ফিটনেসবিহীন নৌযানে নিরাপত্তাহীন হাওরাঞ্চলের যোগাযোগ

আমাদের নিকলী ডেস্ক ।।

নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে হাওরাঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম নৌপথ। সেখানে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ১০ হাজারেরও বেশি ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ নৌযান। এসব ত্রুটিপূর্ণ নৌযান ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করায় অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা।

গত দেড় দশকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলে ৫ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। ফলে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে হাওরের নৌপথ। উপযুক্ত কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে এসব ফিটনেসবিহীন নৌযান বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও সংশিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দাপটের সাথে চলাচল অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে হাওরবাসী ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করার দাবি তুললেও আজ অবধি এ দাবি উপেক্ষিতই রয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তর হাওরাঞ্চলে চলাচল করছে ১০ হাজারেরও বেশি ইঞ্জিনচালিত (কার্গো, ট্রলার) ত্রুটিপূর্ণ নৌযান। ১৯৮৪ সালের নৌযান আইনের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে রাতারাতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্যালো ইঞ্জিন ব্যবহার করে বহু নৌযান বা ট্রলার তৈরি হয়। এসব ত্রুটিপূর্ণ নৌযানে গাঠনিক আদল, যাত্রীদের আসন বিন্যাস ব্যবস্থা, ভারসাম্যের জন্য নৌকায় মালামালের সুষম বণ্টন ব্যবস্থা, নৌযানের আকারের সাথে ইঞ্জিনের অশ্বশক্তির সামঞ্জস্যতা, তাৎক্ষণিকভাবে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ইঞ্জিনে গিয়ারের অপ্রতুলতা, চালকের অদক্ষতা এবং ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মালামাল ও যাত্রী পরিবহনের কারণে গত দেড় দশকে এ অঞ্চলে ৫ শতাধিক নৌ-দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। এক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের চোখের নোনা জলের লবণাক্ততা হাওরের পানি থেকে সরতে না সরতেই আবারও ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা।

এমন অবস্থার পরও দেশের এই বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের নৌপথের কোথাও নেই কোনো উদ্ধার কেন্দ্র। নৌ-দুর্ঘটনা ঘটার পর নারায়ণগঞ্জ কিংবা ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ কিংবা ডুবুরি দল পৌঁছতে পৌঁছতে সময় লেগে যায় ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা। আর এ কারণে হাওরাঞ্চলে সংঘটিত বড় ধরনের নৌ দুর্ঘটনাগুলোতেও উদ্ধারকারী দলের উপস্থিতি কখনো তেমন কাজে লাগেনি।

