বিচ্ছেদের পরও কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের নামের সাথে কোনো না কোনোভাবে এখনো আলোচনায় আসে গুলতেকিনের নাম। হুমায়ূন নিজেই তার বিভিন্ন লেখায় অমর করে রেখে গেছেন প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনকে। হুমায়ূন আহমেদের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্পে তিনি যেন এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
গুলতেকিন খানের সর্বশেষ আপডেট
বিয়ে করলেন হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন
গুলতেকিন খান থেকে গুলতেকিন আহমেদ। আবার গুলতেকিন খানে প্রত্যাবর্তন। জীবনের গল্প এর মধ্যে গড়িয়েছে অনেক দূর। শব্দ আর সেলুলয়েডে গল্প বলা মোহন-কথকের পাশে আধা-জীবন কাটানো এই মানুষটার গল্প কেমন? তা জানতেই তার সাক্ষাৎকারের জন্য এই প্রতিবেদকের প্রায় ৪ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষা। শেষতক গুলতেকিন খান পরিবর্তন ডটকমের কাছে উজাড় করলেন তার অনেক অব্যক্ত কথা। একইসঙ্গে জানালেন গত এক যুগে এটাই তার প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পরিবর্তন ডটকম-এর বিশেষ প্রতিনিধি আতিক রহমান পূর্ণিয়া। পরিবর্তন ডটকম-এ প্রকাশিত তিন পর্বের সাক্ষাৎকারটির সবক’টি পর্ব আমাদের নিকলী ডটকম-এর পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হলো।
আপনার ছোটবেলার কথা শুনতে চাই।
আমার জন্ম ধানমন্ডির দখিন হাওয়া নামের বাড়িতে। আমার বোন আর মা আমি বড় হবার পর বলতেন, আমার জন্মের দিন ছিল আষাঢ় মাসে। বিকালবেলা। সেদিন আকাশ খুব মেঘলা ছিল। ছোটবেলায় কখনও হাসতাম না। সবাই বলতো মেঘলা দিনে জন্ম বলেই আমার মুখ সবসময় মেঘলা হয়ে থাকতো। বড় হতে হতেও মুখে খুব হাসি ছিল না। মনে হতো এত হেসে কী হবে? আমার মুখটাই মেঘলা। জীবনে প্রথম খুব মন খুলে হেসেছি ইউএসএ গিয়ে। আগে মনে হতো এতো হাসার দরকার কী?
আপনার জীবনে কার প্রভাব বেশি?
আমার দাদা ইব্রাহীম খান (প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ)। দাদা-দাদু খুব আদর করতেন। তারা সবাই সাহিত্য চর্চা করতেন। লিখতেন। চমৎকার একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। দখিন হাওয়া সুন্দর একটা বাড়ি ছিল। সারা বাড়িতে বিভিন্ন ফলের গাছ। মায়ের শখ ছিল ফুলের বাগান করার। আমি আমার মায়ের গুণগুলো পেয়েছি।
শহীদুল্লাহ হলে থাকার সময়, ইউএসএ-তেও ফুলের বাগান করেছি। প্রতিদিন গান শুনি। বাবার চেয়ে মায়ের সাথে ক্লোজ ছিলাম।
আমার বেড়ে ওঠার পেছনে আমার মা-বাবার অবদান অনেক। প্রথমে মা’র কথা বলতে হলে বলা যায়, মা আমার জীবনে স্বাধীনভাবে চলার অনুপ্রেরণা। আমি তাকে কখনো দেখিনি ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করতে, বা কারো অগোচরে তাকে নিয়ে কথা বলতে।
আর আমার বাবা বাসায় সবসময় রিডার্স ডাইজেস্ট আর টাইমস পত্রিকা রাখতেন। আমি স্কুল শুরুর আগেই এই দুটো থেকে ছবি দেখতাম। পরে পড়তে শিখলাম। বাবাই আমাকে প্রথম পড়তে উৎসাহ দেন। তিনি খুবই বন্ধুসুলভ ছিলেন।
আমার জীবনে দাদার ইনফ্লুয়েন্স বেশি। অনেক পরে বুঝেছি যে অজান্তেই মায়ের প্রভাব পেয়েছি। আমার বিয়ের সময় মা সব থেকে বেশি কান্নাকাটি করেছেন। কাঁদতেন আর বলতেন, আমার আর পড়াশুনা হবে না। ’৭৬ এর মার্চের ১৪ তারিখ এসএসসি পরীক্ষা দিলাম আর ২৮ তারিখ বিয়ে। শুধু মায়ের জন্য ৮/৯ বছর বিরতি দিয়েও পরে পড়াশুনায় ফিরে এসেছিলাম।
পড়াশোনা কোথায় করেছেন?
