ফানুস

শাইলা পারভীন সুমা ।।

সন্ধ্যা সাতটা বাজে। শীতের দিনে সন্ধ্যা সাতটা মানে চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। কুয়াশা পড়েছে হালকা পাতলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সুপার মুনের মতো একটা পূর্ণ চাদঁ। একদল দলছুট মেঘ সুপার মুনকে ঢেকে ফেলার পায়তারায় ব্যস্ত। সুপার মুন ও কম না। দলছুট মেঘকে চোখ রাঙিয়ে ইশারায় সরিয়ে দিচ্ছে। আজ তার বিশেষ দিন । সুপার মুনের আলোয় পৃথিবীর মানুষেরা পত্রিকা, গল্প নানান রকম বই পড়ার চেষ্টায় মগ্ন থাকে । যেনতেন চেষ্টা না একেবারে পরিবার পরিজন সকলকে নিয়ে চেষ্টা।

সুপার মুন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বসার জন্য একটা জায়গা খুঁজছি। বসার প্রত্যেকটা জায়গায়ই হাউজফুল। চারপাশ লোকে লোকারণ্য। প্রতিটি সিটের পিছনে বোধহয় চারজন করে অপেক্ষামান যাত্রী। চাকুরীর বাজারের মতোই এখানে ও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কার আগে কে মোক্ষম সুযোগ বুঝে জায়গাটা দখল করবে।

হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় এসে দেখি অনেক গুলো সিট খালি। সিটে বসে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ট্রেনের সময়সূচি দেখছি। ট্রেন লেট, দু ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। দু ঘন্টা সময় কিভাবে কাটানো যায় সেটা বসে বসে ভাবছি। পত্রিকা কিনে পড়া যেতে পারে। স্টেশনে রকমারি ম্যাগাজিন ও পাওয়া যায়।পত্রিকা কিনতে হলে আবার স্টেশনের ঐ মাথায় যেতে হবে। ক্লান্তিতে পা আর চলছে না। এক কাজ করা যেতে পারে। প্ল্যাটফর্মে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখা যেতে পারে। সময় ও কাটবে আবার লেখার জন্য গল্পের প্লট ও পেয়ে যেতে পারি। পাশেই একটা দশ বারো বছরের মেয়ে অভিভাবকের সাথে উবু হয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে। একটু পর পর জিজ্ঞেস করছে বাবা ট্রেন কহন আইবো? দিরং আছে। দিরং ক্যান বাবা? তা তো কইবার পারিনা মা। মনে হয় কুয়াশার কারণে। মেয়েটা উন্মুখ হয়ে বাইরের গাঢ় কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পর বাবার হাত ধরে বলে, বাবা আমারে একটা ক্যামেরা কিইন্না দিলে না? সত্যি সত্যি ক্যামেরা না। ঐ যে গলায় ঝুলায়ে রাহে, দূরের জিনিস কাছে দেহা যায় আবার কাছের জিনিস দূরে দেহা যায়। দাম তো বেশী না বাবা। ঐ ক্যামেরা থাকলে ট্রেন এহন কোন জায়গায় আছে দেখবার পারতাম। মেয়েটির বাবা মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে এই বার দিতে পারলাম না, আগামী বার দিমু। মেয়েটা অভিমানের সুরে বাবার হাত সরিয়ে বলে প্রত্যেক বারই তুমি আগামী আগামী বার কও। এই আগামী বার কহনো আয়ে না বাবা। বাবা ও মেয়ের কথোপকথনে নেমে আসে নীরবতা। আমি অভিমানী মেয়েটার মনের ভাব পড়ার চেষ্টা করি। ঘন কুয়াশার কারণে যেখানে আট দশ হাতের দূরের জিনিস দেখা যায় না সেখানে বাইনোকুলার দিয়ে কিভাবে পঁচিশ-ত্রিশ কিলো দূরের একটা ট্রেন দেখা যাবে সেটা ভাবি!

বাবা ও মেয়ের কথোপকথন থেকে আমি অন্য দিকে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। একটু দূরে দেখি একদল টোকাই পুরনো কাগজ দিয়ে আগুন ধরিয়ে হাত দুটো গরম করছে।গায়ে হালকা ও ময়লা জীর্ণ কাপড়। এক পলক দেখেই বুঝা যায় এই তাপমাত্রায় এই কাপড় শীত মানার জন্য যথেষ্ট নয়।শরীর গরম করতে গাদাগাদি হয়ে বসে আছে। একজন আরেকজনের গালে গরম হাতের উষ্ণতা ছুয়াচ্ছে। কত সুন্দর শৈশব হওয়ার কথা ছিল ওদের! কিছু বিষয় আমরা কোনোদিন বুঝবো না। আমাদের মাথার উপরে যাদের নিরাপদ আশ্রয় আছে, গায়ে শীতের মোটা কাপড় আছে তারা কোন ভাবেই উপলব্ধি করতে পারবো না এই শীতের দিনে খোলা রেল স্টেশনে শুয়ে থাকার কি নিদারুন কষ্ট!

লেখিকা

হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়তেই একটা আলোর আভা দেখে চমকে গেলাম।শূন্য থেকে একটা আলোর মতো কিছু নিচের দিকে নামছে। একটা ফানুস উপরের আকাশ থেকে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে। দুদিন আগেই পূরাণ ঢাকায় ঘুড়ি ওড়ানোর সাকরাইন উৎসব হয়ে গেল। ঘুড়ি আর ফানুসে ছেয়ে গেছিল পুরান ঢাকার আকাশ।

আমি অবাক বিস্ময়ে ফানুসটার দিকে তাকিয়ে আছি। ফানুস বরাবর উপরের দিকে উড়তে দেখেছি। এই প্রথম নিচের দিকে নামতে দেখলাম। একসময় ওদের ও দৃষ্টি পড়লো ফানুসের উপর। আগুন পোহানো বাদ দিয়ে এই পথশিশুদের দল ছুটছে আকাশ থেকে ধেয়ে আসা ফানুস ধরতে।সামনে রেললাইনের স্লিপার, পাথরের অমসৃণ পথ, স্টেশনের অল্প আলোয় অপেক্ষারত যাত্রীদের মুখ, কুয়াশাচ্ছন্ন রাত, এই পথশিশুদের দৌড়ে যাওয়া, সবকিছুর উপরে যেন ঝুলে আছে একটা ফানুস।

ফানুসের এই আলোর মতো বাস্তব জীবনেও আমরা সর্বদাই এভাবে আলো খুঁজি।

একসময় দেখি ফানুসের আলোয় ঝলমলিয়ে উঠছে ওদের মুখগুলো!

পথশিশুরা হাসছে, এই দৃশ্যের চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়, এই দুঃখ কষ্টে ভরা পৃথিবীটা হঠাৎ করে স্বর্গ হয়ে গেছে। আহা, জীবন কত সুন্দর!

লেখক : শাইলা পারভীন সুমা
shailashoma@gmail.com

Similar Posts

error: Content is protected !!