নৌকায় সীল ওপেনে, মেম্বার সীল গোপনে

মো: আল আমিন, বিশেষ প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ) ।।

নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল কটিয়াদীতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোটারেরা নিজের পছন্দে ভোট দিতে পারবেন না। নির্বাচনের আগের রাতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকেরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে আসে ‘যদি নৌকায় ভোট দেয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলে কেন্দ্রে যাবেন, নয়তো কেন্দ্রে গিয়ে লাভ নেই’। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো।
গত বৃহস্পতিবার ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত কটিয়াদী উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের নির্বাচনে প্রায় সবকটিতেই আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ভোট দিতে ভোটারেরা বাধ্য হয়েছেন। অনেক কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা নিজেরাই ভোটারদের হাত থেকে ব্যালট নিয়ে নৌকায় ভোট দিয়েছেন। কিছু কেন্দ্রে বাইরে পাহারায় ছিল পুলিশ ভেতরে গণহারে নৌকায় প্রকাশ্যে সিল মারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিএনপির প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকেরা কেন্দ্রে না থাকায় এ কাজটি হয়েছে বাধাহীনভাবে। গত বৃহস্পতিবার কটিয়াদী উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে সরেজমিন ঘুরে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
সকাল ১০টা। কটিয়াদীর বনগ্রাম ইউনিয়নের ভিটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। কেন্দ্রের মাঠে ঢুকেই চোখে পড়ে নারী ও পুরুষ ভোটারদের লম্বা লাইন। বারান্দায় গিয়ে দেখা হয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আমানউল্লাহ আল মামুনের সাথে। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই তিনি বলেন, ‘এখানে ছবিটবি তোলা যাবে না। ভেতরেও প্রবেশ করা যাবে না। উপরের নির্দেশ এটা। আপনাদের কোনো তথ্যের প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলুন আমি বলবো। আর ভেতরে ভোট সুষ্ঠুভাবেই হচ্ছে।’ পরে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের আরো কয়েকজন সাংবাদিক এলে তিনি কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেন, তবে শর্ত দিলেন ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যাবে না। কেন্দ্রের ৩টি পুরুষ বুথের একটি কক্ষে প্রবেশ করে দেখা গেল সেই ‘সুষ্ঠু  ভোটের’ চিত্র।
সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের হাত থেকে ব্যালট সংগ্রহ করার পর তার সামনেই প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সীল মারতে হচ্ছে ভোটারদের। ভেতরে ২০ জনের মতো আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থক মহড়া দিয়ে  চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করছেন ভোটারদের। তবে সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্যদের ভোট ভোটারেরা কক্ষের গোপন স্থানে গিয়ে মারতে পারছেন। বুথটিতে অবস্থান করা যুবকদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের পোলিং এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তাদের কারো কাছে পোলিং এজেন্ট হিসেবে কোন পরিচয়পত্র ছিল না।

Kishoreganj-Vote-01-04-16
বুথটিতে নৌকার হয়ে ভোট আদায় করতে দেখা যাওয়া যুবকদের মধ্যে মো. কামাল হোসেন সরকার নামে এক যুবক নিজেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দাবি করে সাংবাদিকদের কক্ষ থেকে বের করে দিতে উদ্যত হন। পরে সাংবাদিকরা বেরিয়ে আসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ প্রার্থী কামাল হোসেন মিলনের নিজ কেন্দ্র এটি। নিজ কেন্দ্রে আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া মিলন সমর্থকরা। তাদের চাপ ও প্রভাবের মুখে এখানে বিএনপি প্রার্থী রুহুল আমিন প্রিন্স ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমানের কর্মী-সমর্থকরা ছিলেন একেবারেই কোণঠাসা। ফলে ভোট শুরুর পর পরই কেন্দ্রটি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের দখলে চলে যায়। বাধাহীন কেন্দ্র দখল করে কেন্দ্রটিতে তারা ভোটারদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে ভোট আদায় শুরু করেন। কেন্দ্রটিতে আধ ঘন্টারও বেশি সময় অবস্থান করে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর নৌকা প্রতীকে এভাবেই প্রকাশ্যে ভোট আদায়ের চিত্র দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে প্রিসাইডিং অফিসার আমানউল্লাহ আল মামুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, পোলিং এজেন্টদের কোন পরিচয়পত্র দেয়া হয়নি। তাই তারা পরিচয়পত্র ছাড়াই দায়িত্ব পালন করছেন। কেন্দ্রটিতে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট নেয়া হচ্ছে দাবি করে প্রকাশ্যে ভোট আদায়ের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।

