বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল শুধু নদী ও বন্যার গল্পে সীমাবদ্ধ নয়; এখানে লুকিয়ে আছে শত বছরের জীবিকা ও সংগ্রামের অনন্য ইতিহাস। একসময় গোবরের লাকড়ি, খরস্রোতা নদীতে জেলেপেশা, কিংবা মৌসুমি কৃষিকাজ—এসবের ভেতরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো মানুষের জীবনযাত্রা। আধুনিকতার ঢেউয়ে অনেক পেশাই আজ বিলুপ্তপ্রায়। সেই হারানো ঐতিহ্য ও টিকে থাকা সংগ্রামের গল্প নিয়ে শুরু হয়েছে নিকলীকেন্দ্রিক প্রথম অনলাইন সংবাদমাধ্যম “আমাদের নিকলী ডটকম”-এর ধারাবাহিক ফিচার প্রতিবেদন—“হাওরাঞ্চলের ব্যতিক্রমী জীবিকা”। আজ থাকছে “ঢেউয়ের গর্জনে লেখা এক জীবনসংগ্রামের গল্প”
মোহাম্মদ তোফায়েল আহছান ।।
দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি—যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। যেন সীমাহীন কোনো প্রান্তর। বলছি কিশোরগঞ্জের নিকলী, অষ্টগ্রাম আর মিঠামইনের মাঝের সেই বিশাল হাওরের কথা। বর্ষার শুরুতে এই হাওর ভরে ওঠে থইথই পানিতে, রূপ নেয় এক অজানা সমুদ্রে। নিকলীর পূর্ব সীমান্তে দাঁড়িয়ে তাকালে যেন কক্সবাজারের সৈকতে দাঁড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ দেখা—একই রকম বিশালতা, একই গর্জন, একই শিহরণ।
কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওর বাংলাদেশের বৃহৎ অভ্যন্তরীণ জলাভূমিগুলোর একটি। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিলো বর্ষা মৌসুমে প্রবল ঢেউ ও জলচ্ছ্বাসের প্রভাব—যা শুধু বসতবাড়ি নয়, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, এমনকি মসজিদ-মন্দিরকেও হুমকির মুখে ফেলতো।
এই অঞ্চলের নদীপ্রবাহ ও বর্ষার পানি বৃদ্ধির কারণগুলো ভৌগোলিক ও আবহাওয়ার সঙ্গে যুক্ত। জলস্তর ঊর্ধ্বমুখী হলে ঢেউ গড়ে ওঠে যা ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনার ওপর প্রখর অভিঘাত ফেলে। অতীতের প্রতিবছর বন্যার রিপোর্টগুলো থেকে দেখা যায়, বর্ষাকালীন প্রতিটি পরিবার গড়ে দুই থেকে তিনবার বাড়ি মেরামতের প্রয়োজন অনুভব করতো।
বর্ষাকালে হাওরের ঢেউ শুধু প্রকৃতির খেলা নয়, ছিল মানুষের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। দিনের শেষে যখন রাত নামে, তখন হাওর পাড়ের গ্রামগুলো ঢেউয়ের গর্জনে কেঁপে উঠত। অন্ধকার রাতের ভেতর সেই গর্জন যেন মৃত্যুর আহ্বান। ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, শস্যভাণ্ডার—সবকিছু হারানোর ভয় ঘিরে রাখত মানুষকে।
ধনবান কিছু পরিবার পাকা দেয়াল তুলে নিজেদের ঘরবাড়ি রক্ষার চেষ্টা করতেন; কিন্তু হাওরাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই গরিব। তারা বানাতেন তুলনামূলক দুর্বল প্রতিরক্ষা বেড়া—সারিবদ্ধ বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে বাঁশের চটা বেঁধে তৈরি করতেন প্রতিরক্ষা প্রাচীর। সেই বেড়া আর মাটির মাঝখানে ভরাট করা হতো ধানের খড়, কচুরিপানা আর এক বিশেষ প্রজাতির ঘাস—ছাইল্লা। স্থানীয়রা বিশ্বাস করতেন, ছাইল্লা হাওরের ঢেউ মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর। এর গোড়া শক্ত, লম্বাটে শক্ত লতানো এবং আঘাতসহনীয়—তাই ঢেউয়ের অভিঘাত সামলেও টিকে থাকতে পারত দীর্ঘ সময়।