এসএসসি আজিমপুর গার্লস-এ। এইচএসসিতে হলিক্রসে পড়তাম। পরীক্ষার ৩ মাস আগে আমার বাচ্চাদের বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) আমাকে জোর করে ইউএসএ নিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়া হল না। আমি যেতে চাইনি। শেষে আমার দাদাকে চিঠি লিখে আমাকে যেতে বাধ্য করল। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেডিকেলে পড়তে পারলাম না। একসময় আমার সাবেক স্বামীর ছোট ভাই, মানে আহসান হাবীবের বিয়ের পর সংসার বড় হল। এক বাসায় হয় না। শাশুড়ি থেকে আলাদা হলাম। তখন আমি বললাম, এইচএসসি দেব। মোহনগঞ্জ (হুমায়ূন আহমেদের নানা বাড়ি) গিয়ে মাত্র সাতদিনের মধ্যে সব ফরমালিটি শেষ করে পরীক্ষা দিয়েছি। মাহবুব মামা ( হুমায়ূন আহমদের মামা) যে কলেজে ছিলেন সেখানে ব্যবস্থা করলেন।
এইচএসসি শেষে আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলাম। আমার সাবেক স্বামী বললেন তোমাকে ইডেনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। আমার খুব মন খারাপ হল। বললেন মেডিকেলতো পারছোই না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও না।
একদিন আমার বড় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে তার (মেয়ের) এক বান্ধবীর মা’র কাছ থেকে জানলাম যে লং গ্যাপ থাকলেও তখন আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ আছে। তিনি হেল্প করতে চাইলেন। আমি আমার সাবেক স্বামীকে জানালাম। তিনি বললেন কোনো হেল্প করতে পারবেন না। আমি খুব ছুটাছুটি করে কষ্ট করে ভর্তি ফরম আনলাম।
তখন পরিবারের একজন খুব অসুস্থ। সবাই হাসপাতালে ছুটাছুটিতে ব্যস্ত। একদিন সকালে হাসপাতালে খাবারদাবার পাঠিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি। দেখি লিখা- আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। হুট করে ভাবলাম, যাই পরীক্ষাটা দিয়ে আসি। ততদিনে আমাদের গাড়ি কেনা হয়েছে।
কত সালে?
৮৯ সালে। গাড়ি করে যাচ্ছি। সাথে আমার সাবেক স্বামী হুমায়ূন আছেন।
আমি নামলাম এনেক্স ভবনে। মেয়ের বাবাও নামল। জানতে চাইলাম সে কোথায় যাবে। বলল তার ডিউটি এনেক্সের ১ নম্বর রুমে। আমারও পরীক্ষা ওই রুমে। আমি বললাম, তুমি থাকলে আমি পরীক্ষা দিব না। একটু তর্ক হল। জানেন, তার পড়াশুনায় আমি সব সময় হেল্প করেছি। কিন্তু সে আমার পড়াশুনায় কোনো দিন হেল্প করেনি। সেদিন কিছু একটা বলে সে চলে যায়। ওই রুমে ডিউটি দেয়নি।
পরেরদিন পত্রিকায় দেখলাম ২৯ হাজার পরীক্ষা দিয়েছে। নেবে মাত্র ২৯শ। যেদিন রেজাল্ট সেদিন আমার সাবেক স্বামী বলল, আমি রেজাল্ট দেখে আসি। রেজাল্ট দেখে এসে সে জানতে চাইল, তুমি কি ঠিক রোল নম্বর দিয়েছ? আমি বললাম, হ্যাঁ।
সে বলল, তুমি চান্স পেয়েছ। তাও অনেক উপরের দিকে।
ভাইভার দিন আমার সাবেক স্বামী বলল, তুমি সাবজেক্ট সোশ্যালজি নাও।
তাকে আমি বলেছিলাম, তোমার ফ্রেন্ড বা কাউকে, টিচারদের বলবে না যে আমি ভর্তি হচ্ছি। সে আমাকে খুব আন্ডারএস্টিমেইট করত। এটা আমার খুব খারাপ লাগত।
