কিশোরগঞ্জের হাওর নিকলীতে গড়ে উঠেছে অতিথি পাখিদের মিলনমেলা। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এখানে নিরাপদে কাটিয়ে আবার উড়ে যায় দূর-দূরান্তের হাওরের জলাশয়ে। হাওর অধ্যুষিত এ অঞ্চল সারাবছরই নানা প্রজাতির পাখপাখালির কোলাহলে থাকে মুখরিত। বিশেষ করে শীতের আগমনের সাথে সাথেই সাইবেরিয়াসহ উত্তরের শীতপ্রধান অঞ্চলগুলো থেকে নানা প্রজাতির হাঁস ও বকজাতীয় জলাশ্রয়ী এবং নানা প্রজাতির স্থলচর পাখির আগমন ঘটে এখানে। এসব জলাশ্রয়ী পাখি সারাদিন হাওরে কাটিয়ে রাতের বেলায় আশ্রয় নেয় বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ কিছু নির্দিষ্ট এলাকায়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কলোনি হলো পুকুরপাড় গোরস্থান ও এর আশপাশের গ্রাম এবং হাসপাতাল রোডের সারি সারি রেন্ট্রি আর কড়ই গাছ। কারপাশা ইউনিয়নের দক্ষিণ কারপাশার গোরস্থান সংলগ্ন গাছ, নানশ্রীর ভিটা, সিংপুর ইউনিয়নের চৌধুরী হাটিসহ আরো বিভিন্ন স্পটে এরা কলোনী করেছে।
জলাশ্রয়ী পাখিগুলো প্রধানত দু’রকমের হয়। হাঁসজাতীয় পাখিগুলো হয় জলচর। এগুলো রাতের বেলায় নির্দিষ্ট এলাকার ঘন বনজঙ্গলের গাছে সময় কাটিয়ে ভোর বেলায় হাজারো কণ্ঠে কোলাহল করতে করতে আর পাখার ‘ছড়াৎ ছড়াৎ’ শব্দ হাঁকিয়ে উড়ে যায় হাওরের জলাশয়ে। সারাদিন বিভিন্ন জলাশয়ে সাঁতরে বেড়ায়। ছোট ছোট মাছসহ নানা রকম পোকামাকড় খেয়ে এরা দিন পার করে দেয়। আবার সন্ধ্যায় দল বেঁধে চলে যায় বনজঙ্গলে। আরেক ধরনের জলাশ্রয়ী পাখি হলো বিচিত্র রকমের বক, গাংচিল ও কাদাখোচাসহ নানা প্রজাতির পাখি। বকজাতীয় পাখিগুলো অগভীর জলাশয়ে দিনের বেলায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে দিয়ে ছোট ছোট মাছ গেলে লম্বা গলা বাড়িয়ে সাপের মত অব্যর্থ ছোবলে মুহূর্তের মধ্যেই মাছটি ধরে ফেলে। বকজাতীয় পাখিগুলোও সারাদিন হাওরের জলাশয়ে মাছ, ব্যাঙসহ নানা রকম পোকামাকড় শিকার করে সন্ধ্যায় ফিরে আসে নির্দিষ্ট বৃক্ষরাজিতে। আর স্থলচর পাখিগুলো জলাশয়ে যায় না। এরা কেবল জনপদ এবং বন বাদারে ঘুরে বেড়ায়।
উপজেলা সদরের কবরস্থানে রয়েছে বেশকিছু পুরনো রেইনট্রি এবং কড়ই গাছ। বেশ কয়েক বছর ধরে এসব গাছে আবাস গড়েছে কয়েক রকমের বকসহ পানকৌরি পাখিরা। শীত একটু বেশি হলে বা ঘন কুয়াশা পড়লে সন্ধ্যা নামার একটু আগেই হাজার হাজার বকের পাল এসে আশ্রয় নেয় এই গোরস্তানের গাছে গাছে। আর পানকৌরিরা আসে সন্ধ্যার পর একটু অন্ধকার নেমে আসলে। হাজার হাজার বকের পাল যখন একটু দূর থেকে বিমানের মতো এসে গাছের ডালে নামে, তখন এক মনোরম দৃশ্যের অবতারণা হয়। পুরো এলাকা জুড়ে শুরু হয় বকের হাজারো কণ্ঠের কোলাহল। এক ধরনের ছোট আকারের বক রয়েছে যেগুলোর পিঠের দিকটি কালো, পেটের দিকটি ধূসর সাদা। এগুলো দিনের বেলায় গাছে সময় কাটায়। সন্ধ্যার আগে যখন বড় বড় সাদা বকের পাল আসে তখন ছোট বকগুলো উড়ে যায় হাওরে। অর্থাৎ, এখানে চলে এক ধরনের আবাসিক পালাবদল।
চারদিক হাওরবেষ্টিত নিকলী উপজেলায় রয়েছে ১০টি নদী, ১৫টি বিল ও অসংখ্য পুকুর ও খাদ্য। এরা জলজ প্রাণী, পোকা মাকড় ও মাছ খায়। এদের বিষ্টায় হাওরে জমির জৈব সারের চাহিদা পূরণ হয়। শুধু তাই নয়, এদের বিষ্টা নদী-বিলের মাছের পুষ্টিও যোগায়।
জানা গেছে, বিভিন্ন স্পটে অসাধু লোকজন পাখিদের উৎপাত করছে। কখনো ফাঁদে ফেলে পাখি ধরছে। তাদের হাত থেকে অতিথি পাখিদের রক্ষা করতে না পারলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
আব্দুল্লাহ আল মুহসীন, নিকলী