হাওরের ঢেউ থেমে থাকত না। এক একটি মৌসুম শেষে প্রায় প্রতিটি বাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কখনো ঘর ভেসে যেত, কখনো মসজিদ-মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ধ্বংস হতো। ঢেউয়ের বছর শেষে শুরু হতো নতুন যুদ্ধ—স্থাপনা মেরামতের।

এই টিকে থাকার সংগ্রামের ভেতরেই জন্ম নেয় এক বিশেষ কাজ বা পেশা—ছাইল্লা, খড় ও কচুরিপানা সংগ্রহ এবং বিক্রি। এই কাজই কারও জীবিকা, কারও দায়িত্ব, কারও সাহসের প্রতীক। প্রবল ঢেউ ঠেলে দূর-দূরান্ত থেকে খড়, কচুরিপানা এবং ছাইল্লা সংগ্রহ করে নৌকায় ভরে আনা সহজ কাজ ছিল না। মাঝে মধ্যে নৌকা উল্টে মালামাল ভেসে যেত, এমনকি প্রাণহানির শঙ্কাও থাকতো। তবু জীবন থেমে থাকত না।
প্রতিটি নৌকায় থাকত সাধারণত তিনজন মাঝিমাল্লা—একজন পেছনে দাঁড়িয়ে বৈঠা চালিয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন, আর বাকি দুজন লম্বা বাঁশের ছইর (লগি) দিয়ে নৌকাকে ঠেলে এগিয়ে নিতেন। ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে তারা দিতেন প্রাণপণ চেষ্টা, যেন পণ্যভর্তি নৌকা নির্দিষ্ট গন্তব্যে, নিরাপদে পৌঁছায়।
এই কাজ বা পেশাকে ঘিরেও ছিল রকমফের। ছোট ও বড় দুই আকারের নৌকা ছিল—নৌকার আকার ও পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হতো। অনেক সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী বেশি দাম হাঁকাতেন। কিন্তু ঢেউয়ের তীব্রতায় ঘরভাঙা মানুষজন অনেক সময় বাধ্য হয়েই সেই দামে কিনে নিতেন ছাইল্লা এবং কচুরিপানা; কারণ তাদের কাছে সেটি ছিল তাৎক্ষণিক ধ্বংসের হাত থেকে সবকিছু রক্ষা করার অন্যতম অবলম্বন।
স্বল্প সময়ের এই কাজ বা পেশাটি ছিল একেবারে ভিন্নধর্মী, মৌসুমভিত্তিক একটি কাজ—যাকে কেউ কেউ পেশা বলতেন। কেউবা জীবনের প্রয়োজনে বেছে নেওয়া সংগ্রামের পথ। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই এই পেশার চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যেত। কারণ, তখন ঢেউয়ের ভয় ছিল ঘরে ঘরে। হাওরের পানির তোড়ে বেড়া, ঘায়েল বা নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙে গেলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ত। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, স্থাপনা নিমিষেই বিলীন হয়ে যেত। ঢেউ থেকে রক্ষার্থে তখনই দরকার হতো খড়, কচুরিপানা আর ছাইল্লার মতো উপকরণ।
এই কাজের মাধ্যমে একদিকে ক্রেতারা স্বস্তি পেতেন—তাদের আলাদা করে দূরে গিয়ে উপকরণ খোঁজার প্রয়োজন হতো না; স্থানীয় বিক্রেতারা ঝুঁকি নিয়ে সব সংগ্রহ করে নিয়ে আসতেন। ব্যাপারটা এমন ছিল, যেন “ভাসমান বাজার বা হাট”। অন্যদিকে, যারা এই কাজ করতেন—তারা ছিলেন হাওরের খেটেখাওয়া মানুষ। চাষাবাদ বা অন্য মৌসুমে যাদের তেমন আয়-রোজগার থাকতো না, এই সময়টিতে তারা সামান্য হলেও অতিরিক্ত উপার্জনের সুযোগ পেতেন।