আমি খুব হ্যাংলা পাতলা ছিলাম। ভাইভার দিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি ইংলিশে পড়। আমি বললাম- না। আমি সোশ্যালজি লিখে দিয়ে আসলাম। বিকেলে আমার এক্স হাজবেন্ড আসলেন। বললাম, তোমার কথায় সাবজেক্ট সোশ্যালজি দিয়েছি।
সে বলল, খুব ভাল। তুমি ইংলিশ পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমি তাকে বললাম, তোমার পকেটে ইউনিভার্সিটির যে ডায়েরিটা আছে, দাও। আমি নিজেই তার পকেট থেকে ডায়েরিটা নিলাম।
আমার খুব ইগোতে লাগল। কেন বলল, আমি ইংলিশ পারবো না! আমি ডায়েরি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে যে স্যার ভাইভা নিয়েছিলেন তাকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আমি কি সোশ্যালজির পরিবর্তে ইংলিশ নিতে পারি? তিনি বললেন- হ্যাঁ। আর একটা কথা খুব ইগোতে লেগেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হুমায়ূন বলেছিল, আমাকে সে পোষ্য কোটায় ভর্তি করাতে চেয়েছিল। আমি কেন পোষ্য কোটায় ভর্তি হব!
গুলতেকিন বলে যাচ্ছেন…
পারিবারিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটারেচারটা ভালভাবে পড়তে পারিনি। একসময় কবিতার প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রচুর ইংরেজি কবিতা পড়তাম। অনেক কবির। একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, হুমায়ূন সবসময় তার লেখায় বাংলায় কোটেশন ব্যবহার করত। কখনও কখনও শেক্সপিয়ারের কিছু কোটেশন দিয়েছে। তবে বেশিরভাগই বাংলা কোটেশন ছিল। ৮৯ সালের পর আমার কাছ থেকে ইংরেজি কোটেশন ব্যবহার শিখেছে। সে রাত জাগত। একটু পরপর চা খেত। আমি বসে বসে কবিতা পড়তাম। তখন কোনো কবিতা ভাল লাগলে তার কাছে নিয়ে আসতাম। পড়ে শোনাতাম। সেই সব অনেক কবিতা থেকে হুমায়ূন তার লেখায় ইংরেজি কবিতার কোটেশন ব্যবহার করেছে।
আমার মনে আছে, আমাদের ছেলে হয়েছিল। আগে থেকেই নাম ঠিক করে রেখেছিলাম রাশেদ হুমায়ূন। মেয়ে হলে কী নাম হবে তাও ঠিক করা ছিল। রাশেদ হুমায়ূন জন্মের তিনদিন পর মারা যায়। এর তিন-চার দিন পর হুমায়ূনের ইউএসএ যাওয়ার কথা তিন মাসের জন্য। তারও তিন-চার দিন পর আমার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল। হুমায়ূন ইউএসএ যাওয়ার আগে তার ‘ভক্তা-ভক্তিরা’ এসেছিল। ভক্তির সংখ্যাই বেশি। সারারাত তাদের সময় দিল। আমি অভিমান করেছিলাম। বললাম, চলে যাবে তবু আমাকে সময় দিলে না। আমার বাচ্চাদের বাবা রেগে গেল। বলল, তোমার জন্য বাচ্চা মারা গেছে। তুমি বাচ্চা চাওনি।
তারপর কী হল? আপনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন?
হুমায়ূন চলে গেল। আবার আমারও পরীক্ষা। আমি পরীক্ষা দেব সিদ্ধান্ত নিলাম। কাঁদতে কাঁদতে পরীক্ষা দিতে গেলাম। আমার নিকট আত্মীয় রিংকুকে সাথে নিয়ে পরীক্ষার হলে গেলাম। রিংকু আমার সামনের সিটে বসার কথা। তাকে বললাম, পরীক্ষার সময় তুমি পেছনে তাকাবে না। কারণ আমি পরীক্ষা না দিয়ে বেরও হয়ে যেতে পারি। তখন তোমার পরীক্ষা খারাপ হবে।
তখন এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের কারণে একটা পরীক্ষা হবার পর আর হলো না। পরে আমিও ইউএসএ চলে গেলাম।
পড়াশুনাটা কীভাবে সম্পন্ন করেছেন?
