মাহমুদ আল আজাদ, হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ।।
ঘাতক মুন্নার স্বীকারোক্তি ৮ম শ্রেণীর স্কুলছাত্রী তাসনিম সুলতানা তুহিনকে (১৩) ধর্ষণ করে গলাটিপে হত্যা করেছে। গতকাল (১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮) গ্রেফতারের পর থানা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় শাহ নেওয়াজ মুন্না তার কুকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্যের বিবরণ দেন।
সূত্রে জানা যায়, নিহত তুহিনের সাথে মুন্নার দীর্ঘ ৭-৮ মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক হয়। এরই মাঝে একে অপরের প্রতি গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তুহিনের বাবা-মা যখন বাসার বাইরে যেত বা রাতে ওই ভবনের ছাদের উপর দু’জনেই একত্রিত হয়ে অন্তরঙ্গে জড়িয়ে যেত। তুহিনের বাবা-মা পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্যেশে এখন সৌদি আরব অবস্থান করছেন। তারা আগামী বুধবার দেশে আসার কথা রয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা যায়।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়ার জন্যে নানুর বাসা থেকে বের হয়ে ঘাতক মুন্নার বাসায় চলে যায়। সেখানে তারা দু’জনই অবৈধ মেলামেশা করে। এক পর্যায়ে স্কুলছাত্রী তুহিন মুন্নাকে বলে বাবা-মা এই সপ্তাহ দেশে চলে আসবে। তুমি আমাকে অন্যত্র কোথাও নিয়ে যাও। তাদের মধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে তুহিন রেগে চিৎকার দিয়ে কথা বললে মুন্না রেগে গিয়ে প্রথমে তার (তুহিনের) মুখ চেপে ধরে এক হাতে। অপর হাতে পিছনের ঘাড় ধরে মুখমণ্ডলসহ চেপে ধরলে তুহিনের শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায় বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেন। তার সাথে প্রায় ৫/৬ বারের বেশি অবৈধ শারীরিক মেলামেশার ঘটনা ঘটেছে বলেও ঘাতক মুন্না জানান।
এদিকে তুহিনের বড়ভাই মোঃ আকিব জাবেদ বাদী হয়ে শাহ নেওয়াজ মুন্নাসহ তার মা নিগার সুলতানা ও পিতা পল্লী চিকিৎসক শাহজাহান সিরাজকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ২৫। তবে মুন্নাকে আটক করলেও বাকি ২ আসামি পলাতক রয়েছে বলে থানা সূত্রে জানা যায়। তাদের আটক করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দুপুরে মুন্নাকে থানা পুলিশ আদালতে প্রেরণ করেছেন। নিহত তুহিন ৪ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। গড়দুয়ারা ইউনিয়ন এলাকা থেকে এক বছর ৮ মাস আগে হাটহাজারীর শাহজালাল পাড়াস্থ সালাম ম্যানশনে এসে সপরিবার বসবাস করছে। হাটহাজারীর গার্ড স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার যাত্রা শুরু করে তুহিন।
প্রেমের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে তুহিনের ভাই সাখাওয়াত হোসেন জানান, আমার ছোট বোনটি একদম নম্র, বিনয়ী। তার তেমন কোনো চরিত্র আমাদের চোখে পড়েনি। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। বোনের হত্যাকারীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে দাবি জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাটহাজারী মডেল থানার ওসি বেলাল উদ্দীন জাহাংগীর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, কি কারণে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং উদ্ধার করা লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। আটক মুন্নাকে কোর্টে চালান দেয়া হয়েছে এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। মাললার পলাতক আসামিদের আটক করতে পুলিশের অভিযান চলছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে সোমবার সকাল ১০টার পর চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে নেমে পড়ে নিহত তুহিনের সহপাঠী ও শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের জনতা। তারা প্রথমে মুন্নার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে। পরে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক থেকে কাচারী সড়ক হয়ে খাগড়াছড়ি রামগড় সড়কে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনে গিয়ে শেষ হয়। এসময় দুই পার্বত্যজেলা রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সহ ২২টি সড়কে আনুমানিক ২ঘণ্টা পর্যন্ত কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়নি। এতে করে ২২টি সড়কের হাজার হাজার যাত্রীসাধারণ চরম দুর্ভোগে পড়তে দেখা যায়। এ যানজট নিরসন করতে চরম বেগ পেতে হয়েছে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের। দুই ঘণ্টা সময় ধরে এ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হতে বক্তাদের একটি বক্তব্য তা হল ঘাতক মুন্নার ফাঁসি, মাদক ও ইয়াবা বন্ধ করার দাবি জানান এ মানববন্ধন থেকে। মাদকাসক্ত এই ঘাতক মুন্নার ফাঁসির দাবিতে হাটহাজারীর সর্বস্তরের জনসাধারণ ও বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে মিছিলে মিছিলে এ মানববন্ধনে যোগ দিতে দেখা যায়।

সোমবার সকাল এগারোটায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি ঘটনাস্থলের বিভিন্ন লোকেশন ও হত্যাকাণ্ডের স্থান সুরতহাল তৈরি করেন। এসময় ইন্সপেক্টর অব পুলিশ মোঃ আবদুর রাজ্জাক প্রতিবেদককে জানান, আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসেছি। ঘটনার বিবরণসহ হত্যাযজ্ঞের আলামত সংগ্রহ করেছি। সুষ্ঠু তদন্ত করে আমরা ঘটনার রহস্য বের করবো।
অপরদিকে পুলিশের চরম অবহেলার কারণে হাটহাজারীর আনাচে-কানাচে বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকহারে মাদক, ইয়াবা নেশা ও ব্যবসা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অলি-গলিতে ইয়াবা যেন মহা হাট-বাজার বসে। পুলিশের এই অবহেলার কারণে হাটহাজারী মডেল থানা থেকে তিনজন পুলিশের এসআই’কে অন্যত্র বদলী করার ঘটনাও ঘটেছে। এরপরেও ইয়াবা ও মাদকের ব্যবসা দিনদিন রমরমা আকার ধারণ করেছে। ইয়াবাসক্ত ঘাতক মুন্নাসহ আরো বেশ কয়েকজন শাহ জালালপাড়া এলাকায় মাদক ও ইয়াবা ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। রাজনৈতিক চত্রছায়ায় এ ধরনের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যায় বলে এলাকার সুশীল সমাজের দাবি।
গত সোমবার ঘাতক মুন্নাকে আদালকে প্রেরণ করা হয়। উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়নস্থ আছরের নামাজের পর তুহিনের জানাযার নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে তার ভাই শাখাওয়াত গণমাধ্যম কর্মীদের জানান।