এভাবে হাওরের এই মৌসুমী কাজ বা পেশা এক ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক গড়ে তুলতো—প্রকৃতির ভয়াবহ ঢেউয়ের মাঝেও একে-অপরের প্রয়োজন হয়ে ওঠা। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই জানতেন, একে ছাড়া অন্যজনের চলবে না। এই সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক ছিল না; ছিল মানবিক সহায়তা, সহমর্মিতা আর টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতীক।

নৌকা, পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রির প্রক্রিয়া
কচুরিপানা : এই মৌসুমী কাজ বা পেশার মূল সরঞ্জাম ছিল কচুরিপানা, ছাইল্লা এবং ধানের খড়। কচুরিপানা একটি ভাসমান বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ, যা খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে (প্রায় দুই সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়)। এই উদ্ভিদটি সারা বছরই স্থানীয় বদ্ধ জলাশয়গুলোতে বিদ্যমান থাকে।
বর্ষাকালে যখন হাওরগুলো বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়, তখন উজান থেকে নেমে আসা পানি এবং স্থানীয় নদ-নদীর প্রবাহ বেড়ে যায়। এই পানি প্রবাহের সাথে কচুরিপানাগুলো বিশাল হাওরের দিকে ভেসে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে। ছড়ানো-ছিটানো কচুরিপানা সংগ্রহ করাও একটি কঠিন কাজ। যারা নৌকা চালনায় বিশেষ পারদর্শী এবং কর্মঠ, তারা এই কাজটি করতেন। কেউ নিজের প্রয়োজনে সংগ্রহ করতেন, কেউবা বিক্রি করে উপার্জনের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করে রাখতেন।
বর্ষাকালে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে কচুরিপানা উজান থেকে ভেসে আসা, স্থানীয় জলাশয়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা এবং নদ-নদী থেকেই সংগ্রহ করা হয়। হাওরাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় বর্ষাকালে গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও কচুরিপানা ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি ঢেউয়ের আঘাত থেকে ভিটে-মাটি রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ছাইল্লা : হাওরাঞ্চলের চরভূমির অনাবাদি জমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে এক বিশেষ জাতের শক্তপোক্ত ঘাসজাতীয় লতা, যার স্থানীয় নাম “ছাইল্লা”। দেখতে এটি অনেকটা দুর্বা ঘাসের মতো হলেও গঠনগতভাবে আরও মোটা, লম্বা ও দৃঢ়। সাধারণত প্রাকৃতিকভাবেই এই ঘাস জন্মে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে হাওরপাড়ের মানুষ কখনও কখনও চরভূমিতে বাণিজ্যিক ভাবনা থেকেও এর চাষ করেন। ছাইল্লা ঘাস গোখাদ্য হিসেবেও মাঝে মাঝে ব্যবহৃত হয়, তবে এর প্রধান ব্যবহার হতো বর্ষাকালে প্রতিরক্ষা প্রাচীর বা ঘায়েল নির্মাণে। যখন প্রখর ঢেউয়ের আঘাতে হাওরের চরভূমি, বসতভিটা ও ঘরবাড়ি ভাঙনের মুখে পড়তো, তখন ছাইল্লা ঘাসের মোটা ও টেকসই গাঁটগুলো ব্যবহার করা হতো প্রতিরোধক বাঁধ তৈরিতে। এতে ঢেউয়ের ধাক্কা কিছুটা শোষিত হতো এবং ভূমি ও ঘরবাড়ি রক্ষা পেত।

