কি আমার তে বিয়া বইবি?

৪। আমপাতা দে জামপাতা দে
দোস্ত পাতাইলাম।
বড় বাড়ির বড় বউ চিড়া কুডাইতাম।
চিরাত কেরে লোউ
ইদ্রিস এর বউ।
ইদ্রিসে যদি মরে
কবর দিবি কহন?

বগি গাছের তলে
বগি আলী ঝনঝন করে।

৫। আমায় ডিসকো দিবানি
আমায় খেলাত নিবানি।
গোদা গোদা পাও দিয়া
মা যায় শ্বশুর বাড়ি
শ্বশুর বাড়ি শ্বশুর বাড়ি
পেপে।
পেপে আমায় ডাকে, পেপের নাম ইউ,
আই লাভ ইউ।

৬। শান্তা লাতা গাছের পাতা
গাছ ঝিলমিল করে।
শান্তা লাতার বিয়ে হবে
জমিদারের ঘরে।
জমিদারের ঘরে ছেলেরা
মুরগা চুরি করে
আদা পথে গিয়া মুরগা কক কক করে।
জমিদারের ছেলেরা লম্বা ঘড়ি পড়ে।

৭। আসের বাচ্ছা চুই চুই
ঐ রে আস তোর বাড়ি কই?
-আমার বাড়ি বিতঙ্গল
বেইল থাকতে যামুগা।
হাক্কু মাছদে হামুগা
হাক্কু মাছের লম্বা দাড়ি
আমরা দুইভাই মিছতুরি
টিনের চালে কাম করি।

দেশে আইছে ইরি ধান
ইরি ধানের গন্দে, নয়া বাবি কান্দে।

হাওরপাড়ের সংস্কৃতির এই ছড়াগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজজোড় ইউনিয়ন নয়াকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের কন্যা মার্জিয়ার কাছ থেকে। সে মিঠামইন তমিজা খাতুন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

কথা হয় মার্জিয়ার সাথে। সে জানায়, বর্তমান সময়ে খেলার সাথী না পাওয়ায় আমরা আর এ ধরনের খেলা খেলতে পারছি না। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে খেলাগুলো খেলার জন্য। আপনার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সত্যিই গর্বিত এর জন্যই যে আমার এলাকার ছড়াগুলো খেলাগুলোর এত চমৎকার কিন্তু ভাগ্য এমন দেখেন! পড়াশোনা ছাড়া এখন আর কিছুই ভাবতে পারছি না।

কেওয়ারজজোড় ইউনিয়ন নয়াকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের কন্যা মার্জিয়ার সাথে লেখক

মিঠামইনের ভাষা ও উচ্চারণে হাওড় এলাকার আঞ্চলিক টান রয়েছে। মিঠামইন উপজেলার আঞ্চলিক ভাষার শব্দভাণ্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। স্থানীয় মানুষের মুখে আঞ্চলিকতা এখানকার ভাষাকে করেছে সমৃদ্ধ, এনেছে স্বাতন্ত্র্য। সংস্কৃতির দিক থেকে মিঠামইনের রয়েছে স্বকীয়তা। যেমন বিশেষ করে মিঠামইন ও ওই অঞ্চলে “খ”-এর উচ্চারণ “হ” করে থাকে।

পালাগান, কিসসা গান, বিচার গানসহ ভাটিয়ালী গানের এক বিশাল ভাণ্ডার এই উপজেলা। এক সময় এই অঞ্চলে ঘাটু গান অনেক জনপ্রিয় ছিল। ঘাটু গান নিয়ে আমার বিশেষ পর্ব অপেক্ষমান।

সংগ্রহ সূত্র : নিকলী উপজেলা জারইতলা ইউনিয়ন কামালপুর গ্রামের মোঃ হারুন মিয়া। মিঠামইন উপজেলা কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের আশুপুর গ্রামের আদ্রিতা আরোরা নিতই, অলিপুর গ্রামের মারিয়া আক্তার, নায়া কুড়াকান্দি গ্রামের মার্জিয়া আক্তার।

সহযোগিতায় : সাইদুর রহমান, কারার বদরুল মোমেন হিমেল, জুনাঈদ হাসান রাজু।

 

সকল পর্ব :

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৮

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ৯

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১০

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১১

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১২

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৩

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৪

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৫

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৬

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৭

হাওরপাড়ের সংস্কৃতি : পর্ব ১৮

Similar Posts

error: Content is protected !!