প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহার সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয় অনেক আগেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ নানান দিক বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহার বন্ধে (অন্ততপক্ষে বিদ্যালয়ে) চাপ দিলেও কাজে আসছিল না।
শিক্ষার্থীরা মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে এতই বেপরোয়া যে, এক্ষেত্রে নানান যৌক্তিক, অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তারা বরং শিক্ষকদেরই উল্টো চাপ দিতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে শিক্ষকগণও মাঝে মাঝে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাতে শিক্ষক-ছাত্রের মধুর সম্পর্ক কখনো কখনো তিক্ততায় রূপ নেয়।
বিভিন্ন বিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছাত্ররা পড়াশোনা বাদ দিয়ে মোবাইলের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। গেম খেলা, মুভি দেখা, ভিডিও দেখা, গান শোনা থেকে শুরু করে অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নেশায় মাতোয়ারা। এতে করে পড়াশোনার পরিবেশ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি ছাত্ররা বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষক-অভিভাবক পড়েন মহাচিন্তায়।
কিন্তু, যখনই মোবাইল সংস্কৃতি শুরু হলো তখনই এ সিদ্ধান্তের আগে থেকেই অনেক শিক্ষক নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন।
মোবাইল ব্যবহারে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা মনে করে তাদের ভাষায়, “আমরা মোবাইল ব্যবহার করি পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য। আমরা কোথায় কিভাবে আছি তা জানানো ও পরিবারের সাথে যোগাযোগ থাকার জন্য। কোন অসৎ কাজে ব্যবহার করি না।”
একইভাবে মোবাইল ব্যবহার নিয়ে অনেক অভিভাবকের মন্তব্যও শিক্ষার্থীদের মতোই। সেই সাথে উদ্বিগ্নও রয়েছেন অনেক অভিভাবক। যোগাযোগের সুবিধা দেখতে গিয়ে নিজের সন্তানটি কোনো মন্দ নেশায় ঝুঁকে যাচ্ছে কিনা। এ ব্যাপারে তারা সার্বক্ষণিক তদারকির চেষ্টাও করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, মোবাইল ফোন যে পরিমাণ রেডিয়েশন দেয় মাইক্রোওয়েভ ওভেনও সেই একই পরিমাণ রেডিয়েশন দেয়। মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আসলে বিপদজনকের চেয়েও বেশি কিছু। ১৫ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বললে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী ফারেনহাইট বেড়ে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ আরো বেশি। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে তাই মতামত দিয়েছেন, ১৬ বছর বয়সের নিচে কোনো অবস্থাতেই মোবাইল ব্যবহার করা উচিত না।
মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহারের উপায় প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, মোবাইল ফোনে কথা ২০ সেকেন্ডের মধ্যে শেষ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। এর বাইরে প্রয়োজনে একটানা সর্বোচ্চ ৩ মিনিট কথা বলা যেতে পারে। তবে পরবর্তী ব্যবহারের আগে ১৫ মিনিট বিরতি দিতে হবে। এতে এই সময়ের মধ্যে মস্তিষ্কের তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, এখন আমাদের দেশে থাইরয়েডের ক্যান্সার, প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ এবং বন্ধ্যাত্ব আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এর সম্ভাব্য প্রধান কারণ হিসেবে তিনি তুলে ধরেন লোকালয়ে অনিরাপদ উচ্চতায় মোবাইল ফোনের টাওয়ার স্থাপন এবং মোবাইল ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ায় ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি মনে করেন ফেসবুক মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও অহংকারী হতে সাহায্য করে। এটি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এইজন্য তিনি বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের টেলিভিশন ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেট থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে এসব মাধ্যম শিক্ষার্থীদের চিন্তাশীলতাকে নষ্ট করে দেয়।
তিনি ছাত্রছাত্রীদের বেশি বেশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বই মানুষকে চিন্তাশীল করে। নেতৃত্ব অর্জনে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।