বর্ষাকাল আসার আগে হাওরপাড়ের বহু পরিবার ছাইল্লা ঘাস সংগ্রহ করে মজুত রাখতেন প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরির প্রয়োজনের কথা ভেবে। অন্যদিকে যারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেন, তারা বর্ষা আসার আগে ঘাস কেটে উঁচু ভূমিতে স্তূপ করে রাখতেন। বর্ষা শুরু হলে সেই ঘাস তারা বিক্রি করতেন—কখনও গোখাদ্য হিসেবে, আবার কখনও ঘায়েল নির্মাণে ব্যবহারের জন্য। এইভাবে ছাইল্লা শুধু হাওরের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যেরই অংশ নয়, বরং বর্ষাকালীন জীবনের নিরাপত্তা ও জীবিকায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
খড় বা খের : বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ধান কাটার পর ধানগাছ শুকিয়ে রেখে যে খড় পাওয়া যায়, তা হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনে বহুমুখীভাবে ব্যবহৃত হয়। শুকনো এই ধানের খড় বা খের বর্ষা মৌসুমে গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শুধু গোখাদ্য নয়, হাওরপাড়ের মানুষ এটি দিয়ে ছোট ঘরের চাল বা ছাউনি তৈরি করে থাকেন। খড়ের স্তর দিয়ে তৈরি এসব ছাদ বৃষ্টি ও রোদ দুই-ই সামলে রাখে। এছাড়া বর্ষাকালে যখন প্রখর ঢেউয়ের আঘাতে হাওরের বসতভিটা ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিতো, তখন মানুষ ঘায়েল বা প্রতিরক্ষা প্রাচীরে এই খড়ও ব্যবহার করতো।
সড়কপথে পণ্য পরিবহন বর্ষাকালে দুষ্কর ছিল। তাই বাহন হিসেবে ছিলো নৌকা। প্রতিটি নৌকার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ হাত, যা তিনজন মাঝিমাল্লা নিয়ে চালাতেন। তারাই পরস্পর এই কাজ, ব্যবসা বা পেশার যৌথ মালিক। নৌকার আকার এবং ভরাট পণ্যের পরিমাণ অনুযায়ী দাম নির্ধারিত হতো।
কচুরিপানা বিক্রি হতো প্রতি নৌকা ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, ছাইল্লা ভর্তি নৌকা বিক্রি হতো ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকায় এবং ধানের খড় বা খের বিক্রি হতো প্রতি মণ ৪০ টাকায়। মূল্য নির্ধারণে আবহাওয়া এবং হাওরের পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। উত্তাল জলপ্রবাহ বা আফাল শুরু হলে বিক্রেতারা স্বাভাবিক মূল্যের তুলনায় কিছুটা বেশি দাম হাঁকাতেন। কারণ তখন ক্রেতারা বাধ্য হয়ে কিনতেন—ঢেউয়ের সংস্পর্শ থেকে ঘর রক্ষার জন্য বিকল্প উপায় কম থাকত। দ্বিতীয়ত, পণ্যভর্তি নৌকা নিয়ে গ্রাহকের দোরগোড়ায় পৌঁছা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল।
নৌকা চালিয়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি খুব সহজ ছিল না, বর্ষায় প্রকৃতির সঙ্গে এক রকম যুদ্ধ করতে হতো। প্রচণ্ড ঝড় বা আফাল শুরু হলে এলাকাগুলোতে এসব পণ্য নিয়ে যাওয়াটা মাঝিমাল্লাদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তিনজন মাল্লার সবাইকে শক্তহাতে কৌশলী হয়ে নৌকাটি বেয়ে নিতে হতো। কখনো ঢেউয়ের দাপটে নৌকা কম্পিত হলেও থামার সুযোগ ছিল না। উল্টে গিয়ে পণ্য হারানো, নৌকা হারানোসহ প্রাণহানির শঙ্কাও থাকতো।
এই কাজ বা পেশা একদিকে মানুষের ঘর রক্ষায় সাহায্য করত, অন্যদিকে হাওরের স্বল্প আয়ের পুরুষদের জন্য একটি মৌসুমী উপার্জনের পথ খুলে দিত। পণ্য, নৌকা ও মানবশক্তি—সবকিছু একত্রে মিলিয়ে গড়ে উঠত বর্ষার এক অভিনব অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা।

ছাইল্লা-কচুরিপানা ক্রেতা-বিক্রেতার স্মৃতিকথা
