রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা ।।
৩০ বছর আগে প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দৈনিক এক টাকা ফি নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। আর তখন থেকেই তিনি পরিচিতি পান ‘এক টাকার মাস্টার’ নামে। এক টাকার মাস্টার নামে পরিচিত লুৎফর রহমান (৬৬) নামের এই শিক্ষকের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামে। তার এই শিক্ষকতা শুরু হয়েছিল গ্রামের দরিদ্র শিশুদের বিনাপয়সায় পড়ানোর মধ্য দিয়ে।
লুৎফর রহমানের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আদিবাড়ি ছিল ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া গ্রামে। তার বাবার প্রায় ৯০ বিঘা জমি ছিল। ১৯৭০ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন লুৎফর রহমান। এরপর স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুদিন।
সেখানে জমিজমা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আশ্রয় নেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের ডাকাতিয়া গ্রামে। নদী ভাঙনের ফলে সেখানেও ঠাঁই হয়নি তার। এরপর আশ্রয় নেন একই ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামে। আজ অবধি সেখানেই আছেন তিনি। এখানে তিনশতক বসতভিটায় একচালা টিনের ঘরে বসবাস করেন।
পারিবারিক সূত্র আরও জানায়, উড়িয়ার স্থানীয় একটি স্কুলে যখন শিক্ষকতা শুরু করেন তখন স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। গ্রামের যে শিশুরা স্কুলে যেত না, তাদেরকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বিনাপয়সায় পড়ানো শুরু করেন তিনি। ক্রমান্বয়ে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে হেঁটে তিনি তাদেরকে বিনাপয়সায় পড়ান। সেই থেকেই শুরু।
বাগুড়িয়া গ্রামে তিনি এসেছেন ১৯৮৭ সালের দিকে। এখানে এসেও তার এই বিনাপয়সার পাঠদান অব্যাহত রাখেন। ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর কারণে অভিভাবকরা তার আর্থিক অবস্থার দিক বিবেচনা করে তাকে প্রতিদিন এক টাকা করে দিতেন। আর সেই থেকেই তিনি এলাকায় পরিচিতি পান এক টাকার মাস্টার নামে। বর্তমানে তার সাংসারিক দিক বিবেচনা করে অভিভাবকরা দৈনিক পাঁচ টাকা করে দিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে বাগুড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, লুৎফর রহমানের পাঠদানের চিত্র। গ্রামটির ভেতর দিয়ে নির্মিত ব্রক্ষ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাঁধের দুই ধারে নদীভাঙা মানুষের বসবাস। বেশিরভাগ মানুষের একচালা টিনের ঘর। লুৎফর রহমান এক বাড়ির আঙিনায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছয় দফায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৬০ জনকে পড়ান তিনি।
তার স্ত্রী লতিফুল বেগম বলেন, তিনি সারাদিন পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যেভাবে পরিশ্রম করেন, সে হিসেবে টাকা পান না। কিন্তু পড়াতে বাঁধা দিলে তিনি মন খারাপ করেন। ওটা তার নেশা। সংসারে অভাব থাকলেও তাকে বাঁধা দেই না।
ছেলে লাভলু মিয়া জানান, বাবা শিক্ষা পাগল মানুষ। শিশুদের পড়িয়ে উনি সুস্থ আছেন। উনি ভালো থাক, সেজন্য আমরা তাকে উৎসাহ দেই।
দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর ধরে শিক্ষার্থী প্রতি এক টাকা ফি নিয়েই পড়াচ্ছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লুৎফর রহমান বলেন, গরিব এলাকা। বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের পড়াতেই চান না। সবচেয়ে বড় কথা, গরিব ও অবহেলিত এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারছি। দিনমজুর, রিকসা-ভ্যান চালকের ছেলে-মেয়েরা তো মানুষ হবে। এটাই আমার স্বার্থকতা। যতদিন সুস্থ থাকবো ততদিন পাঠদান করে যাব।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে পড়াশোনা করে অনেকেই আজ ভালো চাকরি করছে।
বাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম মুঠোফোনে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাকে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে দেখছি। এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম ছুটে চলেছেন তিনি। তার পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীদের সহায়তা হচ্ছে।
সূত্র : ২৭ বছর ধরে মাত্র এক টাকা নিয়ে পড়াচ্ছেন তিনি (জাগো নিউজ, ৩ জুন ২০১৭)