তখন আমরা এলিফেন্ট রোডের বাসায় চলে এসেছি। আমার শাশুড়ি আমাকে অনেক বেশি হেল্প করেছেন। তিনিই নুহাশকে দেখতেন।
নুহাশের বয়স তখন মাত্র দুই বছর। আমি দরজা বন্ধ করে পড়তাম। নুহাশ গিয়ে বারবার দরজা ধাক্কাতো, ডাকত। আমার শাশুড়ি সামলাতেন। মাস্টার্সেও ভালভাবে পড়তে পারিনি। কিছু পারসোনাল প্রবলেম ছিল। এ নিয়ে কথা বলতে চাই না। আমার পড়ালেখাটা বড় একটা স্ট্রাগল। নুহাশ ছোট। তার বাবা খুব ব্যস্ত। ফুলটাইম কোনো কাজে যোগ দিতে পারছিলাম না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএ (টিচার্স অ্যাসিসট্যান্ট বা শিক্ষকের সহকারী) হিসেবে যোগ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। চিন্তা করলাম। এটাতো পুরোপুরি শিক্ষকতা না, শিক্ষক যা বলবেন তাই করতে হবে। আমার একজন বান্ধবী পরামর্শ দিল যে এ কাজটা ভাল হবে না। ১৯৯৮ সাল থেকে স্কলাসটিকা স্কুলে শিক্ষকতা করছি। এখনও আছি। মাঝে ব্যক্তিগত কারণে এক বছর গ্যাপ দিয়েছিলাম।
হুমায়ূন আমার ক্লাস বা টিউটোরিয়াল থাকলে বলত, এখানে যাব, ওখানে যাব। আমি বলতাম, আমার টিউটোরিয়াল আছে। ক্লাস আছে। সে বলত, স্যারকে বলে ম্যানেজ করে নাও। পরে দিয়ে দিও। আমি না করতাম। সে চলে যেত। সে তার বন্ধু, ওই যে অয়োময়ের হানিফ (মোজাম্মেল হোসেন) ভাইকে নিয়ে একবার ইন্ডিয়া চলে গেল। একে ওকে নিয়ে ঘুরতে চলে যেত। ঘুরে এসে বলত, বন্ধুদের সাথে বেড়ানোতে কী যে মজা!
আমি জাতিসংঘে কাজ করতে পারতাম। এতদিনে অনেক বড় পদে থাকতে পারতাম।
আমার স্কুল বছরে একবার এক মাসের ছুটি হত। তখন ঘুরতে যেতে চাইতাম। কিন্তু সে সময় হুমায়ূন রাজি হত না। আমি বাচ্চাদের নিয়ে বা গ্রুপে পরে নিজেই ঘুরতে বের হতাম। ক্লাস ফ্রেন্ডরা আমাকে গুল ডাকত। জিনাত আপা (আত্মীয়) বললেন, প্রত্যেকবার কলকাতায় যাই, এবার ব্যাংকক যাব। প্রথমবার ব্যাংকক গিয়ে খুব এনজয় করেছি।
ব্যাংকক থেকে স্যান্ডেল কিনলাম। আমার আর হুমায়ূনের পায়ের মাপ এক ছিল। আমি জানতাম। একশ’-দেড়শ’ ডলার দিয়ে সবচেয়ে দামি স্যান্ডেলটা বাচ্চাদের বাবার জন্য কিনলাম। দেশে এসে তাকে দিলাম। একদিন হুমায়ূন বাজারে গেল। বাজার থেকে ফেরার পর দেখি তার পায়ে ঐ স্যান্ডেল। বলল, বাজারে পরার জন্য জুতাটা খুব আরামের।
একবার আমার সাবেক স্বামীকে বললাম, কী যেন একটা কাজে আমি গাজীপুর যাব। সে বলল, তুমিতো এখন বড়লোক। তোমার এখন বড়লোক ফ্রেন্ড। তুমি দেশ-বিদেশ যাবে।