মো. শহিদুল ইসলাম (ক্রেতা) : আমার বাড়িটা একেবারে পানির ধার ঘেঁষে। আফাল (ঝড়, তুফান) ছুটলেই ঢেউয়ে ঘায়েল চুরমার করে পানি ঢুকে যেত। তাই বর্ষা শুরুর আগে কিছু খের আর দল (কচুরিপানা) কিনে রাখতাম। কোনো বছর বর্ষার আগে কিনে রাখাগুলায় হইতো। আবার কোনো কোনো সময় বড় ধরনের বন্যা হইলে তখন আবার নৌকা আসলে ছাইল্লা কিনতাম। দাম একটু বেশি হলেও কিনতেই হতো। সময়মত মেরামত না করলে ঘরবাড়ি বাঁচানোই দায় হয়ে যেত।
জালাল উদ্দিন (ক্রেতা) : ছাইল্লা দিলে ঘায়েলটা একটু বেশি পোক্ত হয়। ঢেউ যতই জোরে লাগুক, ছাইল্লা টিকে থাকে বেশি সময়। তাই আমরা যখনই ছাইল্লা পেতাম, প্রয়োজনমতো কিনে রাখতাম। এছাড়াও বর্ষার শুরুতে আরও কিছু কিছু জিনিস একটু বেশি করে কিনে রাখতাম, যেন হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি না করতে হয়। তবে তুফান শুরু হলে যখন ঘায়েল তছনছ হয়ে যায়, তখন জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যায়; কিন্তু বিক্রেতারাও তো অনেক কষ্ট করে নিয়ে আসতো। তাই তর্ক না করে নিয়ে নিতাম। আমারও দরকার, তারও দরকার।
হাফিজুল মিয়া (ক্রেতা) : ঢেউ উঠলে ঘর রক্ষা করা মানে যুদ্ধ করা। দিনে যেমন-তেমন, রাতে ঢেউয়ের শব্দে ঘুম হতো না। সারাক্ষণ ভয়, কখন কী ভাসায়া নিয়া যায়। টর্চ লাইট, হারিকেন জ্বালিয়ে একটু পরপর চেক করা লাগতো, কোনো দিকে আবার খোলাসা হয়ে গেছে কিনা। এই কাজ না করলে সকালে দেখতাম সব ওলট-পালট হয়ে গেছে।
আব্দুল খালেক (বিক্রেতা) : ঢেউ যখন ওঠে, তখন হাওরে যাওয়া মানেই নিজের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। তবু তখন আমরা জীবিকার টানে বের হতাম। কারণ, দল (কচুরিপানা), ছাইল্লা আনলে লোকজন ঘায়েলে দিলে ঘরবাড়ি বাঁচাতে সাহায্য হইতো। ছাইল্লা দিয়া আমরা নৌকা ভরি, তারপর ঢেউ ঠেলে এলাকায় এদিক-ওদিক ঘুরতাম। মাঝে মাঝে দলও (কচুরিপানা) বিক্রি করছি। যখন যার দরকার, ইশারা দিয়ে ডাকলে ঘাট করতাম। দরদাম মিললে ঢেলে দিয়ে আসতাম। এই আসা-যাওয়ায় কখনো নৌকা উল্টে যেত। মাল ভেসে যেত—তবু পরে আবার নামতে হতো। কারণ, এই কাজ করে সংসার চালানোর জন্য অতিরিক্ত কিছু আয় করা যেত। বিপদগ্রস্ত মানুষেরাও সহজে কিছুটা অবলম্বন খুঁজে পেত।
নূর হোসেন (বিক্রেতা) : আমরা তিনজন মিলে একটা নৌকা চালাইতাম। কাজটার মতো উপার্জনটাও সমানভাবে ভাগ করে নিতাম। ঢেউয়ের সময় নৌকা সামলানো খুব কঠিন। অনেক সময় বাতাসে নৌকা দুলতে দুলতে উল্টাইয়া যেত; তবু দল আর ছাইল্লা নিয়ে আসতাম। ছাইল্লাটা আমরা বর্ষা শুরুর আগেই চর এলাকা থেকে সংগ্রহ করে বাড়ির আঙিনায় স্তূপ করে রেখে দিতাম। কারণ বর্ষাকালে বা বন্যা হলে এগুলোর চাহিদা বাড়ে। দাম একটু বাড়লেও মানুষ কিনে নিতো। অনেকদিন যত্ন করে রেখে দিলেও তখন পুষায়া যেত।
আবুল কাসেম (বিক্রেতা) : বন্যার সময় ছাইল্লা, খেরের দাম ঠিক থাকতো না। আবহাওয়া খারাপ থাকলে দাম বেড়ে যেত। কেউ কেউ ভাবে আমরা সুযোগ নিতাম; আসলে তখন আমাদের কিনা লাগতো বেশি দামে, বেচতামও মিলমিশ কইরা। ঢেউয়ের মধ্যে নৌকা চালানো, মালামাল ভাসানো, আবার তা বাঁচানো—সবই ঝুঁকির কাজ। তবু মানুষ যেন ঘর বাঁচাতে পারে, সেই চিন্তা করেই আমরা কাজটা করতাম। আমরাও কিছু বাড়তি আয় করতাম।