সকাল পৌনে ১১টা। একই ইউনিয়নের শিমুহা দিঘীরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। কেন্দ্রটিতে ঢুকেই একটি কক্ষে দেখা গেল ২০/২২ বছরের এক যুবক সহকারি প্রিসাইডিং অফিসারের টেবিলে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল মারছেন। ক্যামেরা তাক করতেই তিনি বললেন, ভাই আন্দাজি ছবি তুইলেন না, একজন বুড়া মানুষ ভোট দিতে পারছিলেন না, তাই এই ব্যালট রেখে গেছেন। উনি বলে গেছেন নৌকায় সিল মারতে তাই সিল মারলাম। এ কেন্দ্রে  ভোট ফেরত ভোটারদের সঙ্গে কথা হলে বেশ কয়েকজন ভোটার জানান, ‘নৌকায় সীল ওপেনে, মেম্বার সীল গোপনে’ এই সিস্টেমে তাদের ভোট দিতে হয়েছে। এর আগে সকাল ৯টার দিকে বনগ্রাম আনন্দ কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্রটির ৬টি বুথেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ৬ জন পোলিং এজেন্ট পাওয়া গেলেও বিএনপি প্রার্থীর মাত্র ২জন এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর একজন পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, সরকারদলীয় প্রার্থীর লোকজন তার পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রে যেতে দেয়নি। তবে প্রিসাইডিং অফিসার শেখ মো. আবুল বাশার জানান, কেন্দ্রটিতে বিএনপি প্রার্থী ৫জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান একজন পোলিং এজেন্ট দিয়েছেন। দুপুর সোয়া বারোটায় মসুয়া ইউনিয়নের মসুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়। বিদ্যালয়ের মূল গেটে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছেন  নৌকা ব্যাচ পড়া বেশ কয়েকজন তরুণ। বাইরে শত শত ভোটারের ভীর। হাফিজ উদ্দিন নামে এক ভোটার জানান, তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না আওয়া মী লীগের লোকজন। মাঠে প্রবেশ করে দেখা গেল শ দুয়েক লোক। প্রায় সবারই নৌকার ব্যাচ লাগানো। ভোট কেন্দ্র গিয়ে প্রকাশ্যে সিল মারা চোখে পড়েনি। এলাকাবাসীর সাথে কথা হলে জানান, এখানে প্রকাশ্যে ভোটের দরকার কি। ভেতরে তো সবাই আওয়ামী লীগের। বাকিরা তো মাঠেই ঢুকতে পারেনি।
দুপুর সাড়ে ১২টা। কেন্দ্র পং মসুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মুষলধারে বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নেমেই এ প্রতিনিধিসহ সাংবাদিকেরা তিনটি কক্ষে ভাগ হয়ে  ঢোকে। বৃষ্টির কারনে সবগুলো বুথে কক্ষের দরজা জানালা বন্ধ। ভেতরে গিয়ে দেখা গেল প্রতিটি কক্ষেই গিজগিজ করছে লোকজন। বিদ্যুত নেই। মোমবাতি জ্বালানো। তিনটি কক্ষেই সবাই যে যার মতো প্রকাশ্যে টেবিলে নৌকায় সিল মারছে। এ যেন সিল মারার উৎসব। প্রিসাইডিং অফিসারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুত নেই, প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে কিছুটা এলোমেলো অবস্থা হয়েছে। নাম জিজ্ঞেস করলে প্রিসাইডিং অফিসার তার নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
দুপুর দুইটা ৪০ মিনিট। কেন্দ্র সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম পুরুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রচণ্ড বৃষ্টির কারণে গাড়ি মূল সড়কে রেখে কাদা রাস্তায় হেঁটে এ প্রতিনিধিসহ আরেকজন সংবাদকর্মী অনেকটা ভিজেই কেন্দ্রের বারান্দায় গিয়ে ওঠে। বারান্দায় শত শত ভোটার গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো। কয়েকজন পুলিশও দাঁড়ানো। গলায় সাংবাদিক লেখা কার্ড ঝোলানো দেখেই এক পুলিশ কর্মকর্তা এগিয়ে এসে বললো, আপনারা কারা? এখানে কোনো সাংবাদিক থাকতে পারবে না। উপরের নির্দেশ আছে। পরে প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে প্রবেশ করে কুশল বিনিময় করে দুটি বুথ কক্ষে প্রবেশ করে দেখা গেল একই চিত্র।

Similar Posts

error: Content is protected !!