আমার ফ্ল্যাট বিক্রি করে মালয়েশিয়া, ব্যাংকক অনেক দেশে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। এ জন্য আমার কোনো গিল্টিনেস নেই। সামনের সেপ্টেম্বরে ইটালি-জার্মানি-ফ্রান্স যাব ভেবেছিলাম। ইটালিতে একটু কাজও ছিল। ইউরোপে ঘুরে আসার ইচ্ছা। এখনতো দেখি ফ্রান্সেও জঙ্গি হামলা। তাই ক্যান্সেল করেছি।
বিদেশ ভ্রমণের বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতার কথা…
২০০২ সালে আমার বড় মেয়ে বলল, সে স্থায়ীভাবে ইউএসএ চলে যাবে। আমার তখন মনে হল চার বাচ্চাকে নিয়ে আবার কবে ঘুরতে যাব? আমরা মালয়েশিয়া গেলাম। রোজা আর ঈদের সময় বাচ্চারা মালয়েশিয়া যেতে একদমই রাজি ছিল না। গিয়ে ওদের সে কি আনন্দ! বাচ্চারা প্রচুর কেনাকাটা করল। খুব এনজয় করল। ঈদের দিন আমি ওদের ৫০ ডলার করে সালামি দিলাম। ওরা আরো খুশি। ওরা আরো কেনাকাটা করল। দেশে ফিরে দেখি সব জিনিস র্যাপিং পেপারে মোড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, বলল, সব কেনাকাটা ফ্রেন্ডদের জন্য করেছে। ফ্রেন্ডদের গিফট করবে। আসলে ওদেরতো কাছের তেমন কেউ নেই। ইকবাল ভাই (জাফর ইকবাল) সিলেটে থাকেন। আহসান হাবীব সেই পল্লবীতে।
আবার ওদের নিয়ে ব্যাংকক গেলাম। অবশ্য যে এজেন্ট ব্যাংককের ট্যুরটা ম্যানেজ করেছিল সে হোটেলটা খুব বাজে দিয়েছিল। বাঙালি ম্যানেজমেন্ট ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, টাকা যাই লাগুক, আমি বাচ্চাদের নিয়ে ওয়েস্টিনে উঠে গেলাম।
বিদেশে একসময় ঈদের দিন আমি বাচ্চাদের বললাম, তোমরা বাবাকে ফোন কর। আমি রুম থেকেই ফোন করার ব্যবস্থা করে দিলাম।
একবার আমরা ছুটি পেলাম। আমি মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইলাম। তখন হুমায়ূন গাজীপুরের জায়গাটা কিনেছে। শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। আমি তাকে চিঠি পাঠিয়ে জানালাম, আমরা ঘুরতে যেতে চাই। সে কোনো উত্তর দেয় না। যোগাযোগও নেই। আমি অস্থির হয়ে গেলাম। বাচ্চাদের বললাম, আমি তোমাদের নিয়ে কক্সবাজার যাব। তারা বিশ্বাস করতে চায় না। বলে তুমি কীভাবে একা কক্সবাজার নিয়ে যাবে? আমি সারারাত ঘুমাইনি। সকালে উঠে নিজেই পর্যটনে গেলাম। সেখান থেকে কক্সবাজারের পর্যটন মোটেলের রিজার্ভেশন দিলাম। সেবার বাচ্চারা খুব মজা করেছে।
এখন কেমন আছেন?