নৌযান সংশিষ্ট একাধিক সূত্র মতে, গত ১৫ বছরে এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে পাঁচ শতাধিক দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২০০৩ সালের ১২ এপ্রিল শনিবার রাত ৮টার দিকে এমভি শরীফপুর নামে একটি দোতলা যাত্রীবাহী লঞ্চ সিলেটের শেরপুর থেকে কিশোরগঞ্জের চামড়া নৌবন্দরে আসার পথে মিঠামইন উপজেলার অদূরে নাগচিনি নদীতে কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়ে নিমজ্জিত হয়। এ ঘটনায় লঞ্চের ভেতরে ও ছাদে থাকা দুই শতাধিক যাত্রীর প্রায় সবাই লঞ্চের সাথে গভীর পানির নিচে তলিয়ে যায়। পরদিন উদ্ধারকারী দল ২১ জনের লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। টানা ৮ দিন উদ্ধার অভিযান চালিয়ে বিআইডব্লিওটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম নিমজ্জিত লঞ্চ থেকে মাত্র চারটি লাশ উদ্ধার করে ২০ এপ্রিল উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। কিন্তু তখনও অনেক নিখোঁজ যাত্রীর সন্ধানে স্বজনদের দুর্ঘটনাস্থলে ভিড় করতে দেখা যায়। এর মাত্র ৮দিন পর ২১শে এপ্রিল সোমবার ৮২ জন বরযাত্রী নিয়ে এমভি মজলিশপুর নামের একটি লঞ্চ অষ্টগ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জের উদ্দেশে যাওয়ার পথে বিকালে ভৈরবের অদূরে খোনাপাড়া এলাকায় কালবৈশাখীর কবলে পড়ে মেঘনা নদীর গভীরে ডুবে যায়। এ ঘটনায় একই পরিবারের ১০ জনসহ মোট ৪৯ জন বরযাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। বাকি ৩৩ জন যাত্রী কোন রকমে সাঁতরে মেঘনা পাড়ে উঠে জীবন রা করে। ২০০৭ সালের ৭ই আগস্ট মঙ্গলবার বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া বাজার থেকে উপজেলা সদরে আসার পথে যাত্রীবাহী একটি নৌকা ঝড়ের কবলে পড়ে উল্টে গেলে ১০ জন যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। একই বছরের ১২ই মে সোমবার বিকালে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থেকে মিঠামইনগামী যাত্রীবাহী এমভি চাঁনপুর নামের একটি লঞ্চ নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের গোড়াদিঘা এলাকায় কালবৈশাখীর কবলে পড়ে শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঘোড়াউত্রা নদীর গভীর জলে ডুবে যায়। দু’দিন পরিচালিত উদ্ধার অভিযানে মাত্র ৪৪ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণার পরও অনেক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন এবং পরিত্যক্ত ঘোষণার ১৬ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে আরও এক যাত্রীর লাশ ভেসে ওঠে। ২০০৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর মিঠামইন উপজেলার কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের চারিগ্রাম ও ফুলপুর গ্রামের মধ্যবর্তী হাওর পথে প্রবাহিত মেঘনার শাখা নদী আইলা দাইরা হৈসরে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ট্রলারের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৭০-৭৫ জন ট্রলার যাত্রী নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে দু’দিন তল্লাশি চালিয়ে এলাকাবাসী নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৫১ জনের লাশ উদ্ধার করতে সম হয়। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার ৮ ঘণ্টা পর বেলা ২টার দিকে ঢাকা থেকে দমকল বাহিনীর ডুবুরি দল ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছার আগেই এলাকাবাসী অধিকাংশ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করে। ২০১০ সালের ১২ই মে বুধবার বাজিতপুরের মাইজচর ইউনিয়নের আইনারগোপ গ্রামের কাছে কাকুরিয়া হাওরে মেঘনা-শীতল্যা-ব্রহ্মপুত্র নদের ত্রিমোহনায় বাতাস এবং ঢেউয়ের কবলে পড়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রলার ডুবে যায়। একই বছরের ১৯শে ডিসেম্বর শনিবার সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সোনারভাগ ইউনিয়নের আলীপুর এলাকায় সুরমা নদীতে সংঘটিত নৌদুর্ঘটনায় ৩৭ যাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়। ৭০-৮০ জন যাত্রী নিয়ে ওই ট্রলারটি কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে আসার পথে একটি বালুভর্তি ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গভীর পানির নিচে তলিয়ে যায়। ২০১১ সালের ২১শে এপ্রিল শতাধিক যাত্রী নিয়ে ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জের সাচনাগামী এমভি বিপাশা লঞ্চটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার রাজাপুরে মেঘনায় ডুবন্ত ট্রলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনাকবলিত হয়। এ ঘটনায় ৪০ জনের মতো যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সর্বশেষ এ বছরের ৩রা ফেব্রুয়ারি রাতে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া ইউনিয়নের প্রতাপপুর এলাকার সুরমা নদীতে যাত্রীবাহী ট্রলারে আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ১২ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়।

১৯৮৪ সালে প্রণীত নৌযান আইন অনুযায়ী, ১৬ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন ব্যবহৃত নৌযানগুলোর নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই। এছাড়া মাছ ধরা, যাতায়াত ও পরিবহনকালে নিয়োজিত ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো অধিকাংশ ৩৩ ফুটের বেশি লম্বা হলেও ‘হর্স পাওয়ার’র ব্যাপারটি সামনে রেখে নৌযান আইন উপেক্ষা ও সরকারি রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব চলছে।

সূত্র : হাওরে ১০ হাজার ফিটনেসবিহীন নৌযান  [কিশোরগঞ্জ নিউজ, ১১ আগস্ট ২০১৭]

Similar Posts

error: Content is protected !!