হাওরের এই ঢেউ আর মানুষের সহাবস্থান কেবল সংগ্রামের গল্প নয়—এটি জীবনের গল্প। যেখানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে প্রতিদিনের লড়াইয়ের ভেতরও ছিল সহযোগিতা, সাহস, আর এক ধরনের অদম্য মানবিকতা। কেউ নিজের ঘর রক্ষায় ব্যস্ত, কেউ আবার প্রতিবেশীর ঘর ভাঙা আটকানোর জন্য ছুটে আসে। হাওরের এই বন্ধন, এই সহমর্মিতা আজও কিশোরগঞ্জের জলরাশি আর মানুষের বুকে অম্লান হয়ে আছে।

নিকলীর বেড়িবাঁধ : মৌসুমী পেশার বিলোপ ও নতুন সম্ভাবনার গল্প
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পূর্বদিক বরাবর বিস্তৃত সেই হাওরপাড় আজ আর তেমন ভয়াবহ ঢেউয়ের অভিঘাতে কাঁপে না, যেমনটা একসময় কাঁপাতো। ২০০০ সালের দিকে সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি শক্তিশালী বেড়িবাঁধ, যা আজও ঢেউয়ের প্রচণ্ডতা রোধে এক নিরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
এই বেড়িবাঁধ নির্মাণের আগে নিকলীর পূর্ব সীমান্তের হাওরপাড়ের জীবন ছিল চরম অনিশ্চয়তার নাম। বর্ষা এলেই ভয়াল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত ঘরবাড়ি আর আঙিনায়। একেকটা মৌসুম শেষে বহু পরিবারকে দেখা যেত নতুন করে ঘর বাঁধতে, বেড়া তুলতে, জীবন শুরু করতে। কিন্তু বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর সেই ভয়াল সময় যেন ইতিহাস হয়ে গেছে। এখন বর্ষার জল আসে, ঢেউও ওঠে—কিন্তু তা আর মানুষের ঘরবাড়ি গিলে নিতে পারে না। সব ঝড়-ঝাপটা সামলে নেয় বেড়িবাঁধ।
বেড়িবাঁধটি শুধু ঢেউ প্রতিরোধেই কার্যকর নয়, এটি নিকলীর জনজীবনে এক নতুন পরিবর্তনের সূচনা করেছে। বেড়িবাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছিল লোকালয় থেকে একটু দূরত্ব রেখে। আগে বেড়িবাঁধের ভেতরের নিচু যে জমিগুলো বর্ষায় পানির নিচে তলিয়ে যেত, বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে এখন সেখানে ক্রমে গড়ে উঠছে স্থায়ী বসতি। বেড়িবাঁধের আশেপাশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আবাসিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ছোটখাটো বাহারি ব্যবসা-বাণিজ্য।
এই বেড়িবাঁধকে ঘিরেই এখন তৈরি হয়েছে একটি নতুন পর্যটন কেন্দ্র। বর্ষার মৌসুমে যখন হাওর পূর্ণজলে ভরে ওঠে, তখন দেশ-বিদেশের লাখো পর্যটক নিকলী আসেন হাওরের সৌন্দর্য দেখতে। বেড়িবাঁধের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখা, কিংবা ট্রলারে চড়ে হাওরের বুক চিরে ভ্রমণ করা—এগুলো এখন নিকলীর নতুন পরিচয় হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী, বর্ষাকালে প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার পর্যটক বেড়িবাঁধ এলাকায় ঘুরতে আসেন। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে; কেউ আবার ফটোগ্রাফি কিংবা প্রামাণ্যচিত্র ধারণের উদ্দেশ্যে। নিকলীর মানুষ বলছেন, একসময় এই বেড়িবাঁধ ছিল শুধুই ঢেউ ঠেকানোর উপায়—ধীরে ধীরে এখন তা হয়ে উঠেছে হাওরের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও সম্ভাবনার প্রতীক।
লেখক: সংবাদমাধ্যম কর্মী