এখন খুব ভাল আছি। অনেকে আমাদের ডিভোর্সের পর আহা উহু করেছে। ৬ জুন (২০০৫) কাগজ পেয়েছিলাম। এর আগে শুনেছিলাম যে সে ডিভোর্স করেছে। এক আত্মীয় এসে বলেছিল তারা (হুমায়ূন-শাওন) বিয়ে করেছে।
সে বছর ১৭ জুন প্রথম আলো-তে আমার লেখা যাবার কথা। প্রথম আলো আমাকে জানাল হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বিষয়টা নিয়ে একটা লেখা দিয়েছে। আমি যেন একটা লেখা দিই। আমি কখনও হুমায়ূন বা তার প্রেজেন্ট ওয়াইফ সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বলিনি। তাকে আমি প্রেজেন্ট ওয়াইফই বলব। আগে নাম ধরে ডাকতাম। আমি ওই সময় বাচ্চাদের সঙ্গে এনজয় করে সময় কাটিয়েছি।
যেদিন পত্রিকায় আমাদের লেখা আসবে সেদিন বিষয়টি সবার আরো ভাল করে জেনে যাওয়ার কথা। আমার একদমই অন্য কোনো অনুভূতি হয়নি। আমি স্কুলে যাব। যেদিন আমার আর হুমায়ূনের লেখাটা প্রকাশ হবে, সেদিন আমি একটা নতুন সবুজ শাড়ি পরে স্কুলে গেলাম। হাতভর্তি সবুজ চুড়ি পরলাম। স্কুলে গিয়ে খুব হাসিখুশি থাকলাম। একেবারেই কোনো চাপ নেই। কেউ আমাকে এসব বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করল না।
সে যখন বিয়ে করেছে তাতে আই ওয়াজ রিল্যাক্স। মাথার উপর থেকে একটা ভারি পাহাড় সরে গেল। দিনের পর দিন একটা মিথ্যা নিয়ে বসবাস করা যায় না। যে বছরের শুরুতে শাওনের বাচ্চা হল ওই বছরের ডিসেম্বরে আমার বড় মেয়েরও বাচ্চা হল। আমি যখন প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় তখন আমার মা কাছে আসতেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন। মায়ের মন যেমন হয়; মা আমাকে বারবার বোঝাতেন, দেখো সে তোমার কাছে ফিরে আসবে। আমি ডিভোর্সের পর কোনো কান্নাকাটি করিনি। আমি ফ্রি। আই ওয়াজ হ্যাপি। নানান জন নানান কথা বলে। কিন্তু আমি, আমার মেয়েরা জানতাম, হোয়াটস হ্যাপেনিং, হোয়াটস গোয়িং রং। আমার তখন বারবার মনে হয়েছে, যদি এমন বসবাসে অসুবিধা হয় তাহলে আলাদা থাকাই ভাল।
এ সমাজের মেয়েদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে কিছু বলুন, আপনার অবজারভেশন?
আমি সবসময় বলি, আগেও বলেছি- মেয়েদের তিনটা জিনিস দরকার; তাহলে তারা ছেলেদের সমান হতে পারবে। সময়, যোগ্যতা ও সুযোগ। এই তিনটা হলে একজন মেয়ে অনেক কিছু পারে।
কোনো মুহূর্তে কি শূন্যতা বোধ করেন?
শূন্যতা সবার মাঝে সবসময় থাকে। পুরোপুরি স্যাটিসফাইড কোনো মানুষই না।
আপনার কোনো অপূর্ণতা?
আমার একটা আফসোস। আমি গান শিখতাম বাফাতে। গানটা আর বিয়ের পর করা হয়নি। রবীন্দ্রসংগীত শিখতাম। এখনকার দু’জন খুব গুণী শিল্পীর সঙ্গে একসাথে শিখতাম। ৮৭-তে সে (হুমায়ূন) আমাকে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল। গানের টিচার রেখে দিয়েছিল। কিন্তু সে চাইতো নজরুলগীতি শিখি। সেটা খুব টাফ। অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। গান যে ছেড়ে দিয়েছি, এখন আফসোস লাগে। ২০০৫-এ আমি একটা হারমোনিয়াম কিনেছিলাম। আবারো একটা কিনব। ক্লাস নিতে নিতে গলায় একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডাক্তার জোরে কথা বলতে নিষেধ করেছে। এখন ছোট ক্লাসে পড়াই। বড় ক্লাসে পড়াতে পারি। কিন্তু তাতে গলায় চাপ পড়বে।
নিজের একটা কবিতা আবৃত্তি করে সাক্ষাৎকার শেষ করেন গুলতেকিন।
সাতকাহন
সাতকাহনের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে,
একটি মেয়ে যাচ্ছে ফিরে বাড়ি।
প্রশ্ন অনেক চোখের তারায়:
মেয়েটি নয় তেমন সংসারী।
জানে কি সে কোন ঠিকানায় যাবে,
আদৌ কি তার আছে কোনো ঠাঁই?
পথের পাশে কাটাবে একা রাত?
বন্ধু হবে শুধু আকাশটাই।
তাকিয়ে থাকার শক্তিটুকু আছে,
আমার নেই অন্য কোনো জোর;
ব্যর্থ কলম, চোখের জলে তারই
কেমন করে সাজাবো তার ভোর?
সূত্র : সে আমাকে খুব আন্ডারএস্টিমেইট করত (১ম কিস্তি); আমার বাচ্চাদের বাবা রেগে গেল (২য় কিস্তি); সে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিল (৩য় কিস্তি) [পরিবর্তন]